ফলে আবহমান কাল থেকে মানুষের সুখ-হর্ষ, ভয়-ভাবনা, সখ-শঙ্কা প্রভৃতি আবেগময় সবকিছুই সুরে বিধৃত।
কিন্তু চিরকাল মানুষের মন আদর্শপ্রবণ ও আদর্শানুগ। নীতি ও আদর্শের প্রতি মানুষের একটা স্বাভাবিক শ্রদ্ধা ও আকর্ষণ রয়েছে। সেকালে ধর্মই ছিল লোকজীবন ও সমাজের ভিত্তি আর দিশারী। যে-যুগে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক মত ও আদর্শ গড়ে উঠত ধর্ম ভিত্তি করে। তাই ধর্মকথা বা নীতিবার্তাই ছিল সাহিত্যের প্রাণস্বরূপ। এ না হলে রচনার সামাজিক মূল্য থাকত না।
এ-যুগে এ ব্যাপারে ধর্মবিশ্বাস কার্যকর নয় বটে, তবে এ-যুগেও নীতি আর আদর্শ ছাড়া কোনো মত গড়ে ওঠে না। সমাজে, সাহিত্যে বা রাজনীতিতে মতাদর্শ লোক-যাত্রার অবলম্বন,–তা সামাজিক, রাষ্ট্রিক, অর্থনীতিক বা মানবতার আদর্শের যে-কোনোটিই হোক না কেন।
সে-যুগের ধর্মের স্থান দখল করেছে এ-যুগে মতবাদ। সে-যুগে জীবন ছিল ধর্মকেন্দ্রী ও সংস্কার-প্রবণ। এ-যুগে জীবন মত-ভিত্তিক। অতএব নামান্তরে বা কেন্দ্রান্তরে আমাদের অদৃশ্য নিয়ন্তা রয়েইছে।
বলছিলাম, সে-যুগে জীবন ধর্মকেন্দ্রিক ছিল। ফলে যা ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষের সহায়ক নয়, তা ছিল একান্তই অবহেলিত। এ কারণেই সে-যুগের ধর্ম ও নীতি-নিরপেক্ষ রচনা বর্ণে-বিধৃত হয়ে কালজয়ী রূপে এ-যুগে আমাদের হাতে পৌঁছায়নি। এখানে আমাদের উপাখ্যান-সাহিত্যের প্রশ্ন উঠতে পারে। এর উত্তরে বলা যায়, প্রথমত, রোমান্স বিদেশী সাহিত্যের অনুকরণ ও অনুবাদ। দ্বিতীয়ত, এগুলো পনেরো-ষোলো শতকের পূর্বের নয়। তৃতীয়ত, এগুলো অপেক্ষাকৃত সংস্কারমুক্ত মুসলিম-মনেরই অভিব্যক্তি। তবু রোমান্স-সাহিত্যে ধর্ম না থাকলেও ধর্মবোধ ছিল; ছিল আদর্শানুগত্য। তাই ওগুলো টিকে রয়েছ।
সে-যুগে মানুষ ছিল, অথচ মানুষের ধর্মনিরপেক্ষ রস-চেতনা ছিল না–এমন হতেই পারে না। তার প্রমাণও পাচ্ছি ছড়ায়, রূপকথায়, গানে-গাথায়, প্রবাদে-প্রবচনে, হেঁয়ালিতে। যে-যুগে লাখে একজন শিক্ষিত ছিল না, সে-যুগে প্রাকৃতজন-সৃষ্ট এসবই মানুষের রস-পিপাসা চরিতার্থ করেছে শত শত বছর ধরে। শিক্ষার প্রসারের ফলে, আজ এদের রস-মূল্য কমে গেছে। সাহিত্যমূল্যও হয়তো নেই। তাই এসব লোক-সৃষ্ট সাহিত্য লোকস্মৃতি থেকে মুছে যাচ্ছে। তবু লোকশ্রুতিতে কতকটা বেঁচে আছে। কিন্তু এ-যুগে এসব আর বুঝি টিকে থাকতে পারছে না। লোকমুখের আশ্রয় হারিয়ে ওগুলো নদীর চরের মতো আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসে ঠাই করে নিচ্ছে। যদি সবগুলো সযত্নে সংগৃহীত হয়, তাহলে আমাদের ক্ষোভের কারণ থাকে না।
শিক্ষা-সভ্যতার বিকাশ ও প্রসারের ফলে আজ আমাদের কাছে এসব অবহেলিত রচনার মূল্য অপরিমেয়। কেননা, এর থেকেই আমরা আমাদের সর্বপ্রকার ঐতিহ্যের সন্ধান পাব–পাব সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনীতিক এমনকি নৃতাত্ত্বিক ইতিহাসের উপাদান। আরো একদিক দিয়ে এসবের মূল্য অপরিসীম, কেননা সে-যুগে বিদ্বান লোকেরা দরবারি ভাষা সংস্কৃতের (মুসলমান আমলে ফারসিও) চর্চা করতেন। প্রাকৃত ভাষার প্রতি তাদের অবজ্ঞার অন্ত ছিল না। কাজেই আমাদের ছড়া, প্রবাদ প্রবচন, গান, গাথা ও রূপকথা নিশ্চিতই প্রাকৃতজনের সৃষ্টি। তাই আমাদের অতীত জীবনধারার স্বরূপ উপলব্ধি ও উঘাটনের পক্ষে এগুলো আরো মূল্যবান, কারণ এতে আর যা-ই থাক, সাহিত্যিক বা নৈতিক কৃত্রিমতা নেই।
ভাষার ভিত্তি শব্দ। কাজেই জাতির পরিচয়ে শব্দের মুল্য কম নয়। এর থেকেই জাতির আচার-আচরণের বাহ্যরূপ চিত্রিত হতে পারে। এ শব্দ দিয়েও জাতির ইতিহাসের কাঠামো খাড়া করা যায়। যেমন ধরুন স্বতন্ত্র শব্দটি। এ প্রাচীন শব্দটিই বলে দেয়–এককালে এদেশে কাপড় বুনবার জন্যে আলাদা সম্প্রদায় ছিল না, প্রত্যেক পরিবারেই কাপড় বোনা হত। যাদের নিজস্ব তত থাকত, তারাই সমাজে ধনী ও মানী বলে মর্যাদা পেত। প্রতিপত্তি ছিল তাদেরই। যেমন ধরুন, প্রাচীনকালের কথা বলতেই আমরা যতই গদগদ কণ্ঠে, গোলায় গোলায় ধান আর গলায় গলায় গানের বর্ণনা দিই না কেন, দুর্ভিক্ষ শব্দটিই বলে দিচ্ছে–আমরা যেমন কল্পনা করছি, অবস্থাটা নিতান্ত তেমনি ছিল না। সে-সোনার যুগেও ভিক্ষা দিতে হত, কাঙালি-বিদায় পার্বণও ছিল, ছিল ডাল-ভাতের চোরও।
তারপর আমাদের বাগ্বিধির বিচার করলে দেখা যাবে তাতেও বিচিত্রভাবে ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের সংস্কৃতির উপাদান। যেমন পান দান। এটা সম্মতি, খাতির, মিত্রতা ও প্রীতির স্বীকৃতি সূচক।
যেমন কলকে পাওয়া–গাঁজা, চরশ তামাক প্রভৃতির দেশে সমাজে মর্যাদা বা খাতির পাওয়ার কথা এর থেকে উৎকৃষ্ট ভাবে বলা যায় না। আর একটি উদাহরণ নিন তেলা মাথায় তেল-এককালে যে আমাদের দেশে তেলাভিষিক্ত করে অভিনন্দিত বা বরণ করা হত–এ তারই স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে। উৎসবাদিতে তেলোয়াই দেয়ার প্রথা আজো উঠে যায়নি।
ছড়াতেও রয়েছে আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির ইতিহাস। আপাত দৃষ্টিতে এগুলো যতই অস্পষ্ট ও অসংলগ্ন বলে মনে হোক না কেন, এগুলোতেও রয়েছে আমাদের নানা আচার-আচরণের ছিটেফোঁটা, মন-মননের নানা ইঙ্গিত। যেমন–
আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে।
ঝাঁঝর কাঁসর মৃদঙ্গ বাজে ॥
আগডুম-অগ্রগামী ডোম, বাগডুম–পার্শ্বগামী ডোম আর অশ্বারোহী ডোম সেনার কথা বলা হয়েছে এখানে। রাঢ় অঞ্চলে একসময় রাজা ও জমিদারদের ডোম-সৈন্য থাকত। ডোম-সেনার চতুরঙ্গ বাহিনীর রূপটিই এ প্রাচীন ছড়ায় বিধৃত হয়েছে।