ইন্দু বিন্দু বাণ ধাতা শক নিয়োজিত
দ্বিজ মাধবে কহে সারদা চরিত।
তাঁর কাব্যে অর্জুন-তুল্য বাদশাহ আকবরের স্তুতি আছে।
মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি এবং ষোলো শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের যুগ রূপকথার আমল। আলৌকিক দেব-মহিমার কাহিনী বর্ণনা করতে বসেও মুকুন্দরাম তার প্রতিবেশ ভুলতে পারেননি। তাঁর অসামান্য কৃতিত্ব এখানেই। তিনি কাব্যে এক গ্রাম্য পরিবেশে যুগদুর্লভ ঘরোয়া আবহ সৃষ্টি করেছেন।এ হয় তার কল্পনাশক্তির অভাবপ্রসূত, নয়তো তাঁর যুগোত্তর অসামান্য জীবনবোধ, লোকচরিত্র জ্ঞান ও শিল্পীসুলভ তীক্ষ্ণ রসিকদৃষ্টির সুফল। চিত্র, নকশা এবং আধুনিক উপন্যাসের আদল এতে আশ্চর্য নৈপুণ্যে সন্নিবেশিত হয়েছে। পরবর্তীকালে আমরা নাট্যকার দীনবন্ধুর মধ্যে এমনি কবি-দৃষ্টি প্রত্যক্ষ করেছি। জীবনে-রসে রসিক এই কবির কাব্যের সুষমা তাই আজো অম্লান। বৈষ্ণব প্রভাব-পুষ্ট কবিচিত্তের স্নিগ্ধ সহানুভূতির প্রলেপে চণ্ডীমঙ্গল রসশ্রীমণ্ডিত হয়েছে। অবশ্য মুকুন্দরাম দ্বিজ মাধবাচর্যের কাছে নানা বিষয়ে ঋণী। মুকুন্দরাম ষোলো শতকের শেষপাদে কাব্য রচনা করেন।
এরপর সম্ভবত বৈষ্ণবমতের ও সাহিত্যের প্রভাববশত চণ্ডীমঙ্গল কাব্য বিশেষ বিকাশ লাভ করেনি। রামানন্দ, যতি লালা, জয়নারায়ণ রায়, দ্বিজ কমললোচন, দ্বিজ জনার্দন প্রভৃতি দু-চার জনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রচনাই সতেরো শতকে এই ধারার ক্ষীণ ও ম্লান অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন করছে। হরিরাম, ভবানী শঙ্কর, অকিঞ্চন চক্রবর্তী, রামদেব প্রভৃতিও চণ্ডীর মাহাত্ম্য-কথা রচনা করেছেন।
এরপর চণ্ডী নাম ও কালকেতু-ধনপতি-উপাখ্যান বর্জিত হয়েছে। কালিকা নাম ও বিদ্যাসুন্দরের প্রণয়োপাখ্যান দিয়ে নতুন করে কালিকা মঙ্গল রচিত হতে থাকে। এতে মঙ্গলকাব্যের বৈশিষ্ট্য কিছুই নেই। কেবল কালিকার বরে সন্তান লাভ এবং কালিকার স্তুতির দ্বারা সুন্দরের জীবন রক্ষা ছাড়া এতে কালিকার মঙ্গলকাব্য-সুলভ কোনো ভূমিকা নেই। এখানে কালিকা সুপ্রতিষ্ঠিত তথা স্বীকৃত ইষ্ট দেবতা মাত্র।
অবশ্য কালিকামঙ্গলও ষোলো শতকের দ্বিতীয় পাদ থেকেই রচিত হয়েছে। এর প্রথম কবি দ্বিজ শ্রীধর কবিরাজ যুবরাজ (ও সুলতান) ফিরোজ শাহর (১৫৩২-৩৩) প্রতিপোষণ পেয়েছিলেন। আর শাবারিদ খানও এই শতকের প্রথমার্ধে কাব্য রচনা করেন। আঠারো শতক অবধি কালিকামঙ্গলের অন্যান্য কবি হচ্ছেন বলরাম চক্রবর্তী, গোবিন্দ দাস, কৃষ্ণরাম দাস, রাধাকান্ত মিশ্র, রামপ্রসাদ সেন, কবীন্দ্র চক্রবর্তী, প্রাণরাম চক্রবর্তী, নিধিরাম আচার্য প্রভৃতি। ভারতচন্দ্র রায়ের অন্নদামঙ্গলও একটি কালিকামঙ্গল। তাঁর কাব্য তিন খণ্ডে বিভক্ত–দেবী খণ্ড, বিদ্যাসুন্দর খণ্ড ও মানসিংহ-ভবানন্দ খণ্ড। শেষোক্ত কাহিনী তার মৌলিক সৃষ্টি। গোটা মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যে ভারতচন্দ্রের স্থান নানা কারণে অনন্য। তাঁর কাব্যের নামও অভিনব। আঠারো শতকে বগী হার্মাদের হামলা, য়ুরোপীয় বেনের দৌরাত্ম্য, পতনোখ মুঘল সাম্রাজ্যের বিশৃঙ্খল শাসন, অমাত্য ও সামন্ত প্রাধান্য ও তজ্জাত স্বৈরাচার প্রভৃতি যখন জন-জীবনে অভিশাপরূপে নেমে এসেছে, তাদের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা ব্যাহত করেছে, তেমনি পরিবেশে ভারতচন্দ্রের জন্ম। তিনি নিজেও প্রথম জীবনে ভাগ্যবিড়ম্বিত হয়ে নানা দুঃখ-কষ্ট পেয়েছেন। তাই তাঁর দেবী অন্নদা– অন্নপূর্ণা। আশ্রয়দাতা রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আগ্রহে তিনি কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদারের কীর্তিকথা দেবীমাহাত্মের আবরণে রচনা করেছেন। কিন্তু অখ্যাত ভবানন্দের ঘটনা-বিরল জীবন কাহিনী কাব্যরস সৃষ্টির অনুকূল নয় বলেই ইনি দেবী খণ্ড এবং বিদ্যাসুন্দর উপাখ্যান সুকৌশলে কাব্যান্তর্ভুক্ত করেন। ভারতচন্দ্র বিদগ্ধ কবি, শহুরে কবি, দরবারি কবি, রসিক কবি। তার চেয়েও বড় কথা–ভাব, ভাষা, ছন্দ ও ভঙ্গির উপর তার অসামান্য কর্তৃত্ব। জগৎ ও জীবন, সমাজ ও ধর্ম, মানুষের দোষ ও গুণ, আশা ও হতাশা তাঁর বিকারহীন রস-দৃষ্টিতে তামাশার মতো প্রতিভাত হয়েছে। উদার ও সহিষ্ণু রসিকের মতো তিনি জনজীবনের সর্বপ্রকার অসঙ্গতি থেকে কেবল বিদূষক-সুলভ রসিকতার উপাদানই খুঁজে পেয়েছেন। বলা চলে এক বেপরোয়া বাঁচালতার কাব্য এই অন্নদামঙ্গল। এ কাব্য রচিত হয় :
বেদ লয়ে ঋষি রসে ব্রহ্ম নিরূপিলা।
সেই শকে এই গীত ভারত রচিলা ॥
১৬৭৪ শকে বা ১৭৫২-৫৩ খ্রীস্টাব্দে।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় রাজসভা কবি রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল গান রাজকণ্ঠের মণিমালার মতো, যেমন তাহার উজ্জ্বলতা তেমনি তাহার কারুকার্য।
মুক্তারাম সেনের সারদামঙ্গল (১৬৬৯ শকে বা ১৭৪৭-৪৮ খ্রীস্টাব্দে), কৃষ্ণজীবন দাসের দুর্গামঙ্গল (১৭ শতকের শেষার্ধে), কবিচন্দ্র মিশ্র (১৪৯৩-১৫১৯) ও দ্বিজ শিব-চরণের গৌরীমঙ্গল প্রভৃতি চণ্ডীরই বিভিন্ন রূপ ও গুণের পরিচায়ক কাব্য।
॥ শিবায়ন ॥
এই চণ্ডীমঙ্গল ও নাথসাহিত্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শিবের স্বতন্ত্র মাহাত্ম্য-কাহিনী শিবায়ন নামে রচিত হতে থাকে। শিব অতি প্রাচীন সর্বভারতীয় অনার্য দেবতা। তাই তাকে কেন্দ্র করে নানা গোত্রীয় ধারণা অসমন্বিত ও বিচিত্ররূপে প্রকটিত হয়েছে। এ জন্যে শিব নানা বিরুদ্ধ-গুণে, বিভিন্ন আকারে ও অসংলগ্ন জটিল তত্ত্বে অদ্ভুত মূর্তি লাভ করেছেন। বাঙলা শিবায়নে তাঁর দুইরূপ দুইধারা। একটি পৌরাণিক, অপরটি লৌকিক। পৌরাণিক ধারায় শিব-চতুর্দশীর গুরুত্ব জ্ঞাপক উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে। চট্টগ্রামের রতিদেবের মৃগলুব্ধ (১৬৭৪) ও রাম রাজার মৃগলুব্ধ সংবাদ এই ধারার রচনা।