বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, গোবিন্দ দাস, জ্ঞান দাস, বলরাম দাস, রামানন্দ বসু, বংশীবদন, জগদানন্দ, বৃন্দাবন দাস, লোচন দাস, বাসুদেব ঘোষ, মুরারি গুপ্ত, নরহরি দাস, নরোত্তম দাস প্রভৃতি এবং মুসলমানদের মধ্যে ফয়জুল্লাহ, সৈয়দ সুলতান, আলাউল ও সৈয়দ মর্তুজা শ্রেষ্ঠ পদকার। প্রেমানুভূতির ও প্রেমের আনুষঙ্গিক ভাবের সূক্ষ্ম ও বিচিত্র অভিব্যক্তির আধার হয়ে পদাবলী হয়েছে বিশ্বসাহিত্যে অতুল্য।
চৈতন্যদেবের বাঙলা জীবনীগ্রন্থের মধ্যে বৃন্দাবন দাসের চৈতন্য ভাগবত (১৫৪১-৪২) এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্য চরিতামৃত (১৫৬০-৮০) শ্রেষ্ঠ। চরিতামৃতের মূল্য বৈষ্ণবতত্ত্বগ্রন্থ হিসেবেই সমধিক। লোচনদাসের চৈতন্য মঙ্গলও জয়ানন্দের চৈতন্য মঙ্গল (১৫৫০-৬০) অতিরঞ্জিত বর্ণনায় দুষ্ট। চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়ের খণ্ডাংশও সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়া বৈষ্ণব মোহান্ত তথা চৈতন্য পার্ষদাদির জীবনীগ্রন্থও আছে–অদ্বৈত মঙ্গল, অদ্বৈত প্রকাশ ও সীতা চরিত্র প্রভৃতি। সতেরো শতকে রচিত হয় প্রখ্যাত প্রেম বিলাস, বীর রত্নাবলী, রসিক মঙ্গল, জগদীশ বিজয়, অনুরাগ বল্লী, অভিরাম লীলামৃত প্রভৃতি; আবার আঠারো শতকে পাচ্ছি চৈতন্য চন্দ্রোদয় কৌমুদী, উদ্ধব দাসের ব্রজমঙ্গল, ভক্তিরত্নাকর, নরোত্তম বিলাস প্রভৃতি।
॥ মহাভারত।
আগেই বলেছি বাঙালি হিন্দুর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পারিবারিক নীতিবোধের সঙ্গে সঙ্গতি রয়েছে বলে রামায়ণ বা রাম পাঁচালি তাদের অত্যন্ত প্রিয় ছিল। মহাভারত যদিও ব্রাহ্মণ্য ধর্মাদর্শের কুঞ্জী তবু তা ধর্মাদর্শের উঁচু মঞ্চ থেকে সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের ক্ষেত্রে নেমে আসেনি। কেননা মহাভারতের কুন্তী, দ্রৌপদী, ভীষ্ম, কর্ণ প্রভৃতির কাহিনী এবং অন্য নানা উপকাহিনী বাঙালি র নীতিবোধের অনুকূল নয়। তাই গোটা মহাভারত অনেককাল বাঙলায় অনূদিত হয়নি। পরেও তুলনায় কম হয়েছে। অথচ আধুনিক বাঙলা সাহিত্যের বারোআনা উপকরণই মহাভারতীয়। রাজকীয় কূটনীতি ও যুদ্ধশাস্ত্র সম্বলিত হওয়ায় মহাভারত রাজা ও রাজপুরুষদের প্রিয় ছিল। এরূপ কৌতূহলই ছিল পরাগল ও ছুটি খানের। তাই অশ্বমেধাদি পর্বই তাঁরা শুনতে চেয়েছেন। কামতা দরবারেও তাই এর আধিক্য দেখতে পাই। পরাগল পরমেশ্বরকে বলেছেন :
কুতুহল বহুল ভারত কথা শুনি
কেমতে পাণ্ডবে হারাইল রাজধানী।
বনবাসে বঞ্চিলেক দ্বাদশ বৎসর …
কেমত পৌরুষে পাইল নিজ বসুমতী
এহি সব কথা কহ সংক্ষেপ করিয়া
দিনেকে শুনিতে পারি পাঁচালি পড়িয়া!
তাই এর কাব্যের নাম পাণ্ডব বিজয়।
বাঙলা ভাষায় আদি মহাভারত অনুবাদক কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও শ্রীকর নন্দী। গৌড় সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহর উত্তর-চট্টগ্রামস্থ সেনানী শাসক পরাগল খানে (আনু. ১৫১৩-৩২) আগ্রহে পরমেশ্বর সংক্ষেপে মহাভারত কাহিনী বর্ণনা করেন এবং সম্ভবত তাঁর পুত্র নসরত খানের ওরফে ছুটিখানের প্রবর্তনায় শ্রীকর নন্দী অনুবাদ করেন অশ্বমেধ পর্ব। ডক্টর সুকুমার সেনের মতে শ্রীকর নন্দীর আদেষ্টাও পরাগল–ছুটিখান নন।
মহাভারতের তৃতীয় অনুবাদক সম্ভবত রাঢ় অঞ্চলের রামচন্দ্র খান। ইনি সম্ভবত ১৫৫২-৫৩ সনে তার কাব্য রচনা করেন। এ তিনজনের কাব্য অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। বাঙলা দেশের সর্বত্র এঁদের পুথি পাওয়া গেছে। সম্ভবত সতেরো শতকের কবি কাশীরাম দাসের মহাভারত এঁদের কাব্যযশ ম্লান করে দেয়।
কামতা-কামরূপের রাজসভায় মহাভারতের চর্চা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। অনেক কবিই বাঙলায় মহাভারত অনুবাদ করেছেন বিভিন্ন রাজা ও রাজকুমারের আগ্রহে। কামতা-কামরূপের রাজা বিশ্বসিংহের পুত্র সমরসিংহের অভিপ্রায় অনুসারে কবি পীতাম্বর উষাপরিণয় (১৫৩৩) ও নলদময়ন্তী (১৫৪৪) রচনা করেন। দুটোই যথাক্রমে বিষ্ণু পুরাণ, ভাগবত ও মহাভারত অবলম্বনে রচিত। পীড়াম্বর মার্কণ্ডেয় পুরাণ কাহিনীও (১৫০৩) বাঙলায় লিখেছিলেন। এছাড়া কামতা কামরূপের পরবর্তী রাজা শুক্লধ্বজের সভাকবি অনিরুদ্ধ মহাভারত, তাঁর পুত্র গোপীনাথ মহাভারতের দৌণপর্ব এবং অনিরুদ্ধের জ্যেষ্ঠভ্রাতা কবিচন্দ্রও নানা গ্রন্থ রচনা করেছেন। কামতা রাজ্যে মহাভারত রচয়িতা আর আর কবি হচ্ছেন বিশারদ চক্রবর্তী, রুদ্রদেব, গোবিন্দ কবিশেখর (১৬২৭-৩২), শ্রীনাথ (১৬৩২-৬৫), দ্বিজ রঘুরাম, জয়দেব, হরেন্দ্র নারায়ণ, ব্রজসুন্দর কৌশারি, দ্বিজ বলরাম, বৈদ্যনাথ, পরমানন্দ, মহীনাথ, রামবল্লভদাস, লক্ষ্মীরাম, বৈদ্য পঞ্চানন, রামনন্দন প্রভৃতি।
এদিকে মহাভারত কাহিনীর অনুসরণ পাচ্ছি সতেরো শতকে। এই শতকের কবিদের মধ্যে কাশীরামদাস সবচেয়ে জনপ্রিয়। তাঁর কাব্য আজো হিন্দু বাঙালির ঘরে ঘরে পরম আগ্রহে পড়াশুনা হয়। কাশীরামের আত্মপরিচয় থেকে জানা যায় তাঁর পিতার নাম কমলাকান্ত, পিতামহ সুধাকর ও প্রপিতামহ প্রিয়ঙ্কর। নিবাস বর্ধমান জেলার সিঙ্গি বা সিদ্ধি গ্রামে। তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা গদাধরও কবি ছিলেন। কনিষ্ঠ কৃষ্ণদাস রচনা করেন শ্রীকৃষ্ণ বিলাস এবং গদাধর লেখেন জগন্নাথ মঙ্গল। কাশীরাম বিরাট-পর্বের কতকাংশ অবধি লিখে পরলোক গমন করেন।
আদি সভা বন বিরাটের কতদূর।
ইহা রচি কাশীদাস গেল স্বর্গপুর।