এভাবে আধুনিক যুগ হল শুরু। বিজ্ঞানই এ যুগের উদ্বোধক। ভাবের রাজ্যেও পৌরোহিত্য তারই। এ-যুগ অধিকারবাদের যুগ। সে-অধিকার আদায়ে সংগ্রামী মানুষ আমরা। এ যুগে আকাশ ও প্রকৃতি থেকে মানুষের দৃষ্টি নেমে এল জীবনের উপর–মাটির দিকে। ভোগেচ্ছার পরিপূর্তিই আমাদের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। আমরা বস্তুতান্ত্রিক, আমরা নাস্তিক। কোনো বৃহৎ ও, মহৎ বুলি আমাদের বিভ্রান্ত করতে পারছে না। মুগ্ধ করে না স্বর্গ-সুখ। বিভীষিকা সৃষ্টি করে না দোজখের যন্ত্রণা। আমরা বলি–মানবের তরে মাটির পৃথিবী।
চিরকাল দুর্বলের প্রতিরোধ ব্যবস্থা চলে সঙ্ঘবদ্ধতায়। তাই আজ নিঃস্ব লোকেরা জোট বেঁধেছে। দোহাই কাড়ছে মানবতার। দুর্বল যখন বাহুবলে অন্যায়-নিপীড়নের প্রতিকারে অক্ষম হয়, তখন তাঁর মুখে ফোটে ন্যায়-নীতির আবেদন। সে চেষ্টা করে সমশ্রেণীর ও সমভাবে নিপীড়িত জনের সহানুভূতি ও সহায়তা লাভের। যখন নিপীড়ন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখন মরিয়া হয়ে আত্মস্বার্থে লোক জুটে যায়। শুরু হয় সংগ্রাম। আমাদেরও এ মানবতা-মন্ত্রের পশ্চাতে রয়েছে বঞ্চিত বুকের বেদনার বিক্ষোভ। আসলে এটাও আমাদের ভোগেচ্ছা ও ঈর্ষার শোভন বহিঃপ্রকাশ মাত্র। বক্তব্যটি এই জনসংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে ও যাচ্ছে, সে পরিমাণে যখন ভোগ্যসামগ্রী বাড়ছে না, তখন টানাটানি অপরিহার্য। এহেন দুর্দিনে যখন কারো কারো গাছতলাও জুটছে না তখন, তোমাদের সৌধে বাস শোভা পায় না। এ হৃদয়হীন অসামাজিক মনোভাব। তোমাদের অট্টালিকা, প্রয়োজনাতিরিক্ত প্রাপ্তি ও প্রাচুর্য দেখে আমাদের আশ্রয় ও অশনহীনতার দাহ বেড়ে যায়। অতএব, তোমরাও কিছুটা নেমে এসো, আমরাও কিছুটা উঠে আসি। তোমারও প্রাসাদের পাট চুল, আমারও কুটিরের অভাব ঘুচল। এবার তোমার আমার অভাব সমান হল। আমার মনের ঈর্ষাজাত লোভ-ক্ষোভের জ্বালা জুড়োল। তুমি আমি হলাম বন্ধু, আত্মীয় এবং অখণ্ড মানব জাতি। তবে অভাব রয়ে গেল। তা আর কী করা যাবে! এসো, দেখা যাক, নতুন যন্ত্র প্রয়োগে নতুন উপায়ে ও নতুনতর কৌশলে বুড়ি ধরণীর রস আরও কিছুটা নিঙড়ানো যায় কী না। এতে আরো প্রবল নৈতিক যুক্তি রয়েছে। আমরাই যখন আয়োজনাতিরিক্ত আমন্ত্রণ করি না, তখন স্রষ্টা খাওয়া-পরার ব্যবস্থাতিরিক্ত জন সৃষ্টি করেছেন–এ কথা ভাবব কেন? Terminus-এ প্রথম উঠেছে বলেই কী রেলগাড়ির গোটা Compartment-এ-কোনো লোকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? এ-ই হচ্ছে আজকের মানুষের মনের কথা, মুখের বুলি ও সংগ্রামের কারণ। এর সমাধান ছাড়া এড়ানোর উপায় নেই।
কাজের কথা বলতে গিয়ে এতক্ষণ ধরে রূপকথা শোনালাম, এর প্রয়োজন ছিল। পটভূমিকা ছাড়া বক্তব্য অর্থহীন হত।
সাহিত্য মনুষ্য-মনেরই সন্তান। তার যখনকার যে মনোভঙ্গি, তা-ই তখন প্রতিফলিত হয় তার সৃষ্ট সাহিত্যে। এজন্যেই সাহিত্যকে জীবনের প্রতিচ্ছবি বলা হয়। বলা হয় ব্যক্তিক ও জাতীয় জীবনের মুকুর। বাহ্য সমস্যার সঙ্গে মানুষের এ মনোবিবর্তনের সাক্ষ্য হয়ে রয়েছে মানুষের অতীত সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্প। মানুষের অজ্ঞতার ক্রমবিদূরণ, জীবনবোধের প্রসার, প্রজ্ঞা, বুদ্ধি ও বোধির ক্রমবিকাশ, হৃদয়বৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির অভিজ্ঞতালব্ধ ক্রমোন্নতি প্রভৃতি প্রতিবিম্বিত হয়েছে এসব সাহিত্যে। বিস্ময়াবিষ্ট অজ্ঞ মানুষের সাহিত্য ছিল ভূত-প্রেত-দেও-পরী-রাক্ষসের লীলা, তারপরের যুগে পেলাম রাজা বাদশাহর জীবন-বিলাস চিত্র। তারপরে পেয়েছি ন্যায়নীতি আদর্শবাদ-পুষ্ট ইহ-পারলৌকিক জীবনের মোহনীয় ও বিভীষিকাময়ী কাহিনী। মানুষের জীবন জীবকার সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে মনোভঙ্গি যেমন বদলেছে, জগৎ ও জীবন জিজ্ঞাসা-পদ্ধতি যেমন বিবর্তিত হয়েছে, সাহিত্যেরও তেমনি সমভাবে রূপান্তর ঘটেছে আদর্শে, রূপকল্পে ও রকল্পে। বিবর্তিত হয়েছে ভাষা, পালটে গেছে ভঙ্গি, পরিবর্তিত হয়েছে রস-রুচিবোধ। বিষয়বস্তুও হয়েছে বহুবিচিত্র। আজকের সাহিত্যকে তাই পুরনো নিয়ম-নীতির নিরিখে যাচাই করা চলবে না। আজকের সাহিত্যের সাধারণ নাম রস সাহিত্য নয়–গণসাহিত্য। আজকের সাহিত্য-শিল্প কুশলতা মাত্র নয়, গণমানবের আত্মিক উন্নতির জন্যেই সাহিত্য। সমাজের জন্যে নয়, রাষ্ট্রের জন্যেও নয়–একান্তভাবে ব্যক্তিসত্তায় আস্থাবান মানুষের জন্যেই হবে এ সাহিত্য। মানুষ অবিশেষের মর্যাদা ও অধিকার-বোধ জাগানো ও প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই রচিত হবে সাহিত্য। প্রতি মানুষের জীবনের মর্যাদা ও মূল্যমান যথার্থভাবে বুঝিয়ে দিয়ে মানুষকে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে গড়ে তুলবার সাধনার অবলম্বন ও বাহন হচ্ছে এ সাহিত্য। তাই আজকের সাহিত্য অবসরবিলাসীর চিত্তবিনোদনের জন্যে নয়, কেজো মানুষকে প্রেরণা ও প্রতিষ্ঠা দানের জন্যেই। হালকাভাবে বললেও স্বীকার করতে হবে যে : যার খায় তার গুণ গাইতে হয়। এককালের লেখকেরা ধনীর আশ্রয়-নির্ভর ছিলেন, তাই সাহিত্যে স্তুতি গেয়েছেন ধনীমানবের। আজ গণমানবই তাদের খোরপোশ যোগায়। কাজেই আজ সাহিত্য সৃষ্টি হবে গণমানুষের স্বার্থে ও কল্যাণে। সেকালের ধনীদের স্তুতিকার হবেন একালের গণমানবের চাটুকার।
আজদের দিনের বিশ্বসাহিত্যে সার্থক স্রষ্টাগণ মানুষকে নিবিড়ভাবে জানবার ও জানাবার এই মহান ব্রতই গ্রহণ করেছেন। আজকের দিনে লেখকের সাহিত্য কথা-শিল্প নয়–জীবন-শিল্প। একনিষ্ঠভাবে সাধনা চলেছে জীবনের অর্থ খুঁজবারও। মার্ক টোয়েন, সমর্সেট মম, পার্লক, হেমিংওয়ে, জোলা, রোলা, আনাতোলা ফ্রাঁ, টুর্গেনিত, গোর্কী, ডস্টয়ভী, টলস্টয়, শেখভ, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি আমাদের এ পথেরই সন্ধান দিয়েছেন। কল্লোল কালিকলমের যুগ থেকে পশ্চিমবঙ্গেও এ সাধনাই লঘু-গুরুভাবে চলে আসছে।