কৃষির দেবতা চাষী শিবের লৌকিক কাহিনীতেই দরিদ্র বাঙালি র গার্হস্থ্য জীবনের অকৃত্রিম আলেখ্য বিধৃত। মেনকা কন্যাবিদায়কালে জামাতা শিবকে মিনতি করে বলছেন : কুলীনের পো-কে অন্য কী বলিব আমি, (আমার মেয়েকে) আঁঠু ঢাকি বস্ত্র দিও পেট ভরি ভাত-কন্যার ভাগ্য সম্বন্ধে পিতামাতার চিরন্তন উৎকণ্ঠার এমন মর্মস্পর্শী আন্তরিক প্রকাশ সুদুর্লভ। এই লৌকিক শিবায়ন কাব্যের মধ্যে রামেশ্বর ভট্টাচার্যের (১৭১০ খ্রী.) কাব্য সর্বশ্রেষ্ঠ। কবিচন্দ্র রামকৃষ্ণ রায়, শঙ্কর, কবিচন্দ্র, দ্বিজ কালিদাস, দ্বিজ মণিরাম প্রভৃতিও শিবায়ন রচনা করেছেন। মধ্যযুগে দেবকাহিনী প্রায়শ মঙ্গল নামে পরিচিত ছিল। আলোচ্য প্রধান শাখাগুলো ছাড়াও বহু উপ ও অপদেবতার মঙ্গল রচিত হয়েছে, যেমন গঙ্গামঙ্গল, সূর্যমঙ্গল, সরস্বতী মঙ্গল, লক্ষ্মী মঙ্গল, ষষ্ঠী মঙ্গল, কপিলা মঙ্গল, শনি মঙ্গল, শীতলা মঙ্গল প্রভৃতি।
॥ মনসামঙ্গল ॥
মনসামঙ্গলের কাহিনী দেব-মানবের সংগ্রামের ইতিকথা। সে-সংগ্রামে মানুষ পরাজিত হয়েছে বটে, কিন্তু মানব ও মানবিকতা হয়েছে মহিমান্বিত। চাঁদ সদাগর ও বেহুলা গোটা বাঙলা সাহিত্যে অনন্য সৃষ্টি। মনসামঙ্গল কাব্য মুখ্যত পূর্ব বাঙলার দান। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র তীরের সংগ্রামী মানুষের অদম্য অধ্যবসায়ের ও মুসলমানের একেশ্বরবাদের প্রভাব রয়েছে চাঁদ-বেহুলার চরিত্র কল্পনায়। চাঁদ দেবীর কাছে মাথা নত করেনি, সে আত্মসমর্পণ করেছে এক বালিকার অসামান্য সাহস, অধ্যবসায় ও কৃসাধনার কাছে। আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন ও কৃতসঙ্কল্প মানুষের ও মনুষ্যত্বের এমনি চিত্র সাহিত্যে বিরল।
পনেরো শতকের কানা হরিদত্ত, বিজয় গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপিলাইর পরে মোলো শতকে কোনো মনসার ভাসান রচয়িতার সন্ধান পাইনে; আমাদের বিশ্বাস বৈষ্ণবপদাবলীর রস-বন্যায় কিছুকালের জন্যে অন্য তত্ত্বচিন্তা চাপা পড়েছিল। তাই আবার সতেরো শতক থেকেই মনসামঙ্গল রচয়িতার সাক্ষাৎ পাচ্ছি। এই শতকে আমরা দ্বিজ বংশীদাস রামায়ণের কবি চন্দ্রাবতী এঁরই কন্যা] নারায়ণদেব, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ, বিষ্ণুপাল, কালিদাস, রসিক মিশ্র, দ্বিজ কবিচন্দ্র, সীতারাম দাস প্রভৃতি কবিদের পাচ্ছি। এদের মধ্যে দ্বিজ বংশীদাস, নারায়ণ দেব ও ক্ষেমানন্দ শ্রেষ্ঠ।
আঠারো শতকের কবি হচ্ছেন জগজ্জীবন ঘোষাল, জীবনকৃষ্ণ মৈত্র, রামজীবন বিদ্যাভূষণ, হরিদাস, কৃষ্ণানন্দ, জানকীনাথ, জগন্নাথ, ষষ্ঠীবর সেন, গঙ্গাদাস সেন, বাণেশ্বর প্রভৃতি।
॥ পীর পাঁচালি।
সত্যপীর মাহাত্ম্য-কথা ষোলো শতক থেকেই রচিত হতে থাকে। মোলো শতকে শেখ ফয়জুল্লাহ সত্যপীর বিজয়, কঙ্ক বিদ্যাসুন্দর এবং কৃষ্ণরাম দাস রায়মঙ্গল রচনা করেন। সত্যপীরের হিন্দু চেলা দক্ষিণের রায় (রাজা) এবং মুসলমান-ভক্ত বড় খাঁ গাজী। প্রায় ষাট-সত্তর জন হিন্দু কবি ও কিছু মুসলমান কবি সতেরো থেকে উনিশ শতক অবধি সত্যপীর পাঁচালি রচনা করেছেন। সত্যপীর তত্ত্বের প্রভাবে অনেক লৌকিক দেবতা বা কাল্পনিক পীর কাহিনীও লিখিত হয়েছে, যেমন বনবিবি-বনদেবী, শীতলা, ওলা, দক্ষিণরায় বড়খগাজী, ষষ্ঠীদেবী, কালুগাজী-কালুরায় প্রভৃতি। আবার ঐতিহাসিক ব্যক্তিকেন্দ্রী পীর-পাঁচালি যথা–মোবারক, গোরাচাঁদ, ইসমাইল গাজী, খাঞ্জা খা, সফী গাজীর কাহিনী প্রভৃতিও রচিত হয়েছে এ সূত্রে। পীর পাঁচালি নিম্ন ও পশ্চিম বঙ্গের সৃষ্টি। বাউলমতের মতো পীর-নারায়ণ সত্যকে কেন্দ্র করেও নিম্ন ও পশ্চিম বাঙলার সাধারণ ও দুস্থ হিন্দু মুসলমানের এক মিলন-ময়দান তৈরি হচ্ছিল। হিন্দুর দেবতা হৈল মুসলমানের পীর। দুইকুলে সেবা লয় হইয়া জাহির। পীর-নারায়ণ সত্য এমনকি অল্লোপরিষদের মতো একসময়ে সর্বভারতীয় ও সর্বজনীন দেবতা হয়ে উঠেছিলেন। ভৈরবচন্দ্র ঘটক, ঘনরাম চক্রবর্তী, রামেশ্বর চক্রবর্তী, ফকির রাম দাস, বিকল চট্টো, কৃষ্ণকান্ত, শিবচরণ, রামশঙ্কর, গিরিধর, অযোধ্যারাম, দ্বিজ বিশ্বেশ্বর, জনার্দন, ফকির চাঁদ, ভারতচন্দ্র রায়, ফকির গরীবুল্লাহ, কঙ্ক, আরিফ, ফৈজুল্লাশাহ প্রভৃতি অনেকেই সত্যনারায়ণ পাঁচালি লিখেছেন উনিশ শতক অবধি।
॥ প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ সাহিত্য।
শঙ্করাচার্যের আবির্ভাবের ফলে ব্রাহ্মণ্য সমাজে যে রেনেসাস আসে তার ফলে নব ব্রাহ্মণ্যধর্মের দ্রুত প্রসার ঘটে। বৌদ্ধ বিলুপ্তি তার অনিবার্য ফল। বাঙলাদেশের বজ্রযান, কালচক্র্যান ও সহজ যানভুক্ত বিলুপ্তপ্রায় বৌদ্ধ সম্প্রদায় হিন্দুয়ানি আবরণ গ্রহণ করেই প্রচ্ছন্নভাবে স্বধর্মে সুস্থির থাকতে চেষ্টা করে। এই চেষ্টারই পরিণতি দেখতে পাই পশ্চিমবঙ্গের ধর্মমতবাদে, নাথ-যোগী-পন্থে, বৈষ্ণব সহজিয়াবাদে ও বাউল মতে।
বৌদ্ধ বিলুপ্ত সত্ত্বেও নাথ-সাহিত্য লুপ্ত হয়নি, কারণ যোগতাত্ত্বিক বিষয় বলে হিন্দু যোগী ও মুসলমান সূফীর কাছে তা সমাদৃত ছিল। তাই ময়নামতী-মানিকচাঁদ-গোপীচাঁদের গান, গোরক্ষবিজয়-যোগীকাঁচ প্রভৃতি হিন্দু-মুসলমান কর্তৃক রচিত হয়েছে। ফয়জুল্লাহর গোরক্ষবিজয় (১৫৭৫), সতেরো শতকের কবি ভবানীদাসের ময়নামতীর গান, আঠারো শতকের দুর্লভ মল্লিক ও শুকুর মুহম্মদের গোপীচাঁদের সন্ন্যাস এবং পুরোনো গাথা প্রভৃতি এই ধারাকে প্রবহমান রেখেছে।