.
০২.
আমরাও ব্রত গ্রহণ আর সাধনার দিক দিয়ে পিছিয়ে নেই। কিন্তু সিদ্ধি আজো যেন নাগালের বাইরে। এর যেসব কারণ আমরা অনুমান করেছি, সেগুলোই এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করব।
আজকের সাহিত্যান্দোলনের উদ্গাতা য়ুরোপ। আজকের সাহিত্য মানুষের জীবনভিত্তিক। সে জীবন বাহ্যত সামাজিক, অর্থনীতিক ও রাষ্ট্রিক হলেও তাদের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়াজ যে-মনোজীবন, তার স্বরূপ উদ্ঘাটনই শিল্পীর মূল লক্ষ্য। কাজেই সেকেলে-ধারায় একেলে সাহিত্য সৃষ্ট হতে পারে না।
সাহিত্যের আধুনিক রূপকল্প হচ্ছে য়ুরোপের সাংস্কৃতিক অগ্রগতির ফল। তাই তাদের কাছে যা স্বতঃস্ফূর্ত, আমাদের কাছে তা অনুকৃতি মাত্র। আর অনুকৃতি মাত্রেই কৃত্রিম। বৈজ্ঞানিক আবিস্ক্রিয়ার শক্তি যেমন আমাদের জন্মায়নি, অথচ আমরা পূর্ণ যান্ত্রিক সেবা ও সুবিধে গ্রহণ করছি; ওদের তৈরি যন্ত্রের অনুকরণে আমরাও অনুরূপ যন্ত্র তৈরি করে নিচ্ছি, কিন্তু নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে পারছিনে। সাহিত্য শিল্পে আর আদর্শেও তেমনি আমাদের অনুরূপ অক্ষমতা ও অনুকৃতি প্রকাশ পেয়েছে। প্রতীচ্য সংস্কৃতি বরণে ও ধারণে আমরা ভুঁইফোড় বলেই আমাদের স্বীকরণ ক্ষমতা জন্মায়নি। এসব গুণ আহরণ করা চলে না, অন্তর্নিহিত শক্তিবলে অর্জন করতে হয়, পেলব্ধ হওয়া চাই। ফলে অশিক্ষিত লোক স্যুট পরলে যেমন তা তার দেহে খাপ খায় না, আমাদের মনের সঙ্গে য়ুরোপীয় ভাবধারাও তেমনি মিশে যেতে পারছে না। তাই আমাদের আত্মবোধ যত প্রবল, গণবোধ তত সাবলীল নয়। এজন্যেই শিক্ষা-প্রবুদ্ধ ও সংস্কৃতিপরায়ণ য়ুরোপে যা সহজেই সম্ভব হয়েছে, নতুন শিক্ষিত আমাদের কাছে তা-ই উঠেছে সমস্যা হয়ে।
আমরা কী লিখব আর কেমন করে লিখব তার সৃষ্টি-সম্ভব ধারণা আমাদের মনে গড়ে ওঠেনি। অথচ সাহিত্য-শিল্প হচ্ছে কী ভাবছি তা নয়, ভাব কীভাবে প্রকাশ করছি তা-ই। কাজেই আমাদের কথা-শিল্পে, রূপকল্প ও রসকল্পএই উভয় দিক দিয়েই সমস্যা রয়ে গেছে।
মহৎ সৃষ্টির জন্যে জগৎ ও জীবনকে একান্তভাবে অনুভব করতে হয়। তার জন্যে দরকার দৃষ্টি ও সংবেদনশীল মন। সৃষ্টির আগে দৃষ্টি নিখুঁত ও সামগ্রিক হওয়া চাই। এজন্যে আমাদের দুটো প্রাথমিক সাধ্যবস্তু রয়েছে। একটা হচ্ছে, জৈব-জীবনের বৃত্তি-প্রবৃত্তি তথা মানব-মনের গতি-প্রকৃতি সম্বন্ধে সচেতনতা এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে মানব- চরিত্রে ও আচরণে প্রতিবেশিক প্রভাব সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা অর্জন। শিল্পীরা হচ্ছেন স্রষ্টা। আর ভাব-ভাষার জাদুস্পর্শে সজীব, সচল ও ক্রিয়াশীল মানুষ সৃষ্টি করা কী সহজ কথা! কোনো বস্তু বা ব্যক্তির সামগ্রিক স্বরূপ দৃষ্টিতে বা মনে ধরা না দিলে তার চলচ্চিত্র দেওয়া অসম্ভব। যেমন ঢাকা শহরের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করলে আমি জবাব খুঁজে পাইনে, কেননা এর সামগ্রিক রূপ আমার কাছে পষ্ট নয়। না জানার চেয়ে কম জানাতেই ভুল হয় বেশি।
মানব-প্রবৃত্তি সম্বন্ধে যথার্থ জ্ঞান না থাকলে সৃষ্ট চরিত্র অস্পষ্ট ও অস্বাভাবিক হতে বাধ্য। আর সামাজিক ও ধর্মীয় বিশ্বাস-সংস্কার, অদৃষ্টবাদ, নিয়তিনির্ভরতা, আর্থিক ও রাষ্ট্রিক ব্যবস্থা এবং শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রভাব যে মানুষের আচরণকে বিচিত্রভাবে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে, তা না জানলে, সজীব ও স্বাভাবিক মানুষ সৃষ্টি হবে কী করে?
এক কথায়, মানুষের প্রতিমুহূর্তের বাহ্যাচরণ ও জীবন-প্রচেষ্টার মধ্যে মনুষ্যজীবনের বৃত্তি প্রবৃত্তির যে অদৃশ্য প্রভাব রয়েছে, তার যথার্থ স্বরূপ না জানলে বা কারণ-ক্রিয়া জ্ঞান না জন্মালে কোনো রচনাই শিল্পায়ত্ত হবে না।
আমাদের মনে হয়, এ দুটো অভিজ্ঞতার অভাবেই মুখ্যত আমাদের ছোট গল্প সার্থক হচ্ছে না, আর লেখকেরা উপন্যাস রচনায় সাহস পাচ্ছেন না। যারা সাহস করে এগিয়ে আসছেন, তারাও প্রায়ই ব্যর্থ হচ্ছেন। এ কারণেই বহু প্রশংসিত সূর্য দীঘল বাড়িতে দৃষ্টি আছে, সৃষ্টি নেই। অর্থাৎ দৃষ্টির পরিচয় আছে, কিন্তু সৃষ্টির স্বাক্ষর তেমন নেই।
এদিকে আমাদের যা ছিল তা-ও হারাতে বসেছি। পারিবারিক ও সামাজিক যে নিবিড় আত্মীয়তাবোধ ছিল, শিক্ষা-প্রবুদ্ধ জনগণ তাও হেলায় ত্যাগ করেছে। আমরা যতই বৃহত্তর মানবতাবোধ তথা মনুষ্যপ্রীতির দোহাই কাড়ছি, আমাদের আত্মীয়তাবোধ যেন ততই ম্লান হয়ে আসছে। অপ্রেম ও অসামাজিকতা যেন বেড়ে চলেছে। এর জন্যে দায়ী আমাদের নতুন-গড়া মধ্যবিত্ত মনোভাব। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি প্রয়োজনে আমাদের শিক্ষিত সাধারণের হাতে যোগ্যতাতিরিক্ত টাকা আসে, তাঁরা এখন উচ্চবিত্তের লোক। তাদের জীবনের ব্রত ধন-আহরণ আর লক্ষ্য একখানা গাড়ি ও ধানমণ্ডিতে একখানা বাড়ি। এসব ভুঁইফোড় ধনী আভিজাত্য-লোভে ও ঐশ্বর্যগর্বে নিজেদেরকে বিরাট গণসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিচ্ছেন। অথচ এঁরাই হচ্ছেন সমাজ-সংস্কৃতির শক্তির উৎস। এর সঙ্গে একটি মারাত্মক সরকারি নীতিও হয়েছে যুক্ত। সরকার কর্মচারীদের মাইনে বাড়িয়ে দিয়েছেন, এতে চাকুরিজীরিদের অভাব অনেক পরিমাণে লাঘব হয়েছে। যদিও তারা সংখ্যায় নগণ্য, তবু প্রভাব-প্রতিপত্তিতে তারাই হচ্ছেন সমাজের দিশারী। পাঁচ কোটি লোকের দেশে কয়েক লক্ষ লোকের আর্থিক দৈন্য ঘুচলেই দেশ কিছু উন্নত হয় না। পক্ষান্তরে শিক্ষিত লোকদের এভাবে গণসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে সরকার ভেদনীতির প্রয়োগে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করছেন মাত্র। এতে নেতৃত্বাভাবে অজ্ঞ অসহায় পাঁচ কোটি লোকের। অভাব-নিপীড়ন বাড়লই। যদি নতুন-গড়া শিক্ষিত শ্রেণীরও যথার্থ চিত্তবিক্ষোভ ও হতবাচ্ছা থাকত, তবে তাদের প্রভাবে দেশের গণমন সহজে জাগত। আত্মরক্ষার গরজেই সমবেত প্রয়াস চলত দেশের উন্নতির জন্যে।