দ্বিতীয়স্তরে মানুষের জীবনবোধ প্রসারিত হল। উচ্চবিত্তের লোকমনে আত্ম-প্রসারের প্রেরণা জাগল। কিন্তু কল্পলোকের পূর্বতন অধিবাসীরাও ঠাই ছাড়ল না। তারাও রইল। উচ্চবিত্তের মধ্যে এ আত্মপ্রসার প্রবৃত্তি দেখা দিল জরু ও জমির অধিকার লিপ্সারূপে। তারা রাজ্য ও রাজকন্যার সন্ধানে ছুটল দিকে দিকে। সৃষ্ট হল রোমান্স। এবারকার অভিযানে নায়ক রাজকুমার, মন্ত্রীপুত্র, কোটাল আর বিত্তশালী সওদাগর। সেদিনও বেনে-বুদ্ধি রাজশক্তির সঙ্গে জোট মিলিয়ে পাল্লা দিয়ে চলত!
কিন্তু গণমানব-মনে এতবড় দুরাকাঙ্ক্ষা তখনও জাগেনি। একে তারা তাদের পক্ষে অশোভন ঔদ্ধত্য বলে মেনে নিল। তাই তারা পড়ে রইল একান্তে। কিন্তু ব্যবহৃত হল উচ্চবিত্তের জীবন লীলার হাতিয়াররূপে। এভাবে শুরু হল স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের পটভূমিকায় অজ্ঞ মানুষের কল্পবিহারী মনোজীবনের লীলা। কথা সৃষ্টি হল–রূপকথা ও উপকথা। এ কথার তথা সাহিত্যের নায়ক হচ্ছে উচ্চাভিলাষী উচ্চবিত্তের মানুষ।
সভ্যতার তৃতীয়স্তরে যদিও মানুষের জীবন-জিজ্ঞাসা বাড়ল–মানুষ অধিকতর জীবনমুখী হল, তথাপি তা গণজীবনেতর রইল। কল্পবিহারী মন মর্ত-প্রবাস শুরু করল বটে, তবে কল্পলোকের প্রতিবেশীকে ত্যাগ করল না। এতটুকু যে করল, তাও গরজে পড়ে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেল। নিম্নবিত্তের ও কতক লোকের উচ্চাভিলাষ জাগল, জীবনে ভোগেচ্ছা বাড়ল, জীবিকা-প্রয়াস হল তীব্রতর। এরূপে জীবনবোধের প্রসার হল। সৃষ্টি হল রোমান্স।
এ স্তরে বাস্তব ও স্বপ্ন, কল্পনা ও প্রজ্ঞা, বুদ্ধি ও বোধি, জগৎ ও জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ল। সৃষ্টি হল অভিজাতদের গরজে ও স্বার্থে জাতীয় মহাকাব্য।
একেই আমরা বলছি আদি মধ্যযুগ। মানব-সভ্যতার ইতিহাসে এ স্তর দীর্ঘস্থায়ী হয়েছ। এ যুগের মুখ্য নীতি হচ্ছে জোর যার মূলক তার। অর্থাৎ যোগ্যতরের উধ্বর্তন। এ যুগের ক্রম পরিণতিতে মানুষের হৃদয়বৃত্তির বিকাশ হয়েছে। বহু মহত্ত্বলি, নানা আপ্তবাক্য আমরা শুনলাম। বিচিত্রগামী বুদ্ধিবৃত্তির আভা পরিব্যাপ্ত হল সর্বত্র। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে জীবন ও জীবিকা সম্মুখীন হল কঠিনতর সমস্যার। জনসংখ্যা পেল বৃদ্ধি। স্থায়ী বসবাস হল। জীবন-বোধ প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ল জীবনের চাহিদাও। অথচ প্রয়োজনের ওজনমতো ভোগ্যবস্তু বাড়েনি, ফলত দেখা দিল দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। লেগে গেল কাড়াকাড়ি, মারামারি ও হানাহানি। মানুষের এ আত্মধ্বংসী সংগ্রামে, এ দুর্যোগকালে এগিয়ে এলেন অভিজাত প্রজ্ঞাসম্পন্ন বুদ্ধিমানগণ। প্রচারিত হল ধর্মের নামে নীতিশাস্ত্র। এরূপে শুরু হল নিয়তি, অদৃষ্টবাদ, ইহ-পরকাল, স্বর্গ-মর্ত্য, জন্মান্তর, পাপ-পুণ্য, রিজিকের মালিক রাজ্জাক, সুখ-দুঃখ, প্রেম-প্রীতি, ন্যায়-নীতি প্রভৃতি হাজারো কথার মারপ্যাঁচে মানুষকে দ্বন্দ্বে নিরস্ত করবার অশেষবিধ প্রয়াস। এভাবে মানুষকে ত্রিবিধ নিয়মনীতির নিগড়ে বেঁধে রাখবার চেষ্টা চলল। ধর্মের বিধি, সমাজের নীতি ও রাজার শাসন-ই সেই নিগড়। চিরকালই দেখা গেছে Law maker-রা সাধারণত Law abider হয় না, কাজেই এসব তৈরি হয়েছে দুর্বলকে দ্বন্দ্বে সংগ্রামে নিরস্ত রাখবার জন্যেই। তাদের সে উদ্দেশ্য বহুল পরিমাণে সফল হয়েছিল, তবু যুগ ও জন-প্রয়োজনে পাল্টাতে হল নিয়ম ও আদর্শের ধরন ও ধারণ। এরূপে কত ধর্মের জন্ম মৃত্যু হল
.
তারপর এল শেষ মধ্যযুগ। মানুষ আরো বাড়ল। জীবনবোধ তীক্ষ্ণতর হল। বৃদ্ধি পেল ভোগলিপ্সা। ফলে জীবনোপভোগের পরিধি হল প্রসারিত। ভোগ্যসামগ্রীর চাহিদাও বাড়ল। অধিকাংশ লোকের মনে জাগল উচ্চাভিলাষ। জীবন-ধারণ পদ্ধতি ও জীবিকা-উপায় উদ্ভাবনে। অতৃপ্ত মানুষ ব্যাকুল হয়ে উঠল। দেখা দিল ভাববিপ্লব, আদর্শ বিভ্রাট, জীবনজিজ্ঞাসা, বুদ্ধিবৃত্তির বিচিত্রলীলা। বিজ্ঞান-দর্শনের কচকচি আর ঠোকাঠুকি। আস্তিক্য, নাস্তিক্য, ভাব, যুক্তি ও বিবর্তনবাদের সুরাসুরিক দ্বন্দ্বে নতুন ভাব-চিন্তা ও যুক্তির আবির্ভাব ঘটল। এ দ্বন্দ্বের ঝুঁকি নিল য়ুরোপ। যুগার্জিত বিশ্বাস-সংস্কার এবং জগৎ ও জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি হল পরিবর্তিত। সমাজের অভ্যস্ত জীবন বিপর্যস্ত হল ভিতরে বাইরে। এ কারো কাছে অমৃত, কারো কাছে গরল।
বৈজ্ঞানিক আবিক্রিয়া বিশাল দুনিয়াকে করে দিল সংহত ও ঘোট, এ ভাব বিপ্লব ও তদানুষঙ্গিক যন্ত্রদানব অল্পকালের মধ্যে পৃথিবীকে পুরে ফেলল আপন মুঠির মধ্যে। এ ভালোই হল। কেননা, কোনো নতুন মানুষের অমঙ্গলের জন্যে আসে না, অন্তত এ পর্যন্ত তার পষ্ট প্রমাণ মেলেনি। নতুনকে বরণ ও ধারণ করেই মানুষ ও মনুষ্য-সভ্যতা এগিয়ে এসেছে।
নতুন যান্ত্রিক পরিবেশে জীবিকার্জন পদ্ধতিতে বিপর্যয় ঘটল। ধনবণ্টন সমস্যার অর্থনৈতিক আবর্তে জীর্ণ হয়ে পড়ল পুরোনো সমাজকাঠামো। বিত্তশালীদের জীবনে জীবনোল্লাস যেমন বাড়ল, তেমনি বিত্তহীনদের চিত্তে জাগল চরম বিক্ষোভ-সে বিক্ষোভ হতবাঞ্ছর। এর ফলে চিরকালের একটা মানসিক ব্যবধান ঘুচল। আগে আর্থিক সমতার কথা, জন্মসূত্রে নয় কর্মসূত্রে জীবন নিয়ন্ত্রণ ও উপভোগের বিষয়, পরলোকে বিশ্বাসী নিয়তিনির্ভর অজ্ঞ মানুষ ভাবতে সাহস পায়নি। এবার তাদের চোখ খুলে গেল, মনের সংকোচ গেল টুটে। উঠল জগতে ও জীবন জন্মসূত্রে সমাধিকারবাদ ও সুযোগবাদের ধ্বনি। ফলে মানুষ অবিশেষের মনে জাগল অপরিমেয় ভোগেচ্ছা এবং তজ্জাত লোভ ও ঈর্ষা। আর তা থেকে শুরু হল দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। বিঘোষিত হল গণতন্ত্রের জয়।