এর পরের রচনা হচ্ছে কৃত্তিবাসের রামায়ণ। আমাদের অনুমান কৃত্তিবাস রুকনউদ্দীন বরবক শাহর প্রতিপোষণ পেয়েছিলেন, যেমন পেয়েছিলেন গুণরাজখান মালাধর বসু। কৃত্তিবাসের বিকৃত আত্মবিবরণীর অংশ পাওয়া গেছে। তা দিয়ে তার পৃষ্ঠপোষক রাজা ও সময়কাল নিয়ে পণ্ডিতে পণ্ডিতে লড়াই চলছে গত ষাট বছর ধরে। কৃত্তিবাসী রামায়ণ অতি জনপ্রিয় গ্রন্থ। তাই ভাষায় প্রাচীনতার কোনো ছাপ রক্ষিত হয়নি। বাঙালি র ধর্মবোধ মহাভারত প্রভাবিত এবং বাঙালি র উপর রামায়ণের ধর্মাচরণ সংপৃক্ত প্রভাব নিতান্ত সামান্য। বাঙলাদেশে রাম-মন্দির নেই। কোথাও কোথাও প্রথা-রক্ষাগোছের রামনবমী উদযাপিত হয়। কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাঙালি হিন্দুর কাছে রামকে একান্ত আপন করে তুলেছে। বাঙালি হিন্দুর পারিবারিক জীবনে রয়েছে এর সর্বাত্মক প্রভাব। বাঙালি হিন্দুর জীবনের আদর্শ হচ্ছে রামায়ণের পাত্রপাত্রীগণ। তাছাড়া আধুনিক হিন্দুর সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং মননের উৎস হয়েছে রামায়ণ আর মহাভারত।
রামায়ণ তিনটে স্বাধীন কাহিনীর সমষ্টি। যোগসূত্র কেবল নায়ক রাম। প্রথমটিতে ঘরোয়া জীবনে ঈর্ষা-অসূয়া জাত বিপর্যয়, দ্বিতীয়টিতে গৃহবিবাদে বা ভ্রাতৃবিরোধকালে রাষ্ট্রিক জীবনে পরাশ্রিত হওয়ার পরিণাম এবং তৃতীয়টিতে দর্প ও দাপট বশে নারী সম্পর্কে নীতিভ্রষ্টতার পরিণাম স্বতোউঘাটিত। অবশ্য আর্য গৌরবগবী কবি বাল্মীকি স্বগণ-ও স্বদেশদ্রোহী সুগ্রীব-বিভীষণকে অনুগতের সম্মান দিয়েছেন যেমনটি সাম্রাজ্যবাদী-সম্প্রসারণবাদীরা এ-যুগে দিয়ে থাকে।
মালাধর বসু বরবক শাহর আগ্রহে ভাগবত, বিষ্ণুপুরাণ ও হরিবংশের অনুসরণে শ্রীকৃষ্ণবিজয় রচনা করেন। বরবক শাহ তাঁকে গুণরাজ খান উপাধি দিয়েছিলেন। কবি বলেছেন :
স্বপ্নে আদেশ দিলেন প্রভু ব্যাস।
তাঁর আজ্ঞামত গ্রন্থ করিনু রচন।
আদিযুগে হিন্দুরা বাঙলা লিখতে গিয়ে সমাজের ভয় করেছেন। তাই স্বপ্নে প্রাপ্ত দেবাদেশের দোহাই পেড়েছেন, মুসলমানেরা করেছেন পাপের ভয়, তাই পাপ-ভয় খণ্ডন করতে চেয়েছেন যুক্তি দিয়ে। আর একটি তথ্য এই :
পুরান পড়িতে নাই শূদ্রের অধিকার
পাঁচালি পড়িয়া তর এ ভব সংসার।
পাঁচালি লেখার সাহস ও পড়ার এই অধিকার তুর্কী শাসনের দান।
কবি বলেছেন –ভাগবত শুনিল আমি পণ্ডিতের মুখে।
লৌকিকে কহিয়ে সার বুঝ মহাসুখে ॥
কাব্যরচনার কাল–তেরশ পঁচানই শকে গ্রন্থ আরম্ভন।
চতুর্দশ দুই শকে হৈল সমাপন ॥
১৩৯৫-১৪০২ শক বা ১৪৭৩-১৪৮০ খ্রীস্টাব্দ। অতএব গ্রন্থ বরবক শাহর আমলে শুরু হয়ে সমাপ্ত হয় ইউসুফ শাহর আমলে। কবি ছিলেন বর্ধমানের কুলীন গ্রামবাসী কায়স্থ।
জৈনুদ্দীন নামের এক কবির রসুল বিজয় কাব্যের খণ্ডাংশ পাওয়া গেছে। এতে রসুলের সঙ্গে ইরাকরাজ জয়কুমের কাল্পনিক যুদ্ধকথা বর্ণিত হয়েছে। ভণিতায় রাজর, সুনায়ক ও রাজেশ্বর ইউসুফ খানের প্রশস্তি আছে। কেউ কেউ এই ইউসুফ খান ও সুলতান শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহকে অভিন্ন মনে করেন।
এরপরে পাচ্ছি বিজয়গুপ্তের পদ্মাপুরাণ বা মনসার ভাসান। বরিশালের ফুল্লশ্রী গায়ের কবি বিজয়গুপ্ত —
ঋতু শূন্য বেদ শশী পরিমিত শক।
সুলতান হোসেন সাহা নৃপতিতিলক ॥
–এই শ্লোকে কাব্যরচনাকাল নির্দেশ করেছেন। এতে ১৪০৬ শক বা ১৪৮৪-৮৫ সন মেলে। অতএব এই হোসেন শাহ আসলে সুলতান জালালউদ্দীন ফতেহ শাহ যার সাধারণ্যে ডাক নাম ছিল হোসেন শাহ। এঁর কোনো কোনো মুদ্রায় হোসেন শাহী কথাটি লেখা রয়েছে।
বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল কাব্য হিসেবে সুন্দর ও সুখপাঠ্য। বিদ্যাপতি কীর্তিলতায়, বিজয়গুপ্ত তাঁর মনসামঙ্গলে, জয়ানন্দ তাঁর চৈতন্যমঙ্গলে একইভাবে হিন্দুর উপর মুসলমানের অত্যাচারের বর্ণনা দিয়েছেন, এতে মনে হয়, শাসক-শাসিতের সম্পর্কসূচক একটা গাধা কথা সর্বত্র চালু হয়ে গিয়েছিল। বিদ্যাপতি মিথিলার হিন্দুরাজার আশ্রয়পুষ্ট কবি। মুসলমান অত্যাচারের কাহিনী তাঁর কাছে শোনা কথা-মাত্র। অথচ কীর্তিলতার বর্ণনা দেখে মনে হয় তার চারপাশে এমনি ঘটনা অহরহই ঘটছে এবং তিনি নিজেও সে বিভীষিকায় ত্রস্ত। বিজয়গুপ্ত হাসন হোসেন পালায় একইরূপ অত্যাচার কাহিনী বর্ণনা করেছেন; অথচ তিনিই গ্রন্থের অন্যত্র বলেছেন, রাজার পালনে প্রজা সুখ ভুঞ্জে নিত এবং ফুলিয়া গাঁয়ের হিন্দু ও মুসলমান সবাই সজ্জন এবং সুখে বাস করে। জয়ানন্দও চৈতন্যদেবের অনেক পরে জন্মগ্রহণ করেও চৈতন্য-সমকালে হিন্দুপীড়নের বাঁধাগতে বর্ণনা দিয়েছেন অথচ চৈতন্যভাবগত কিংবা চৈতন্যচরিতামৃতে তেমনটি নেই।
পনেরো শতকের অপর কবি হচ্ছেন মনসা বিজয় রচয়িতা বিপ্রদাস পিপিলাই। তিনি ছিলেন পশ্চিমবাঙলার কোনো অঞ্চলের বাদুড্যা বা নাদুড্যা গ্রামবাসী। তাঁর গ্রন্থ রচনাকাল —
সিন্ধু ইন্দু বেদ মহী শক পরিমাণ
নৃপতি হোসেন শাহা গৌড়ের প্রধান।
এতে ১৪১৭ শক ১৪৯৫ খ্রীস্টাব্দ হয়।
এই হোসেন শাহ অবশ্য সৈয়দ আলাউদ্দীন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯)।
বৈষ্ণব সাহিত্য
বাংলার ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি ও ভাষা-সাহিত্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা চৈতন্যদেবের আবির্ভাব।
মুসলমানদের সিন্ধু বিজয়ের ফলে নূতন জাতি, সমাজ ও সংস্কৃতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হিন্দুসমাজে যে মানস-আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল এবং এই বিদেশী, বিজাতি, বিধর্মী ও বিভাষীর ধর্মাদর্শ, বৈষম্য-মুক্ত সামাজিক ব্যবস্থা ও মানবিকতার মোকাবেলা করতে গিয়ে হিন্দুসমাজে যে বিপর্যয় দেখা দিল, তার সমাধান খুঁজলেন শঙ্কর তাঁর জ্ঞানবাদ বা মায়বাদ বলে পরিচিত অদ্বৈততত্ত্বে। ইসলাম অধ্যাত্ম হেঁয়ালি-মুক্ত প্রত্যক্ষ জীবনের ব্যবহার বিধি। একেশ্বরবাদ তার শিক্ষার উৎস। শঙ্করের বৈরাগ্যবাদে বাস্তব জীবনের গুরুত্ব অস্বীকৃত রইল বটে, তবে অদ্বৈতবাদের আবরণে একেশ্বরবাদে ও মানবিক যুক্তিবাদে আস্থা রেখে ইসলামের মোকাবেলায় তিনি এগিয়ে এলেন। তাঁর এ মতবাদ জীবনচর্যার সহায়ক না হলেও সেদিন একদিকে ইসলামের প্রসার রোধে এবং অপরদিকে বৌদ্ধ উচ্ছেদে ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনঃপ্রাবল্যের সহায়ক হয়েছিল। এবং তাঁর দর্শনের পরোক্ষ প্রভাবে অর্থাৎ অদ্বৈত তত্ত্বের ভিত্তিতে দাক্ষিণাত্যে ভক্তিবাদ প্রসার লাভ করতে থাকে। ভাস্করের ভেদাভেদবাদ, রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ, মধ্বের দ্বৈতবাদ, নিম্বার্কের দ্বৈতাদ্বৈতবাদ ও বল্লভের শুদ্ধাদ্বৈতবাদ এ ধারার বিকাশ ও বৈচিত্রের ফল। একেশ্বরবাদ, ভক্তিবাদ, বৈষ্ণব ধর্ম ও শৈব ধর্মের জন্ম হল দ্রাবিড় দেশে। নবীন ইসলামধর্মের সঙ্গে নব্য হিন্দুধর্মের ঘাত প্রতিঘাতের ফলেই দক্ষিণভারতে এই নূতন ধর্মের সমন্বয় ও সংস্কৃতি সমন্বয়ের ধারা প্রবর্তিত হয়েছে। …. ইসলামের এক দেবতা ও এক ধর্মের বিপুল বন্যার মুখে দাঁড়িয়ে শঙ্কর আপসহীন অদ্বৈতবাদ প্রচার করেছেন। …… ইসলাম ধর্মের প্রভাব বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে শঙ্করাচার্যের কেবলাদ্বৈত্য বাদ থেকে রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ও নিম্বার্কের দ্বৈতাদ্বৈতবাদের প্রগতির ধারা বিশেষভাবে লক্ষ্য করবার বিষয়।…. ইসলামের আত্মনিবেদন, ইসলামের প্রেম, ইসলামের সমানাধিকার ও সাম্যের বাণী, ইসলামের গণতন্ত্রের আদর্শ মুসলমান-সাধকেরা সহজ ভাষায় সোজাসুজি যখন এদেশে প্রচার করছেন; রামানুজ ও নিম্বার্ক তখন শঙ্করের শুদ্ধজ্ঞানের স্তর থেকে শ্রদ্ধা-ভক্তি-প্রীতির স্তরে নেমে এলেন।