মুসলমান-রচিত সাহিত্যের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানবিকতা, যা মানুষ সম্বন্ধে কৌতূহল বা জিজ্ঞাসাই নির্দেশ করে অর্থাৎ বিস্ময়-ব্যাকুল কল্পচারী মানুষের প্রকৃতি, নিসর্গ ও মানস-সৃষ্ট দেব দানব সম্বন্ধীয় আদিম কৌতূহল চোখে-দেখা মানুষের প্রতি নিবদ্ধ হল। অর্থাৎ স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের পরিসরে ওরাও রইল, মানুষকেও জিজ্ঞাসার বিষয় করে নিল। প্রাকৃত ও অপ্রাকৃত, লৌকিক ও অলৌকিক, স্বপ্ন ও কল্পনা এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষের কোনো সীমারেখা স্বীকৃত নয় এ জগতে। নদী নগরী, গিরি-মরু-কান্তার ও স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের পরিসরে দেব-দানব-রাক্ষস, ভূত-প্রেত-জ্বিন এবং বুনো পশুপাখি-সরীসৃপের সমবায়ে গড়ে উঠেছে এ জগৎ। বাহুবল, মনোবল, আর বিলাস-বাঞ্ছাই সে জীবনের আদর্শ, সগ্রামশীলতা ও বিপদের মুখে আত্মপ্রতিষ্ঠা সে জীবনের ব্রত এবং ভোগই লক্ষ্য। এক কথায় সংঘাতময় বিচিত্র দ্বান্দ্বিক জীবনের উল্লাসই এ সাহিত্যে পরিব্যক্ত।
পাক-ভারতে মুসলমান অধিকার যেমন ইরানি সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে এ দেশবাসীর পরিচয় ঘটিয়েছে, তেমনি একচ্ছত্র শাসন ভারতের অঞ্চলগুলোর পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে। এরূপে বাঙালি রা ইরানি ও হিন্দুস্তানী ভাষা-সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়ে এ দুটোর আদর্শে ও অনুসরণে নিজেদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির পরিচর্যা করে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ঋদ্ধ হয়েছে।
.
০৯.
॥ উপাখ্যান ॥
হিন্দুরচিত সাহিত্য যেমন মুখ্যত অনুকৃতি, বাঙালি মুসলমান রচিত সাহিত্যও প্রধানত অনুবাদ। গোটা মধ্যযুগব্যাপী হিন্দু-মুসলমানের বাঙলা রচনা অনুকৃতি ও অনুবাদে সীমিত। এ অসম্পূর্ণ শিক্ষা ও অসামর্থ্যেরই সাক্ষ্য। এঁদের রচনা পরিমাণে প্রচুর কিন্তু উৎকর্ষে বিশিষ্ট নয়। আমাদের মুকুন্দরাম যখন চণ্ডীমঙ্গল লিখছেন তখন শেক্সপিয়র লিখেছেন তাঁর কালজয়ী নাটক। এতেই বোঝা যায় উনিশ শতকের আগে বাঙলা কখনো প্রতিভার পরিচর্যা পায়নি। তাই তারা লাটিমের মতো কেবলই ঘুরেছে, কিন্তু পাঁচশ বছরেও ভাষায় ও সাহিত্যে এতটুকু অগ্রসর হয়নি। মূলত, ফরাসি ও হিন্দি গ্রন্থের অনুবাদের ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে আমাদের উপাখ্যান-সাহিত্য এবং আরবি ও ফারসি থেকে অনূদিত হয়েছে আমাদের ধর্ম ও যুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থগুলো। অনুবাদ সাধারণ তিন প্রকারের হত– কায়িক, ছায়িক ও ভাবিক অর্থাৎ আক্ষরিক, স্বাধীন অনুসৃতি ও ভাবানুসরণ। সেকালে অনুবাদ কৃচিৎ আক্ষরিক হত। হিন্দি ও ফারসি প্রণয়োপাখ্যানগুলো সাধারণত সূফীতত্ত্বের তথা জীবাত্মা-পরমাত্মার রূপকাশ্রিত হলেও বাঙলায় তর্জমা হয়েছে লৌকিক প্রণয়োপাখ্যান রূপেই। তত্ত্বকথাকে এভাবে রস কথায় রূপান্তরের প্রবণতার মধ্যে ঐহিক জীবনবাদী বাঙালি মানসের স্বরূপ ধরা পড়েছে। চর্যাপদ, বৈষ্ণবগান, বাউল-মুর্শিদা-মারফতি প্রভৃতি অধ্যাত্মগীতির দেশে এ মানবিক রস-প্রীতি লক্ষণীয় ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ বাঙালি চরিত্রের একটি নতুন দিগদর্শন। এদিক দিয়ে শাহ মুহম্মদ সগীরের (১৩৮৯-১৪০৯ খ্রী.) ইউসুফ-জোলেখাই সম্ভবত গোটা আধুনিক পাক-ভারতিক সাহিত্যে প্রথম লৌকিক প্রণয়োপাখ্যান।
সে-যুগের হিসেবে বাঙলা রোমান্টিক সাহিত্য পরিমাণে প্রচুর, যদিও বৈশিষ্ট্যে বিচিত্র নয়। চৌদ্দ শতকের শেষ দশকে যার শুরু, বটতলার বদৌলতে আজ অবধি তার ইতি ঘটেনি। অধিকাংশ রোমান্স উনিশ-বিশ শতকে দোভাষী রীতিতে রচিত এবং রূপে-রসে নিতান্তই তুচ্ছ আর ভাবে-ভঙ্গিতেও বৈশিষ্ট্যহীন। বিশেষ করে পাশ্চাত্য ধারায় শিক্ষিত লোকের সাহিত্য সৃষ্টি হওয়ার পর ওসব রচনার আর কোনো সাহিত্যিক মূল্যই নেই। আর সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক মূল্যও নগণ্য। তাই আমরা ওগুলো বাদ দিয়ে আঠারো শতক অবধি রচিত জ্ঞাত রোমান্সগুলোর নাম করছি।
চৌদ্দ শতকের শেষের দিকে কিংবা পনেরো শতকের প্রথম দশকে রচিত হয় শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা। ষোলো শতকে পাচ্ছি দৌলত উজির বাহরাম খানের লায়লী মজনু, মুহম্মদ কবীরের মধুমালতী, শা বারিদ খানের বিদ্যাসুন্দর। সতেরো শতকের উপাখ্যান হচ্ছে দোনা গাজীর সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল; কাজী দৌলতের সতীময়নালোর-চন্দ্রানী, আলাউলের পদ্মাবতী সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল, সপ্ত পয়কর, রতন কলিকা; মাগন ঠাকুরের চন্দ্রাবতী, আবদুল হাকিমের লালমতি সয়ফুলমুলক, ইউসুফ জোলেখা; নওয়াজিস খানের গুলে বকাউলি, পরাগলের শাহ পরী, মঙ্গলাদের শাহজালাল-মধুমালা, সৈয়দ মুহম্মদ আকবরের জেবল মূলক সামারোখ, আবদুল করিম খোন্দকারের তমিম আনসারী, শরীফ শাহর লালমতি সয়ফুলমুলুক। আর আঠারো শতকে রচিত হয়েছে মুহম্মদ মুকিমের কালাকাম, মৃগাবতী, গুলে বকাউলি; মুহম্মদ রফিউদ্দিনের জেবল মূলক শামারোখ, শাকের মাহমুদের মনোহর মধুমালা, নুর মুহম্মদের মধুমালা, ফকির গরীবুল্লাহর ইউসুফ জোলেখা; সৈয়দ হামজার মধুমালতী, জৈগুনের কেচ্ছা; মুহম্মদ আলী রজার তমিম গোলাম চতুন্নছিলাল, মিশরীজামাল, মুহম্মদ আলীর শাহপরী মল্লিকাজাদা, হাসান বানু; আবদুর রাজ্জাকের সয়ফুলমুলুক লালবানু, শমসের আলীর রেজওয়ান শাহ এবং মুহম্মদ জীবনের বানু হোসেন বাহরাম গোর, কামরূপ-কালাকাম, খলিলের চন্দ্রমুখী প্রভৃতি। মুসলিম প্রভাবে আঠারো-উনিশ শতকের কয়েকজন হিন্দুও প্রণয়োপাখ্যান লিখেছেন। সুশীল মিশ্রের রূপবান-রূপবতী উপাখ্যান, বাণীরাম ধরের শীত-বসন্ত কাহিনী, রামজী দাসের শশিচন্দ্রের পুথি, দ্বিজ পশুপতির চন্দ্রাবলী, মহেশ চন্দ্র দাসের সয়ফুল তমিজ জরুখভান, গোপীনাথ দাসের মনোহর মধুমালতী, এ যাবৎ আমাদের হাতে এসেছে। এসবের মধ্যে ইউসুফ জোলেখা, লায়লীমজনু, সতীময়না-লোর-চন্দ্রানী, পদ্মাবতী, সয়ফুলমুলুক, লালমতী সয়ফুলমুলুক, মধুমালতী, গুলেবকাউলি ও চন্দ্রাবতী কাব্যগুণে, কাহিনী-মাধুর্যে কিংবা বৈদগ্ধ্যে শ্রেষ্ঠ।