পূর্ববঙ্গ গীতিকা ও ময়মনসিংহ গীতিকা লোকসাহিত্যের তথা বাঙলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। বাস্তবতায়, মানবিকতায় ও জীবনচেতনায় এগুলো অনন্য। এতে ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবনের প্রতিচ্ছবি বিধৃত রয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনের ইতিহাসের মূল্যবান উপকরণ মেলে গাথাগুলোতে। গীতিকাগুলোর রচনাকালের পরিধি ষোলো থেকে আঠারো শতক অবধি বিস্তৃত।
বলেছি, এদেশে তুকী-মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার আগে ধর্মচর্চার, সাহিত্যের ও দরবারের ভাষা ছিল সংস্কৃত। বাঙলা তখন মুখের বুলির স্তর পার হয়নি। এ ভাষায়-যে কিছু লেখা যায়, এ ভাষাও-যে সাহিত্যের ভাষা হতে পারে তা কখনো কোনো গুণীজন ভাবেননি। অশিক্ষিত জনগণ তাদের বুলিতে মুখে মুখে গান, গাথা, ছড়া, ব্রতকথা, রূপকথা ও উপকথা রচনা করে মনের ভাব প্রকাশ করত। এছাড়া দেবতার পূজা করবার কিংবা তাঁর কাছে সুখ-দুঃখ-বেদনার কথা নিজে নিবেদন করবার এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মশাস্ত্র রচনে-পঠনে-শ্রবণে শূদ্রের ও নারীর অধিকার ছিল না বলে। জনগণ কথকতার মাধ্যমে দেবকথা ও ধর্মকথা জানবার চেষ্টা করত। এভাবে রামের ছড়া, ভারতকথা, কৃষ্ণ ধামালী, মনসা ও চণ্ডীর কথা, ব্রতকথা প্রভৃতি মুখে মুখে রচিত হয়েছিল। কিন্তু অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানিচ ভাষায়াং মানব শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্ৰজেৎ।–ব্রাহ্মণ্য সমাজপতিদের এরকম কঠোর পতি ছিল বলে কেউ সেসব লিখবার ও পড়ে শুনবার সাহস পায়নি।
তাছাড়া সেন আমলে সাধারণ লোকের বিশেষ করে শূদ্রের লেখাপড়া শেখার অধিকার ছিল না। অতএব মুসলিম বিজয়ের আগে এদেশে বাঙলায় কিছু লিখিত হয়নি। চর্যাগীতিরও এদেশে লিখিত রূপ চালু ছিল বলে মনে করবার কারণ নেই। কাজেই আমাদের বিশ্বাস মুসলমান কর্তৃক বঙ্গ বিজয়ই বঙ্গভাষার এই লেখ্য ও সাহিত্যের ভাষা হইবার] সৌভাগ্যের কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। তাই নিরঞ্জনের রুম্মাতে°৬ কেবল নিপীড়িত বৌদ্ধদের স্বস্তি ও উল্লাস ধ্বনিত হয়নি, বাঙলা ভাষারও সুদিনের আভাস সূচিত হয়েছে। মুসলিম শাসকের প্রশ্রয়ে ও প্রতিপোষণে সম্ভবত চৌদ্দ শতকের শেষ বা পনেরো শতকের গোড়া থেকেই বাঙলা রচনা লিখিত রূপ পেতে থাকে। এজন্যে এ সময় থেকেই কৃষ্ণ ধামালী, মনসার ভাসান, রামায়ণ কথা ও ভারতকথা পাঁচালিরূপে গড়ে উঠতে থাকে। কিন্তু বৌদ্ধ বিলুপ্তির ফলে বৌদ্ধ পাল গীতি লুপ্ত হয়েছে এবং ময়নামতী-গোপীচাঁদকথা যোগ-সম্বন্ধীয় হওয়ায় যোগপ্রিয় হিন্দু-মুসলমান দ্বারা রক্ষিত হয় এবং মুসলমানদের হাতে যোগীর কাহিনী বলে গোরক্ষ কাহিনী কিংবা ময়না-গোপীচাঁদ কাহিনী যথাক্রমে ষোলো ও আঠারো শতকে পাঁচালি পর্যায়ে উন্নীত হল। মৌখিক রচনায়ও ভাষা স্বাভাবিকভাবেই বিকশিত হয়েছিল। নইলে শ্রীকৃষ্ণ সন্দর্ভে (শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে) কিংবা শ্রীকৃষ্ণ বিজয়ে ভাষার এমন অর্থবহ বিকশিত রূপ পেতাম না। শ্রীকৃষ্ণ সন্দর্ভে ব্যবহৃত গোটা বারো আরবি-ফারসি শব্দ থেকে বোঝা যায় এ সময়ে দরবার আর দরবারি ভাষাও লোকপরিচিত এবং লোকপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অতএব মুসলমানেরাই লেখ্য বাঙলার সৃষ্টি সহায় ও পোষ্টা।
.
০৭.
॥ রাজকীয় প্রতিপোষণ ॥
এ-কথা না বললেও চলে যে মুসলিম সুলতান-সুবাদারের প্রতিপোষণেই প্রকৃতপক্ষে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য লেখ্যরূপ লাভ করে। যেমন ধর্মপ্রচার ও প্রশাসনিক প্রয়োজনে ব্রিটিশ আমলে বাঙলা গদ্যের চর্চা হয়।
গঠনযুগে ভাষার বুনিয়াদ দ্রুত গড়ে ওঠে এবং ভাষা পুষ্টি লাভ করে অনুবাদের মাধ্যমে। বাঙলা ভাষার ক্ষেত্রেও এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেনি। মুসলমান সুলতান-সুবাদারের আগ্রহে সংস্কৃত, ফারসি ও হিন্দি সাহিত্যের উৎকৃষ্ট গ্রন্থগুলোর বাঙলা অনুবাদ শুরু হয়। কেবল তা-ই নয়, এ ব্যাপারে বাঙালি মুসলমানও অগ্রণী ছিল। গৌড় সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহর আমলে (১৩৮৯-১৪০৯ খ্র.) তাঁর কর্মচারী শাহ মুহম্মদ সগীর কিতাব চাহিয়া ইউসুফ জোলেখা কাব্য রচনা করেন। রুকনউদ্দীন বরবক শাহর (১৪৫৯-৭৪) অভিপ্রায় অনুসারে কৃত্তিবাস অনুবাদ করেন রামায়ণ ৫° বরবক শাহ ও তাঁর পুত্র সুলতান শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহর আমলে গুণরাজ খান মালাধর বসু শ্রীকৃষ্ণ বিজয় নামে ভাগবতের অংশবিশেষের অনুবাদ করেন (১৪৭৪-৮০ খ্র.) আর জায়নুদ্দিন রচনা করেন রসুল বিজয়।
বরিশালের ফুলিয়া (ফুল্লশ্রী) গাঁয়ের বিজয় গুপ্ত (১৪৮৫ খ্রী.)৫২, জালালুদ্দীন ফতেহ শাহ ওর্ফে হোসেন শাহর আমলে (১৪৮২-৮৬ খ্রী.) পদ্মাপুরাণ অবলম্বনে মনসার ভাসান রচনা করেন। মধ্য বঙ্গে বিপ্রদাস পিপলাই (১৪৯৪ খ্রী.) মনসামঙ্গল ও কবিচন্দ্র মিশ্র গৌরীমঙ্গল রচনা করেন সৈয়দ আলাউদ্দীন হোসেন শাহর আমলে। সৈয়দ আলাউদ্দীন হোসেন শাহর চট্টগ্রামস্থ অধিকারের সেনানী শাসক (Military Governor) পরাগল খানের সভাকবি কবীন্দ্র পরমেশ্বর পরাগলী মহাভারত এবং তাঁর পুত্র ছুটি খানের সভাকবি শ্রীকর নন্দী ছুটি খানী অশ্বমেধ পর্ব রচনা। করেন। হোসেন শাহর পৌত্র ফিরোজ শাহর আদেশে সংস্কৃত কাহিনীর অনুসরণে বিদ্যাসুন্দর কাব্য রচনা করেন দ্বিজ শ্রীধর কবিরাজ (১৫১৯-৩৩ খ্রী.)৫৩। কবিশেখর বিদ্যাপতি আর যশোরাজও তাঁদের পদে নাসির শাহ (নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ) ও আলাউদ্দীন হোসেন শাহর স্তুতি করেছেন।