চট্টগ্রাম ছিল আরাকান রাজ্যের অন্তর্গত। আর আরাকানের রাজধানী ছিল মোহং (Mrauhang)। এর বিকৃত বাঙলা নাম রোহাং বা রোসাঙ। রোসাঙের বাঙালি মুসলমান রাজসচিব আশরাফ খানের আগ্রহে কাজী দৌলত (১৬২২-৩৫) অনুবাদ করেন হিন্দি কবি মিয়া সাধনের অধ্যাত্ম-রূপক কাব্য ময়নাসৎ। এর বাঙলা নাম সতী ময়না-লোর-চন্দ্রানী। মাগন ঠাকুর, সোলায়মান, সৈয়দ মুসা, সৈয়দ মুহম্মদ খান, নবরাজ মজলিস প্রমুখ রাজসচিবের আদেশে পদ্মাবতী, সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল, রতন কলিকা-আনন্দ বর্মা, তোহফা, সপ্ত পয়কর ও সেকান্দর নামা অনুবাদ করেন আলাউল। এভাবে কারো-না-কারো প্রতিপোষকতায় মধ্যযুগীর ধারায় অনুবাদের কাজ উনিশ শতকের প্রথমার্ধ অবধি চলেছে।
মধ্যযুগে পাক-ভারতের হিন্দুরা সংস্কৃতের ভাষাকে ধর্মকথা তথা লৌকিক দেবতার মাহাত্ম্য প্রচারের বাহনরূপেই কেবল ব্যবহার করতেন। মালাধর বসুর কথায়, পুরাণ পড়িতে নাই শূদ্রের অধিকার। পাঁচালি পড়িয়া তর এ ভব সংসার। এ উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে। অতএব তাঁরা গরজে পড়ে ধর্মীয় প্রচার-সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, সাহিত্যশিল্প গড়ে তুলবার প্রয়াসী হননি। দেবতার মাহাত্ম্যকথা জনপ্রিয় করাবার জন্যে তারা প্রেম ও বিরহ কাহিনীর আশ্রয় নিয়েছেন এবং এতে সাহিত্য-শিল্প যা গড়ে উঠেছে তথা সাহিত্যরস যা জমে উঠেছে তা আনুষঙ্গিক ও আকস্মিক, উদ্দিষ্ট নয়। কাজেই বলতে হয় মধ্যযুগে হিন্দুদের বাঙলা সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াস ছিল না, লৌকিক ধর্মের প্রচারই লক্ষ্য ছিল। এর এক সম্ভাব্য কারণ এ হতে পারে যে শিক্ষা ও সাহিত্যের বাহন ছিল সংস্কৃত। কাজেই শিক্ষিতমাত্রই সংস্কৃত সাহিত্য পাঠ করত। তাই বাঙলায় সাহিত্য সৃষ্টির গরজ কেউ অনুভব করেনি। তারা অশিক্ষিতদেরকে ধর্মকথা শোনানোর জন্যে ধর্ম সংপৃক্ত পাঁচালি রচনা করতেন। পরে সংস্কৃতের প্রভাব কমে গেলেও এবং বাঙলা প্রাথমিক শিক্ষায় গুরুত্ব পেলেও পূর্বেকার রীতির বদল হয়নি আঠারো শতক অবধি। কেবল আঠারো শতকেই কয়েকজন হিন্দু-প্রণয়োপাখ্যান রচয়িতার সাক্ষাৎ পাচ্ছি৫৫।
আর্যেরা প্রকৃতিপূজক ছিল। আর্যভাবে পাক-ভারতিক জনগণ প্রাকৃত শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে তোয়াজে-তারিফে তুষ্ট করে জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা খুঁজেছে চিরকাল। ফলে প্রাকৃতিক শক্তিকে পদানত করে জীবনকে বিপন্মুক্ত করবার চেষ্টা দেখা যায়নি কখনো। এভাবে বাঙালি হিন্দুর মন-মানসে সাহস স্বাভাবিকভাবে জন্মাতে পারেনি। ফলে দেবতা ও অপদেবতার কাল্পনিক অনুকম্পানির্ভর জীবনের স্বাভাবিক স্ফুর্তিও ব্যাহত হয়েছে অনেকাংশে। এ বিকৃত মনমানসের স্বাক্ষর রয়েছে পুরাণমিশ্ৰিত মঙ্গলকাব্যে ও অন্যান্য পাঁচালিতে। সংস্কারমুক্ত একেশ্বরবাদী মুসলমানের সংস্পর্শে আসার ফলে এদেশী হিন্দুর প্রাণে-মনে মানবাত্মার মহিমা এবং মানবিক শক্তি, সামর্থ্য ও সম্ভাবনা সম্বন্ধে অভিনব বোধ জাগে। মুসলিম প্রভাবে এই মানব মহিমা ও মানবিকতার উদ্বোধনের ফলে পশ্চিমবঙ্গে উদ্ভূত হয়েছে মানবাত্মার অপরিসীম মহিমা ও সম্ভাবনার বাণীবাহী বৈষ্ণব মতের, আর পূর্ব বাঙলার নদী-নির্যাতিত সগ্রামী মনে জেগেছে পৌরুষ, দেবদ্রোহিতা, আত্মনির্ভরশীলতা ও মর্যাদাবোধ; যেমন হয়েছিল দক্ষিণ ও উত্তর ভারতে অদ্বৈতবাদ ও ভক্তিভিত্তিক সন্তধর্মের উদ্ভব। তাই মনসামঙ্গলের বিকাশ-ভূমি পূর্ব বাঙলা। মনসার ভাসান দেবতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামের কাহিনী। সে-সগ্রামে মানুষ পরাজিত হয়েছে বটে, কিন্তু তার আত্মা হয়েছে মহিমান্বিত। চাঁদ সদাগর আত্মবিশ্বাস ও আত্মিক শক্তির প্রতীক। তিনি মাথা নোয়ালেন দেবতার পায়ে নয়, একটি কিশোরীর অনমনীয়কৃচ্ছু সাধনার কাছে। চাঁদ বেনে ও বেহুলা বাঙালি পুরুষ ও নারী। মানুষকে এ স্বরূপে ইতিপূর্বে বাঙালি র রচনায় আর দেখা যায়নি। ইসলামি সংস্কৃতির বিস্তার যে বাঙালি র চিত্তলোকে বাসন্তী হাওয়া বয়ে আনে, তাদের মানস জগৎ
যে নবজীবনের সংস্পর্শে বিপ্লবমুখী ও সৃজনশীল হয়ে উঠে, তার প্রমাণ মঙ্গলকাব্য আর বৈষ্ণব। মতবাদ ও সাহিত্য। মধ্যযুগের মুসলিম-রচিত সাহিত্য দেশ-দুর্লভ নতুন ভাব, চিন্তা, রস ও আত্মবিশ্বাস-পুষ্ট জীবনবোধের আকর।
.
০৮.
॥ মুসলিম–রচিত বাঙলা সাহিত্য।
বাঙলা দেশের প্রায় সবাই দেশজ মুসলমান। তাই বাঙলা সাহিত্যের উন্মেষ- যুগে সুলতান সুবাদারের প্রতিপোষকতা পেয়ে কেবল হিন্দুরাই বাঙলায় সাহিত্য সৃষ্টি করেননি, মুসলমানেরাও তাঁদের সাথে সাথে কলম ধরেছিলেন এবং মধ্যযুগের বাঙালি মুসলমানগণের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এই যে ধর্মপ্রেরণাবিহীন নিছক সাহিত্যরস পরিবেশনের জন্যে তাঁরাই লেখনী ধারণ করেন। আধুনিক সংজ্ঞায় বিশুদ্ধ সাহিত্য আমরা তাদের হাতেই পেয়েছি। কাব্যের বিষয়বস্তুতে বৈচিত্র্য দানের গৌরবও তাদেরই। কেননা সবরকমের বিষয়বস্তুই তাঁদের রচনার অবলম্বন হয়েছে। মুসলমানের দ্বারা এই মানব-রসাশ্রিত সাহিত্যধারার প্রবর্তন সম্ভব হয়েছে ইরানি সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফলে। দরবারের ইরানি ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় এদেশের হিন্দু ও মুসলমানের একই সূত্রে এবং একই কালে হলেও একেশ্বরবাদী মুসলমানের স্বাজাত্যবোধ তাদের ইরানি সংস্কৃতি দ্রুত গ্রহণে ও সাঙ্গীকরণে সহায়তা করেছে প্রচুর। কিন্তু গোঁড়ামিপ্রবণ হিন্দুর পক্ষে ছয়শ বছরেও তা সম্ভব হয়নি। তাই মুসলমান-কবিগণ যখন আধুনিক সংজ্ঞায় বিশুদ্ধ সাহিত্য প্রণয়োপাখ্যান রচনা করেছিলেন, হিন্দু-লেখকগণ তখনো দেবতা ও অতিমানব জগতের মোহমুক্ত হতে পারেননি।