মুসলিম বিজয়ের পরে উত্তরভারতেও ইসলামের সাম্যবাদ ও উদার মানবিকতা নিম্নশ্রেণীর নিপীড়িত জনমনে নতুন আশা জাগাল, এক নয়া সম্ভাবনার দিগন্ত খুলে গেল তাদের সামনে। তারা বুঝল জন্মসূত্রে নয়, যোগ্যতা দিয়েই হবে জীবন নিয়ন্ত্রিত। তখন স্বধর্মে সুস্থির থাকা তাদের পক্ষে আর সম্ভব হল না, আবার ইসলাম গ্রহণেও ছিল সমাজ-সংস্কারের বাধা। ফলে ঘরের বাঁধন হল আলগা, কিন্তু গন্তব্য ছিল না স্থির, তাই দেখা দিল পথ চলে পথের দিশা পাওয়ার প্রয়াস।
রামানন্দ, কবীর, নানক, একলব্য, দাদু, রামদাস প্রভৃতি সন্তদের ধর্মান্দোলনের ব্যবহারিক উদ্দেশ্য ছিল বর্ণভেদ লোপ, সমাজে ও শাস্ত্রে নিম্নবর্ণের অধিকার প্রতিষ্ঠা আর মনুষ্য-সত্তায় মর্যাদা দান এবং সে-সঙ্গে শাসক-শাসিতের মধ্যে প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্যে ধর্ম সমন্বয় ও ঐক্যের বাণীও প্রচারিত হল। এরূপে দক্ষিণভারতে ভক্তিবাদের ও উত্তরভারতে সন্তধর্মের উদ্ভব ঘটে ইসলামের প্রত্যক্ষ প্রভাবে।
বাঙলা দেশে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের অব্যবহিত পূর্বে ইসলামের প্রভাবে হিন্দুসমাজে যে ভাঙন ধরে তা রোধ করবার জন্য স্মার্ত রঘুনন্দন, রঘুনাথ শিরোমণি প্রভৃতি ধর্ম ও সমাজ সংস্কারে ব্রতী হন। তারা শাস্ত্রের উদার ও শিথিল ব্যাখ্যায় জনচিত্ত আকর্ষণে প্রয়াসী হলেন। সমাজে নতুন মেলবন্ধনের সাড়াও পড়ে গেল। এই প্রতিরোধমূলক আন্দোলনের প্রতি জনমনে আস্থা সৃষ্টির জন্যে গৌড়ে ব্রাহ্মণ রাজা হবে হেন আছে বলে ভবিষ্যদ্বাণীও রটিয়ে দেয়া হল, তবু এতে ভাঙন রোধ করা গেল না দেখে চৈতন্য দক্ষিণ ও উত্তর ভারতের সন্তদের অনুসরণে এখানেও ভূক্তিধর্ম প্রচারে উদ্যোগী হলেন। চৈতন্যের সাধনাতেই ভক্তি প্রেমরূপে মহিমান্বিত হল।
১৪৮৬ খ্রীস্টাব্দে চৈতন্যদেবের জন্ম হয় নবদ্বীপে এবং ১৫৩৩ খ্রীস্টাব্দে মৃত্যু ঘটে। চৈতন্যদেব অল্প বয়সেই পাণ্ডিত্য, তর্কপটুতায়, চরিত্র-মাধুর্যে ও ব্যক্তিত্বে নদীয়ার গুণী-জ্ঞানী বয়স্কদেরও শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেন। তাঁর পিতামহের বয়সী অদ্বৈতাচার্য, বয়োজ্যেষ্ঠ রামানন্দ প্রমুখ গুণীব্যক্তিদের আনুগত্যই তার প্রমাণ। যখন তিনি হরি সংকীর্তনের মাধ্যমে তাঁর নব মতবাদ প্রচারে ব্রতী হয়েছেন, তখন তাঁর বয়স বিশ-বাইশের বেশি নয়। এতেই তাঁর প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের অসামান্যতা বোঝা যায়। মুসলিম রাজশক্তি পাছে তার উদ্দেশ্য সিদ্ধির অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, এই ভয়ে তিনি হিন্দুরাজ্যান্তৰ্গত নীলাচলে গিয়ে আখড়া করলেন। পদস্থ রাজ-কর্মচারী রূপ-সনাতন প্রমুখ অনেক গুণী-জ্ঞানী তাঁর শিষ্য হয়ে দেশে দেশে নতুন প্রেমধর্ম প্রচারে ব্রতী হলেন। বাঙলা দেশে অদ্বৈতাচার্য ও রামানন্দ রয়ে গেলেন তার প্রতিনিধিরূপে। বাস্তব জীবনকে আড়াল করে চৈতন্যদেব এক অধ্যাত্ম-মনোজীবন সৃষ্টির প্রয়াসী ছিলেন। এ কারণেই সম্ভবত বাঙলায় বৈষ্ণব মতবাদ বিশেষ প্রসার লাভ করেনি।
কিন্তু বৈষ্ণবসাহিত্য একসময়ে জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের মনে রসের তরঙ্গ তুলেছিল। মুসলমান সুলতান-সুবাদারের প্রতিপোষণে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের বুনিয়াদ তৈরি হয়, আর বৈষ্ণব রচনার দ্বারা ভাষা ও সাহিত্যের দ্রুত প্রসার ও বিকাশ ঘটে। কেবল সাহিত্য সৃষ্টি ও ভাষার পুষ্টির ক্ষেত্রেই নয়, সামগ্রিকভাবে বাঙলার ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি এবং মননেও এর প্রভাব ও দান অপরিমেয়। পরবর্তীকালের পাশ্চাত্য প্রভাবের বিপুলতা ও বৈচিত্রের সঙ্গেই কেবল এর তুলনা চলতে পারে। বৈষ্ণবের প্রেমবাদের মাধ্যমে নরে নারায়ণ ও জীবে ব্রহ্ম-দর্শনের দীক্ষা পেল বাঙালি। এই প্রীতিধর্মের প্রভাবে বাঙালি র মানবতাবোধ হল তীব্র, তীক্ষ্ণ ও উদ্দীপ্ত। ষোলো শতক তাই বাঙালি র ও বাঙলা সাহিত্যের রেনেসাঁসের যুগ। বৈষ্ণব ধর্মান্দোলনের ফলে এদেশের হিন্দু মুসলমান বৈষ্ণব মতবাদ গ্রহণ করে। এ মতবাদের প্রত্যক্ষ প্রভাবে সহজিয়া ও বাউল মতবাদ পুষ্ট হয়। বৈষ্ণব-তত্ত্বের প্রত্যক্ষ প্রভাবে শাক্ত-সম্প্রদায়ে ভক্তিবাদ প্রবল হয়ে ওঠে এবং প্রধানত বাৎসল্য রসাশ্রিত শাক্ত পদাবলী রচিত হয়। মুসলমানেরাও রাধাকৃষ্ণকে আত্মা-পরমাত্মা, দেহ মন এবং ভক্ত-ভগবানের রূপক হিসেবে গ্রহণ করে পদ রচনা ও আস্বাদন করেছে। লৌকিক প্রণয়গীতিতেও নায়িকা অর্থে রাই এবং নায়ক অর্থে কালা সাধারণভাবে গৃহীত হয়েছে। ব্রজবুলি নামে একটি কৃত্রিম সাহিত্যিক ভাষার সৃষ্টিও হয় এ সময়ে। ভাগবতাদির কথা বাদ দিলে চোখে দেখা রক্ত-মাংসের মানুষের চরিতাখ্যান রচনাও শুরু হয় এ সময় থেকেই। বাঙলায় গীতিকবিতা রচনার এবং অলঙ্কার ও দর্শনশাস্ত্রের আলোচনার সূত্রপাতও করেন বৈষ্ণবেরাই। বৈষ্ণবীয় ভক্তি ও উদার মানবিকতার প্রভাবে কুর, নিষ্ঠুর, ঈর্ষা ও প্রতিহিংসাপরায়ণ লৌকিক দেবতাও বৈষ্ণবোত্তর যুগে উদার কৃপাশীল এবং ভক্তবৎসল রূপে চিত্রিত হয়েছেন।
চৈতন্যপূর্ব যুগের রাধাকৃষ্ণলীলার পদকার ছিলেন সংস্কৃতে জয়দেব এবং বাঙলায় বড়চণ্ডীদাস, মিথিলার বিদ্যাপতি, হোসেন শাহর কর্মচারী যশোরাজ খান এবং ত্রিপুরার রাজপণ্ডিত। চৈতন্যোত্তর যুগে প্রায় দশ হাজারের মতো বাঙলা ও ব্রজবুলি পদ রচিত হয়েছে, তার মধ্যে পাঁচ-ছয়শ পদই গীতিকবিতা হিসেবে উৎকর্ষ লাভ করেছে, বাকি পদগুলো পুচ্ছগ্রাহিতা দোষে দুষ্ট ও কৃত্রিম অনুশীলনে আড়ষ্ট। মিথিলার কবি বিদ্যাপতির পদও বাঙালি র মুখে মুখে বাঙলা পদে পরিণত হয়েছে। ফলে বিদ্যাপতিও এখন বাঙলার ও বাঙালি র প্রিয় কবি।