সৈয়দ সুলতানের নবীবংশ একটি বিরাট কাব্য। হযরত আদম থেকে হযরত মুহম্মদ (দ.) অবধি সব জ্ঞাত নবীর কাহিনীই রয়েছে এতে। হযরত আয়ুব-রহিমা, ইব্রাহিম ও আল্লার অভিজ্ঞান, ইব্রাহিম-সারা-হাজেরা, মুসা-কারুন, নূহ-কেনান, সোলায়মান-জাদু আঙটি প্রভৃতি চমৎকার অবলম্বন হতে পারে আধুনিক জীবন-জিজ্ঞাসার তত্ত্ব-ভাবনার। হযরত আদমের পারিবারিক দ্বন্দ্ব সংঘাতের কাহিনীও আধুনিক পরিবারের দ্বান্দ্বিক জীবনের প্রতীক হতে পারে। এ যুগের রোমান্টিক কবি-কল্পনার সবচেয়ে সুন্দর অবলম্বন হতে পারে আদমের জীবন-স্বপ্ন। বেহেস্তে সদ্য-তৈরি আদম একাকিত্বের অস্পষ্ট বেদনার উন্মন। নতুন-দেখা প্রকৃতি যেন বাড়িয়ে দিচ্ছে সে বেদনা। ক্লান্তমনে ঘুমিয়ে পড়েছেন আদম, ঘুমের ঘোরে অনুভব করছেন তিনিঃ তার বাম পাশের রগ থেকে কী যেন গড়ে উঠছে, কী যেন জেগে উঠল, দাঁড়িয়ে গেল। তাকে যেন ইশারায় ঐ নতুন সত্তা ডাকছে। তিনি চোখ খুললেন, দেখলেন এক অপরূপ রূপসী তার অপেক্ষায় পাশে দাঁড়িয়ে। তাঁর স্বপ্নের, তার অবচেতন কামনার ধন পেয়ে ধন্য হলেন তিনি। এই-যে আদি মানবের প্রথম জীবনস্বপ্ন, একে প্রেম বলুন, মৈথুন তত্ত্ব বলুন–একেই কেন্দ্র করে বিকশিত হচ্ছে জীবন। জীবনবৃক্ষে ফুল ফোঁটানো, ফল ধরানো আর রঙ চড়ানো–সবকিছুর মূলে রয়েছে এ স্বপ্নের দান। আমাদের পসন্দ-সই আবহ সৃষ্টি করতে পারেননি মধ্যযুগের কবি। কিন্তু বীজ বুনে গেছেন, তা আজকের শক্তিমান কবির হাতে প্রকটিত হতে পারে অসামান্য রসে-রূপে। কাসাসুল আম্বিয়া প্রভৃতির নানা কাহিনী অবলম্বন করেও অভিব্যক্তি পেতে পারে আমাদের আজকের জীবনতত্ত্ব।
ইউসুফ-জোলেখা আমাদের প্রণয়–জিজ্ঞাসার চিরন্তন প্রতীক-প্রণয়ের আবেগ-উচ্ছ্বাস ও আদর্শের আকর। আমাদের শাহ মুহম্মদ সগীরের কিংবা আবদুল হাকিমের ইউসুফ-জোলেখা কাব্যে ইউসুফের অলোকসামান্য সংযম ও চরিত্র-মাহাত্ম্য, জোলেখার প্রণয়াবেগ ও কৃচ্ছ্বসাধনা যে মহিমান্বিত রূপ পেয়েছে এমনটি আধুনিক বিশ্বের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসেও দুর্লভ। একদিকে Passions ও emotions-এর দুর্বার বেগ, অপরদিকে সংযম, সততা ও আদর্শানুগত্যের প্রমূর্ত রূপ যে কোনো কালের উৎকৃষ্ট সাহিত্যের অবলম্বন হবার স্পর্ধা রাখে।
মালিকার সওয়াল মুসার সওয়াল বলে আমাদের সাহিত্যে যে একপ্রকার তত্ত্বগ্রন্থ আছে, তাকেও এ-যুগের জীবন-দর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে দেয়া যায় চমৎকার আধুনিক রূপ, যোগ্য হাতে পড়লে রূপে-রসে মসনবীর মতো হতে পারে এগুলো।
হামজা-হানিফা-রুস্তম-সোহ্রাব প্রভৃতি যে শুধু আমাদের আধুনিক কিশোর-সাহিত্যে নায়ক হতে পারেন তা নয়, তাদের দিগ্বিজয় কাহিনীর মধ্যে এমন উপাদান রয়েছে, যা রোমান্টিক কাহিনীর কিংবা উৎকৃষ্ট গীতিকবিতার হতে পারে বিষয়বস্তু!
এমনি আরো কত বিষয় রয়েছে ছড়িয়ে। আমরা অনধিকারী, তা আমাদের চোখে পড়বার কথা নয়। কোথায় কোনো সৃষ্টির বীজ লুকিয়ে আছে, কোথায় কোনো সাহিত্য-রত্নের টুকরো রয়েছে পড়ে তা সহজে নজরে পড়তে পারে সৃষ্টিশীল লিখিয়েদেরই। আমাদের অনুভূতিহীন স্থূলদৃষ্টিতে যা তুচ্ছ, তা-ই যোগ্য লোকের মহৎ সৃষ্টির উপাদান হতে পারে হয়তো। আমাদের কেবল বলবার কথা এই যে ঐতিহ্যানুগত্য ছাড়া জাতি যেমন অবাধে বড় হয় না, তেমনি সাহিত্য ঐতিহ্য অবহেলা করলে সহজে তৈরি হতে পারে না মহৎ সৃষ্টির ক্ষেত্র। উৎকৃষ্ট সাহিত্যের অনুবাদ যেমন তৈরি করে দেয় নতুন ভাষা ও সাহিত্যের বুনিয়াদ, তেমনি সাহিত্যের বিকাশ ও মননের প্রসার দ্রুততর হয় পুরোনো সাহিত্যের নব রূপায়ণে। টি. এস. এলিয়ট পুরোনো উপমাদি পর্যন্ত নতুন ব্যঞ্জনায় প্রয়োগ করে অর্জন করেছেন অসামান্য সাফল্য এবং এ বিষয়ে নয়া ব্রতীদের দিয়েছেন দিশা।
সাহিত্যক্ষেত্রে আগেও নিঃস্ব ছিলাম না আমরা। গর্ব ও গৌরব করবার মতো সাহিত্যিক ঐতিহ্য আমাদের ছিল বরাবরই। কিন্তু প্রয়োজনমতো কাজে লাগাইনি তা। তাই আধুনিক সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমাদের দীনতা যতটুকু ঘুচতে পারত তা-ও ঘোচেনি। আমাদের অক্ষমতা নয়, উদাসীনতাই এর জন্যে অনেকখানি দায়ী। আশার কথা, আমাদের অনেক লিখিয়েই সচেতন হয়েছে এ ব্যাপারে এবং পুথির উপাদান নিয়ে লিখতে হয়েছেন উদ্যোগী। তবে মনে রাখতে হবে, আমরা পুরাতনের উদ্বর্তন চাইনে, পুরাতন সামগ্রী নিয়ে নয়া ইমারত তৈরি করে নতুনের আবাহন ও প্রতিষ্ঠাই কামনা করি তাতে। কিন্তু জীবন যে মুখ্যত মৃত্তিকা-আশ্রয়ী তা ভুললে চলবে না। স্বদেশের আবহাওয়ায় গড়ে ওঠে জীবন। প্রাণ-রস পায় মানুষ দেশের ঐতিহ্য থেকেই। কেননা, এ ঐতিহ্য হচ্ছে তারই পূর্বপুরুষের অর্জিত বা সৃষ্ট কিংবা কৃতির ফসল। ধর্মীয় জীবন হচ্ছে বাইরের থেকে পাওয়া আদর্শের কৃত্রিম রূপায়ণ। তাই দেশী ঐতিহ্যকে অবহেলা করে কেবল ধর্মীয় কিংবা ধর্মীয় ঐক্যসূত্রে পাওয়া বিদেশী ঐতিহ্যের প্রয়োগে সাহিত্য সৃষ্টি করলে তা হবে তাসের ঘরের মতো অকেজো ও অসার্থক। তা কখনো হবে না প্রেরণার কিংবা অনুভবের উৎস।
কথাসাহিত্যে সমস্যা ও এর বিষয়বস্তু
০১.
সভ্যতার আদিম স্তরে এমন একদিন ছিল যখন স্কুল ক্ষুন্নিবৃত্তি ও যৌনবোধ ছাড়া মানুষের আর কিছুই ছিল না। জনসংখ্যা কম ছিল, বিস্তৃত ভুবন পড়েছিল তাদের পায়ের তলায়। কাজেই জীবন জীবিকার সমস্যা ছিল না মোটেই। তাই সেকালের অজ্ঞ মানুষ চারদিককার নিসর্গ ও প্রকৃতির প্রতি সবিস্ময়ে তাকাবার অবসর পেয়েছে প্রচুর। যেখানে অজ্ঞতা, সেখানেই বিস্ময় ও কল্পনার প্রশ্রয়। সেদিনকার বিস্ময়-ব্যাকুল মানুষ তাই মনোময় রূপকথা সৃষ্টি করে জগৎ ও জীবনের কল্প-নির্ভর ব্যাখ্যা দিয়ে স্ব স্ব কৌতূহল নিবৃত্ত করেছে। এরূপে ভূত, প্রেত, রাক্ষস, দৈত্য, পরী, যক্ষ ও দেবতা মানুষের মনোরাজ্যে বিচরণ করতে থাকে।