তারপর তার ভ্রাতুস্পুত্র নন্দরাম দাস অবশিষ্টাংশ রচনা করেন। তাঁর উক্তি এরূপ :
ভ্রাতৃপুত্র হই আমি তিহে খুল্লতাত
প্রশংসিয়া আমারে করিল আশীর্বাদ।
আয়ুত্যাগে আমি বাপু যাই পরলোক
রচিতে না পাইল পোথা রহি গেল শোক।
রচিবে পাণ্ডব কথা পরম সাদরে।
তাহার প্রসাদে আমি পুরাণ রচিল।
কিন্তু নন্দরাম দাস অবশিষ্টাংশ পুরো রচনা করেছিলেন কিনা বলা যায় না। কেননা কাশীদাসী মহাভারতের শান্তি পর্ব ও স্বর্গারোহণ পর্বের পুথির পাঠে যথাক্রমে কৃষ্ণানন্দ বসু ও কাশীরামের পুত্র জয়ন্ত দাসের ভণিতা মেলে। কাশীদাসের কাব্যের মাধ্যমেই মহাভারত ও তার ঐতিহ্যের সঙ্গে বাঙালি র পরিচয়। সেজন্যে কৃত্তিবাসের রামায়ণের মতো কাশীরাম দাসের মহাভারতের দানও বাঙালি জীবনে অপরিমেয়। মহাভারতের অপর এক রচয়িতার নাম বিশারদ। রচনাকাল ১৬১৩ সন। সতেরো শতকে মহাভরাতের অন্যান্য রচয়িতা হচ্ছেন নিত্যানন্দ ঘোষ, কৃষ্ণানন্দ বসু, রামনারায়ণ দত্ত, অনন্ত মিশ্র, দ্বিজ হরিদাস, ঘনশ্যাম দাস, দ্বিজ প্রেমানন্দ, দ্বিজ অভিরাম, কৃষ্ণরামদাস, জ্ঞানদাস, ষষ্ঠীবর সেন, তৎপুত্র গঙ্গাদাস সেন, রাজেন্দ্র দাস, রামেশ্বরী নন্দী, রামলোচন প্রভৃতি। এঁরা সম্ভবত মহাভারতের খণ্ডাংশের অনুবাদক।
আঠারো শতকের কবি দুর্লভসিংহ, গোপীনাথ দত্ত (বা নন্দী বা পাঠক), সুবুদ্ধি রায়, অম্বষ্ঠ বল্লভ, পুরুষোত্তম দাস, ভবানী দাস, দ্বিজরাম লোচন, দ্বিজ গোবর্ধন, শ্রীকৃষ্ণ প্রসাদ ঘোষ, অকিষ্ণন দাস, বসুদেব, নিমাই, রাজীব সেন প্রভৃতির কাব্যের অংশবিশেষ পাওয়া গেছে।
মানুষের চরিত্রের, আচরণের, সমস্যার ও সম্পদের হেন দিক নেই, যা মহাভারতে চিত্রিত ও বর্ণিত হয়নি। তাই বলা হয়–যাহা নাই ভারতে, তাহা নাই জগতে। পাত্র-পাত্রী ও ঘটনা কাহিনীভারে ভারী বলেই নাম মহাভারত! গীতাও মহাভারতের একটা সর্গ।
॥ রামায়ণ ॥
কৃত্তিবাসের পরে পনেরো-ষোল শতকে রামায়ণ কেউ রচনা করেননি। বৈষ্ণব প্রভাবে তখন সবাই কৃষ্ণলীলা-রসের তরঙ্গাঘাতে দিশাহারা। কাজেই রামায়ণ রচন-শ্রবণের দিকে কারুর উৎসাহ ছিল না। সতেরো শতকে যখন বৈষ্ণবীয় নেশা কিছুটা মন্দা হল তখন আবার নতুন করে রামায়ণ গান শুরু হয়েছে। এ সময়কার উত্তরবঙ্গের খ্যাতিমান রামায়ণ-রচক হলেন নিত্যানন্দ আচার্য। ইনি সতেলের রাজা রামকৃষ্ণের সভাকবি ছিলেন, পৈত্রিকনিবাস পাবনা জেলার বড়বাড়ী বা অমৃতকুণ্ডা। ইনি সতেরো শতকের শেষার্ধের কবি। অদ্ভুত রামায়ণ অবলম্বনে রচিত বলে এই গায়েন-কবিও অদ্ভুতাচার্য নামে পরিচিত হন। আঠারো শতকের গোড়ার দিকে রামশঙ্কর দত্ত নামের এক কবিও অদ্ভুতাচার্য বলে কলমী নাম গ্রহণ করেছিলেন। দ্বিজ ভবানী নাথ, দ্বিজ লক্ষ্মণ প্রভৃতিও রামায়ণ : রচনা করেন আঠারো শতকে।
॥ ভাগবত ও কৃষ্ণ বিষয়ক রচনা ৷
মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণ বিজয় কাব্যের পরে ষোলো ও সতেরো শতকীয় অনেক কবিরই ভাগবত কৃষ্ণ বিষয়ক বাঙলা রচনা পাওয়া গেছে। বৈষ্ণবেরা তো লিখেইছেন, তাঁদের প্রভাবে পড়ে অবৈষ্ণবেরাও পৌরাণিক ও মহাভারতীয় কৃষ্ণের মহিমা কীর্তন করেছেন উচ্চকণ্ঠে।
সম্ভবত ষোলো শতকের প্রথমার্ধে রচিত হয় দ্বিজ গোবিন্দের কৃষ্ণমঙ্গল, এটি ভক্ত বৈষ্ণবের রচনা। এ শতকের দ্বিতীয় রচনা রঘু পণ্ডিতের কৃষ্ণপ্রেম তরঙ্গিণী। মাধব আচার্যের শ্রীকৃষ্ণ– মঙ্গল, কবিশেখরের গোপাল বিজয়, শ্যামদাসের গোবিন্দ মঙ্গল, কৃষ্ণদাসের শ্রীকৃষ্ণ মঙ্গলও ষোলো শতকের রচনা। এ সময়কার একটি বৈষ্ণব সিদ্ধান্ত গ্রন্থ তথা তাত্ত্বিক গ্রন্থ হচ্ছে কবিবল্লভের রসকদম্ব। সতেরো শতকে এই ধারায় আরো কয়েকখানি কাব্য রচিত হয়েছে। এগুলোতে পৌরাণিক প্রভাব ক্ষীণ হয়ে বৈষ্ণবীয় প্রভাবই প্রকট হয়েছে বেশি। সতেরো শতকের বৈষ্ণবতত্ত্বগ্রন্থ হচ্ছে ব্রজমোহনদাসের চৈতন্যতত্ত্ব প্রদীপ। এ শতকের শ্রেষ্ঠ কৃষ্ণলীলাবিষয়ক কাব্য হচ্ছে ভবানন্দের হরিবংশ। পরশুরাম, জীবন, অভিরাম দাস, হরিদাস, যশশ্চন্দ্র, বাণীকণ্ঠ, বংশীদাস প্রভৃতি শ্ৰীকৃষ্ণলীলার পূর্ণ বা খণ্ড বিবরণ-কাব্য রচনা করেছিলেন। আঠারো শতকের কৃষ্ণবিষয়ক কাব্যের মধ্যে উল্লেখ্য হচ্ছে বলরাম দাসের কৃষ্ণলীলামৃত, দ্বিজ রামনাথের শ্রীকৃষ্ণ বিজয়, শঙ্কর চক্রবর্তীর গোবিন্দ মঙ্গল, মাধবেন্দ্রের ভাগবত সার, দ্বিজ রামেশ্বরের গোবিন্দ মঙ্গল, প্রভুরামের শ্রীকৃষ্ণ মঙ্গল, গঙ্গারামের গোপাল চরিত, রামদাসের শ্রীকৃষ্ণ চরিত, শিবানন্দের শ্রীকৃষ্ণ বিজয়, যুগল কিশোরের শ্রীকৃষ্ণ বিজয় ও মনোহর সেনের শ্রীকৃষ্ণ বিজয় এবং এমনি আরো অনেকের কাব্যের সন্ধান মিলেছে। এ ধারা উনিশ শতকের প্রথমার্ধ অবধি অব্যাহত ছিল।
॥ লৌকিক দেবতার পাঁচালি।
রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবত হচ্ছে আদর্শ অনুশীলনের কৃত্রিম প্রয়াসজাত সৃষ্টি। তাই গোটা মহাভারত অনেককাল জনসমাজে সমাদৃত হয়নি। রামায়ণ বৈষ্ণব-প্রভাবের যুগে বিস্মৃতপ্রায় কাব্য, এবং যদিও ভক্তিবাদ সুফীমতের মিশ্রণে প্রেমরূপের মহিমান্বিত রূপ লাভ করে চৈতন্যমতবাদে, তবু তা জীবনকে আড়াল করে অধ্যাত্মলোক সৃষ্টির প্রয়াস বলে বাঙালি র স্বভাব-ধর্মের সঙ্গে এর অকৃত্রিম সঙ্গতি ছিল না। তাই বাঙালি চরিত্রের খাঁটি পরিচয় রয়েছে তার মানসপ্রবণতার অনুগ লৌকিক দেব-কল্পনায়। তার জীবন-জীবিকার ইষ্ট ও অরি দেবতা সৃষ্টির কল্পনায়, আদর্শে ও তত্ত্বে প্রকটিত হয়েছে তার চারিত্রিক স্বরূপ লক্ষণ, অঙ্কিত হয়েছে তার সমাজ-সংস্কৃতির নকশা। এখানে দেবতাও প্রবল-প্রতাপ মানুষ। মঙ্গলকাব্যে তাই মানুষ আর মানবিক রমই মেলে। মঙ্গল কাব্যগুলো বাঙালি হিন্দুর মন-মনন ও সংস্কৃতির প্রসূন।