হেঁয়ালির মধ্যে আমাদের মনোভঙ্গি ধরা দিয়েছে বিচিত্ররূপে। বুদ্ধির দীপ্তি, সৌন্দর্যবোধ, রসচেতনা ও রসিকতা, মননশীলতা, প্রতীকপ্রিয়তা, তত্ত্বপ্রবণতা প্রভৃতিই হেঁয়ালি বা ধাঁধার মৌলিক লক্ষণ। এ ধাঁধা যে কেবল ছেলে-হাসানো বা ইয়ার-ঠকানো রচনা, তা নয়–বঙ্গ-ভারতীয় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মরমীয়া বাণী বা অধ্যাত্মতত্ত্বও এর মারফতে পরিব্যক্ত। যেমন চর্যাপদে আছে :
দুলি দুহি পিঠা ধরণ ণ জাই।
রুক্ষের তেলি কুম্ভীরে খাই।
তেমনি বাউল-মারফতি গানে রয়েছে :
সোল হত্যা বাঁশের ঘর না কুলাইল জনম ভর।
পাঁচপো হত্যা পিজরা কলে থাকবি কিরে মরণ পর ॥
অথবা–
দেহের মাঝে আছেরে সোনার মানুষ
ডাকলে কথা কয়।
অথবা–
খাঁচার মাঝে অচিন পাখি কেমনে আসে যায়
ধরতে পারলে মনোবেড়ী দিতাম পাখির পায়।
সাধারণ ধাঁধা—
তরু নয় বনে রয় নাহি ধরে ফুল
ডাল পল্লব তার অতি সে বিপুল।
পবনে করিয়া ভর করয়ে ভ্রমণ।
বনেতে থাকিয়া করে বনের পীড়ন।
প্রবাদ আর প্রবচনে ধরা পড়েছে আমাদের চিরকালীন বিশ্বাস, সংস্কার, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা, চিন্তা ও মনন-লব্ধ তথ্য ও তত্ত্ব। প্রবাদ ও প্রবচনে একটু সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। প্রবাদে মনুষ্য চরিত্রের বৈচিত্র্য, মানুষের বাহ্যাচরণের সঙ্গে মনের সংযোগের স্বরূপ; ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ সম্বন্ধীয় ভূয়োদর্শনজাত অভিজ্ঞতার অভিব্যক্তি–এক কথায় জগৎ, জীবন, লোক-চরিত্র ও সমাজমনের তথ্য ও তত্ত্ব প্রবাদে বিধৃত থাকে। আর প্রবচনে থাকে নীতি, আদর্শ, কৃষি, জ্যোতিষ, সামাজিক সংস্কার, আচার, অনুষ্ঠান ও আচরণীয় বিষয় সম্বন্ধে উপদেশমূলক হিতকথা। আর একটি স্থূল পার্থক্য আছে। প্রবাদ সংক্ষিপ্ত, প্রায়ই বাক্যে বা পদে সমাপ্ত। প্রবচন ছন্দোবদ্ধ ছড়া-জাতীয় রচনা প্রায়শ একাধিক পদে সমন্বিত।
প্রবাদ যেমন,
পিরীত আর গীত–জোরের কাজ নয়
বা, নারীর বল, চোখের জল।
বা, অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী।
এবার প্রবচন দেখুন : কানে কচু চোখে তেল।
তার বাড়ি না বৈদ্য গেল ॥
অথবা, খায় না খায় সকালে নায়,
হয় না হয় তিনবার যায়।
তার কড়ি কী বৈদ্যে খায়?
অথবা। তাল, তেঁতুল, কুল–তিনে বাস্তু নির্মূল।
এসব প্রবচনে প্রাচীন স্বাস্থ্যতত্ত্ব ও চিকিৎসা বিদ্যার কথা বিধৃত। আমাদের মন্ত্রতন্ত্র, তুকতাকের বুলিগুলোতেও রয়েছে আমাদের সংস্কারপুষ্ট মন ও অজ্ঞতাদুষ্ট মননের পরিচয়। এছাড়া প্রণয়গীতি, ভাটিয়ালি প্রভৃতি লোকগীতি; বাউল-মুর্শিদী-মারফতি প্রভৃতি অধ্যাত্মসঙ্গীত; ঝুমুর, সামা, কীর্তন প্রভৃতি নৃত্যসঙ্গীত এবং গাথা, রূপকথা, উপকথা, ইতিকথা প্রভৃতির সাহিত্যিক মূল্য আজো নেহাত কম নয়।
আধুনিক অর্থে আমরা জাতি হিসেবে আজো গড়ে ওঠার মুখে। এজন্যেই আমাদের কাছে এসব লোকশ্রুতি ও লোকসাহিত্যের মূল্য অপরিমেয়। এর থেকেই জাগবে আমাদের ঐতিহ্যবোধ। এখানেই দেখতে পাব আমরা আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্যের স্বরূপ। আমাদের জাতীয় মন-মননের গতি-প্রকৃতির ও ক্রমবিকাশের ধারার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও নিশ্চিত পরিচয় ঘটবে এসবেরই মাধ্যমে। জাতীয় সাহিত্য যদি জাতীয় জাগরণের অবলম্বন হয়, সাহিত্যকে যদি জাতির প্রাণরসের উৎস বলে মনে করি, তবে এগুলোর মূল্য অবশ্যস্বীকার্য।
ছড়ায়-প্রবাদে-প্রবচনে যেমন; তেমনি এসব গান, গাথা, রূপকথা, উপকথা ও ইতিকথায় আমাদের জগৎ-জীবন, ঘর-ঘাট, মাঠ-বাট, মন-মনন, আচার-আচরণ প্রভৃতির স্বরূপ কোথাও চিত্রে, কোথাও ইঙ্গিতে বিধৃত আছে। আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রিক ও অর্থনীতিক ইতিহাস লিখিত হবে এসব উপাদান সম্বল করেই। আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি হিন্দু বৌদ্ধ যুগের বিরাট ইতিহাস রচিত হয়েছে এভাবে। ডা. নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙালির ইতিহাস নামক বিরাট গ্রন্থটি এরূপ আপাত নগণ্য উপাদান ভিত্তিক।
অতএব আমাদের জাতীয় গরজে এসব লোকসাহিত্যের সন্ধান, সংগ্রহ, সরক্ষণ ও গবেষণাকার্য অবিলম্বে শুরু হওয়া প্রয়োজন। নতুবা আজো যা-কিছু পল্লী-মানুষের মুখে ও স্মৃতিতে টিকে আছে, তাও আমরা হারাব। সাময়িক পত্র-পত্রিকায় যৎসামান্য বিধৃত হয়েছে, কিন্তু প্রাচুর্য ও প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্ত নগণ্য। এদিক দিয়ে ডক্টর সুশীল কুমার দের প্রবাদ সংগ্রহ ও ডক্টর আশুতোষ ভট্টাচার্যের লোকসাহিত্যর বিশেষ অবদান।
জীবন-শিল্পী
০১.
আগুনের যেমন নিরবলম্ব কোনো অস্তিত্ব নেই, শিল্পও তেমনি জীবন-নিরপেক্ষ হতে পারে না। জীবন-চেতনাকে অবলম্বন করেই সৃজনশীলতার প্রকাশ-শিল্পের উদ্ভব।
জীবনকে যিনি ভালোবাসেন, জীবনের কোনো মুহূর্তই যার কাছে তুচ্ছ নয়, প্রতিক্ষণেই যিনি জীবনকে গভীর তাৎপর্য দিয়ে অনুভব করতে প্রয়াসী, জীবনের তুচ্ছতম কিংবা মহত্তম ক্ষণকে যিনি সমান গুরুত্বে গ্রহণ করতে সমর্থ, শিল্পী হওয়া তাঁর পক্ষেই সম্ভব। জীবন-চেতনা যার ক্ষীণ, বিচরণক্ষেত্র যার সংকীর্ণ, অভিজ্ঞতা যার সীমিত, সংবেদনশীলতা যাতে অনুপস্থিত, জীবন-শিল্পীর গৌরব তাঁর ভাগ্যে নেই।
এ যে বিদ্যা-বুদ্ধি ও জ্ঞানে লভ্য নয়, তা বলে দেয়ায় অপেক্ষা রাখে না। সদাসচেতন ইন্দ্রিয়, সমীক্ষুমন, দরদভরা হৃদয় আর গুছিয়ে ও পিজিয়ে বলার কায়দা যার আয়ত্তে, শিল্পী হওয়া তাঁরই সাজে।