সহজযানপন্থী প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধেরা এই সময়ে ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়। কিন্তু তাদের বিশ্বাস-সংস্কার তখনো তারা জিইয়ে রাখে। ফলে বৈষ্ণব থেকে বৈষ্ণব-সহজিয়া, মুসলমান ও প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ থেকে বাউল মত গড়ে উঠে। চর্যাগীতি এদেরই ঐতিহ্য এবং বৈষ্ণব সহজিয়াপদ ও বাউল গান চর্যাগীতিরই আধুনিক রূপান্তর। হিন্দু সমাজের নাথ-যুগীরা (পেশায় তাঁতি) পুরোনো বৌদ্ধ নাথপন্থরই ধারক।
বৌদ্ধ আদিনাথ ও বজ্রতারাকে প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধেরা শিব-তারা নামের আবরণে পূজা করতে থাকে এবং গোরক্ষনাথ, মীন নাথ বা মৎস্যেন্দ্র নাথ প্রভৃতি বৌদ্ধ সিদ্ধা প্রবর্তিত সাধনপন্থও শৈবনাথপন্থরূপে পরিচিত হয়। ফলে এগুলো শৈবমতের শাখারূপে ব্রাহ্মণ্য সমাজে গৃহীত হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের ধর্মঠাকুর পূজারীর ধর্মঠাকুর মূলত অনার্য সূর্যদেবতা। বৌদ্ধ আমলে বৌদ্ধের ত্রিশরণের অন্যতম প্রমূর্ত ধর্মরূপে এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনরুত্থানের পর নিম্নবর্ণের দেবতা ধর্মঠাকুর নামে পূজিত হচ্ছেন। তার মাহাত্ম্য-কথাই ধর্মমঙ্গল কাব্যে বর্ণিত হয়েছে।
মনসা ও চণ্ডীমঙ্গলের সঙ্গে ধর্মমঙ্গলের পার্থক্য এই যে, ধর্মঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বা স্বীকৃত নির্বিবাদী দেবতা। কাহিনীতেও বৈচিত্র্য এবং বিস্তার আছে। এক বিস্তৃত পরিসরে রাজা আর ভিখারি, অভিজাত ও ডোম, ন্যায়নিষ্ঠা ও শাঠ্য, বাহুবল ও কূটকৌশল, বিদ্রাহ ও বিগ্রহ, গার্হস্থ্য সমস্যা ও রাজসভার দুশ্চিন্তার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এসব কারণে ধর্মমঙ্গলগুলো বিশিষ্ট রচনা। এখানে বাঙলার বিশেষ করে প্রাচীন রাঢ় অঞ্চলের সর্বস্তরের নারী-পুরুষের জীবনযাত্রার বাস্তব চিত্র বিধৃত রয়েছে। রাজসভার ছল-চাতুরী, প্রতারণা-বিশ্বাসঘাতকতা, নির্যাতন-বিদ্রোহ, সন্ধি-বিগ্রহ, বীরত্ব-মহত্ত্ব প্রভৃতির চিত্র যেমন আছে, তেমনি রয়েছে ধনী-নির্ধনের ঘরোয়া জীবনের প্রেম-ঈর্ষা, ক্ষমা-প্রতিহিংসা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, উল্লাস-যন্ত্রণা ও আশা-হতাশার আলেখ্য। কাহিনী সুসংবদ্ধ নয় বটে, কিন্তু মহামদ-কর্ণসেন-কালু-লখাই-রঞ্জাবতী- লাউসেন-ইছাই প্রভৃতি স্ব স্ব বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ সাহিত্যের লিখিতরূপ অর্বাচীন। কিন্তু এগুলোতে যেসব কাহিনী ও সমাজ-সংস্কৃতির চিত্র রয়েছে, তা প্রাচীন। এদিক দিয়ে এ সাহিত্য বাঙলা ও বাঙালি র প্রাচীন ইতিহাসের মূল্যবান উপকরণ।
রামাই পণ্ডিতের শূণ্যপুরাণ ও ধর্ম পূজাবিধান হচ্ছে এ মতের শাস্ত্রগ্রন্থ। নিরঞ্জনের রুম্মাটি কিলিমা জলাল] এই শূন্যপূরাণেই পাওয়া গেছে। ফিরোজ শাহ তুগলকের উড়িষ্যা বিজয় উপলক্ষে এটি রচিত। এ উপাখ্যানে কেউ কেউ বিস্মৃত সামাজিক ইতিহাসের ছায়া লক্ষ্য করেন। ধর্মমঙ্গলের আদি লেখক বলে ময়ূর ভট্ট নামে এক ব্যক্তির উল্লেখ দেখা যায়। যাদের পাঁচালি পাওয়া গেছে তাঁদের অনেকেই ব্রাহ্মণ। উচ্চবর্ণ থেকে ধর্মঠাকুরের স্বীকৃতি আদায়ই হচ্ছে এসব মঙ্গল রচনার পরোক্ষ উদ্দেশ্য। সতেরো শতক থেকেই ধর্মমঙ্গল রচিত হতে থাকে। খেলারাম চক্রবর্তীও ধর্ম পাঁচালরি আদি লেখক বলে পরিচিত। কিন্তু তাঁর কাব্যও পাওয়া যায়নি। সতেরো শতকের আর যে-সব কবির নাম মেলে তাঁরা হচ্ছেন শ্রীশ্যাম পণ্ডিত, যাদবনাথ, রূপরাম চক্রবর্তী, রামদাস আদক, সীতা রামদাস প্রভৃতি। এঁদের মধ্যে রূপরাম চক্রবর্তী প্রধান। আঠারো শতকে পাচ্ছি ঘনরাম চক্রবর্তী, দ্বিজ রামচন্দ্র, নরসিংহ বসু, দ্বিজ প্রভু রাম, হৃদয়রাম সাধু, শঙ্কর চক্রবর্তী, নিধিরাম গাঙ্গুলী, দ্বিজ গোবিন্দ রাম, দ্বিজ ক্ষেত্ৰনাথ, মাণিকরাম গাঙ্গুলী, রামকান্ত রায়, দ্বিজ রাজীব প্রভৃতি। এঁদের মধ্যে ঘনরাম চক্রবর্তী কবিত্বে ও জনপ্রিয়তায় শ্রেষ্ঠ।
.
০৬.
॥ লোকসাহিত্য ॥
বাঙলা লোক-সাহিত্যের আদি নিদর্শন হচ্ছে চর্যাগীতি, ডাক ও খনার বচন, ছড়া, প্রবচন, প্রবাদ, রূপকথা, ব্রতকথা, যোগীপাল-ভোগীপাল-মহীপাল গীত (অপ্রাপ্ত), ময়নামতী-মানিকচাঁদ-গোপীচাঁদ গীত, মীননাথ-গোখনাথ-হাড়িপা কাহিনী, ধর্মঠাকুরের কথা, চণ্ডী-মনসার কথা, যজ্ঞকথা, শিবের পাঁচালি, রাধাকৃষ্ণ ধামালী, রাম পাঁচালি, ভারত পাঁচালিত প্রভৃতি। এগুলো মুখে মুখে ফিরেছে বলে এগুলোর ভাষা কালে কালে পরিবর্তিত হয়েছে কিন্তু কাহিনী প্রাচীন। তেমনি তুর্কী-মুঘল আমলের নিদর্শন হচ্ছে ব্ৰত কথা, গাজীর গান, সত্যপীর, ওলা বিবি প্রভৃতি কাহিনী, মৈমনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ গীতিকা, পীর-মাহাত্ম্য কথা, বাউলগান, আদ্যের গম্ভীরা, ঝুমুর, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া প্রভৃতি এবং ব্রিটিশ যুগের ও হাল আমলের লোক-সাহিত্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাউল, ভাটিয়ালী ও কবিগান এবং সাময়িক ঘটনা অবলম্বনে রচিত নানা গান, গাথা, কবিতা ও লোকসাহিত্য নামে পরিচিত। এর মধ্যে কবিওয়ালার ও কবিগানের উদ্ভবের আলাদা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। এ হচ্ছে যুগসন্ধিকালের বিপর্যস্ত জীবনের সাক্ষ্য অথবা পূর্ব-প্রভাতিক অন্ধকারের (Predawn darkness-এর) প্রতিরূপ।
স্থানীয় কবি, গায়েন ও কথক কর্তৃক আঞ্চলিক বুলিতে স্থানীয় নিরক্ষর লোকের উদ্দেশে মুখে মুখে রচিত বলে লোকসাহিত্য অঞ্চলের সীমা অতিক্রম করে সর্ববঙ্গীয় হতে পারেনি। এজন্যে লোকসাহিত্য মাত্রই আঞ্চলিক এবং কালে কালে বহু মুখের স্পর্শে ও পরিচর্যায় এগুলো ভাবে বিচিত্র, ভাষায় কালোপযোগী, ভঙ্গিতে চাহিদানুসারী এবং কল্পনায় পল্লবিত হয়েছে বলে লোকসাহিত্য ব্যক্তিনিরপেক্ষ গণরচনা-রূপে পরিচিত। অতএব ভাবে, ভাষায়, ভঙ্গিতে ও কাহিনী বিন্যাসে লোকসাহিত্য যুগে যুগে নবকলেবর পরিগ্রহ করে যুগের চাহিদা মিটিয়েছে, এবং নতুন বিষয়ে হয়েছে পুষ্ট।