অর্থই হচ্ছে শক্তির উৎস, ধন যার আছে মান তারই। ধনী বলেই তো রাজা শক্তিমান, রাজার পরে সমাজে সদাগরই ধনী। তাই মধ্যযুগের বাঙলায় বণিক চাঁদ সদাগর-ধনপতি সদাগরেরাই ছিল সমাজের নিয়ামক। বহির্বাণিজ্যে তাদের বাধা ছিল না। তারাই ব্রাহ্মণ্য আদর্শের ধারক ও রক্ষক। তাই লৌকিক দেবতার লক্ষ্যও তারা। মানুষ মুখে যতবড় মহৎ কথাই বলুক, বুকে পোষণ করে জীবন-জীবিকায় নিরাপত্তার ভাবনা। তাই প্রাকৃত শক্তির প্রসন্নতাকামী কৃষি-নির্ভর, রোগভীরু, অজ্ঞ এবং অসহায় মানুষের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে নিয়তিরূপ দেবতার প্রভাব অনুভব করল যখন, তখন দেবতার কাছে বশ্যতা স্বীকার না করে উপায় রইল না তাদের। মধ্যযুগের বাঙলায় লৌকিক ধর্মের ইতিহাস হচ্ছে এই পার্থিব জীবনে সুখ ও নিরাপত্তাকামী মানুষের উপ ও অপদেবতা সৃষ্টির ও পূজার কাহিনী। এর ভিতরে কোনো অপার্থিব সুমহৎ আদর্শ বা লক্ষ্য নেই। আছে এই মাটিকে–এই জীবনকে ভালোবাসার স্বাক্ষর; সুখ ও শান্তি লাভের নিদারুণ প্রয়াস। মঙ্গলকাব্যগুলোতে তাই। দেবলীলার আবরণে বর্ণিত হয়েছে সমকালীন বাঙলাদেশের ও বাঙালি জীবনের অন্তরঙ্গ ইতিকথা। ফুল্লরা-খুল্লনা-বেহুলা-রঞ্জাবতী-লখাই-গৌরী, কিংবা লহনা-দুর্বলা-হীরা-মনসা-চণ্ডী অথবা শিবাদ ধনপতি-শ্ৰীমন্ত-কালকেতু-লাউসেন-কর্ণসেন-কালুডোম আর মহামদ-মুরারিশীল-ভাড়দত্ত ভালোয়ময় নামভেদে আমাদেরই প্রতিবেশী–আমাদেরই ঘরের লোক।
॥ চণ্ডীমঙ্গল ॥
চণ্ডীদেবী এক নন, অনেক। তাঁদের মধ্যে যিনি পরে তারা-গৌরী-পার্বতী-দুর্গা প্রভৃতি নামে পৌরাণিক আভিজাত্য লাভ করেন, সেই শিবপত্নী চণ্ডীই চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের উপজীব্য। চণ্ডী কাব্যের দুটো উপাখ্যান। একটি আদি, যা নিম্নবর্ণের কালকেতু-ফুল্লরা কাহিনতে রূপ পেয়েছে। আর একটি পরবর্তী-ধনপতি সদাগর নামেতেই তা তুর্কী আমলের প্রভাব স্বীকার করেছে। চণ্ডী মাহাত্ম্যের জড় পাই বৃহদ্ধর্ম পুরাণে। আসলে এক অনার্য নারীদেবতা-চণ্ডী নামই যার সাক্ষ্য বহন করছে–বৌদ্ধসমাজে বজ্রতারা রূপে পূজিতা হন, সেই বজ্রতারাই ব্রাহ্মণ্য সমাজে তারা বা চণ্ডী নামের আবরণে গৃহীত হয়েছেন।
প্রাচীন অনার্য নারীদেবতা এই চণ্ডী, ইনি শক্তিস্বরূপা, শতাধিক নামে চণ্ডী অনার্যসমাজে পূজিতা হতেন। ক্রমে আর্যসমাজে তিনি শিব বা হর-গৃহিণীরূপে শিবানী, উমা, গৌরী, তারা প্রভৃতি নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন, পৌরাণিক যুগে এর মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা অসামান্যরূপে বেড়ে যায়। দশ প্রকার শক্তির আধার-রূপে তার দশ মহাবিদ্যার দশমূর্তি পরিকল্পিত হয়েছে, যথা : কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলা। চণ্ড-চণ্ডী নামের মধ্যেই তাদেরকে প্রচণ্ড শক্তির আধার-রূপে স্বীকার করা হয়েছে। চণ্ডী মুখ্যত পশ্চিমবঙ্গীয় তথা রাঢ় অঞ্চলের দেবতা।
একসময় ব্রাহ্মণ্য দর্শনে শিব আশুতোষ-ভোলানাথ নামে যোগী-তপস্বী হিসেবে নিগুণ শক্তি স্বয়ম্ভুরূপে বিশেষ প্রতিষ্ঠা পান। আর চণ্ডী কালো বলে কালিকা, কালী বা শ্যামা নামে শক্তিদেবতারূপে পূজিতা হতে থাকেন। সম্ভবত বৌদ্ধপ্রভাবে পরে পরে তার উগ্র রৌদ্র-রূপ কমনীয় করুণাময়ী-রূপে পরিণত হয়। তখন তিনি অন্নপূর্ণা, কমলা ও দুর্গারূপে বাঙলা দেশে পূজিতা হতে থাকেন। দূর্গারূপে দশদিক রক্ষার প্রতীক দশপ্রহরণধারিণী হিসেবে তাঁর দশভূজা মূর্তি পরিকল্পিত হয়। দুর্গারূপে তিনি শ্যামা নন–গৌরী। অনার্য প্রভাবে এককালে তিন-অনার্য দেবতা–বিষ্ণু, শিব ও কালী (চণ্ডী) সর্বভারতিক দেবতারূপে পূজিত হন। ফলে ব্রাহ্মণ্যসমাজ বৈষ্ণব, শৈব ও শাক্ত সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বৈষ্ণবীয় প্রেমবাদের প্রভাবে বাৎসল্য রসাশ্রিত শাক্ত মত তথা সন্তানবৎসল জননী রূপিণী শ্যামা-ভক্তিবাদ বাঙলা দেশে আঠারো শতক থেকে প্রসার লাভ করতে থাকে। এভাবে চণ্ডীমাহাত্মজ্ঞাপক চণ্ডীমঙ্গল, কালিকা মাহাত্ম্যসূচক কালিকামঙ্গল, গৌরী পরিচায়ক সারদামঙ্গল ও গৌরীমঙ্গল দুর্গামহিমা জ্ঞাপক দুর্গামঙ্গল এবং মাতৃরূপিণী শ্যামার স্তুতির জন্যে শ্যামাসঙ্গীত রচিত হয়েছে। এতে গৌরী-দুর্গা-উমা-কালী এ চার স্বরূপে তাঁর মহিমা বর্ণিত। বৈষ্ণব পদাবলীতে যেমন মধুর রসের প্রাধান্য, এখানে তেমনি মান-অভিমানের সুরই প্রবল। এই শাক্ত পদাবলীর শ্রেষ্ঠকবি রামপ্রসাদ সেন।
চণ্ডী মুখ্যত রাঢ় অঞ্চলের দেবতা। পশুর ইষ্টদেবী চণ্ডীমঙ্গলের কালকেতু উপাখ্যানে ব্যাধের ইষ্টদেবীতে পরিণত হয়েছেন। তাঁর বাহন গোধিকা। মনসা, চণ্ডী প্রভৃতির কাহিনী পাঁচালিরূপে লিখিত হওয়ার আগে কথকতার মাধ্যমে চালু ছিল :
ধর্মকর্ম লোক সবে এই মাত্র জানে
মঙ্গল চণ্ডীর গীত করে জাগরণে,
দম্ভ করি বিষহরি পূজে কোনো জন…..
মদ্যমাংস দিয়া কেহ যক্ষপূজা করে।
যোগীপাল ভোগীপাল মহীপাল গীত
এই সব শুনিতে লোক আনন্দিত।
চণ্ডীমঙ্গলের প্রথম লিখিত পাঁচালির উল্লেখ রয়েছে মুকুন্দরামের ও মাণিক দত্তের কাব্যে। তারা এক মাণিক দত্তকে চণ্ডীগীতির আদি রচয়িতা বলে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। দ্বিতীয় এক মাণিক দত্তের পাঁচালি পাওয়া গেছে। ইনি মালদহ অঞ্চলের কবি। তাঁর কবিত্ব-সম্পদ ছিল না বটে, তবে চণ্ডী পাঁচালির প্রথম পূর্ণাঙ্গ কাঠামো তাঁর কাব্যেই পাচ্ছি। তাঁর কাব্যও রচিত হয় দেবীর স্বপ্নদেশে এবং বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এই যে, কাব্যের উপক্রমণিকায় কবি স্বয়ং দেবীর বরপুষ্ট নায়ক। ইনি সম্ভবত আঠারো শতকের লোক। দ্বিজ মাধব বা মাধবাচার্য হচ্ছেন চণ্ডী পাঁচালির তৃতীয় কবি। এর কাব্য রচনাকাল ১৫০১ শক বা ১৫৭৯-৮০ খ্রীস্টাব্দ।