ব্যক্তিসত্তায় সংগ্রামী বীজ অনুপ্রবিষ্ট হয়ে গণচিত্ত করেছে বিক্ষুব্ধ, বিস্রস্ত; তাই আজকের দিনে বুনিয়াদি শিল্পকলায় ও রুচি-সৌন্দর্যে অনুরাগ প্রদর্শন করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। আজকের সাহিত্য প্রচেষ্টায় তাই বস্তু-ভাব-ভাষা-ছন্দ ও আদর্শ একান্তই নিরাবরণ ও নিরাভরণ। কিন্তু তাই বলে কী আজকের দিনের সাহিত্য আগামী দিনের জনগণ-মনে রস পরিবেশনে অক্ষম হবে?
আমাদের এই সংঘাত-মুখর গ্লানিময় জীবনের, এ ক্লিন্ন দিনের কাহিনী কী তাদের মনে রেখাপাত করবে না? তারা কী বুঝবে না–সমাজ ও রাষ্ট্রের অব্যবস্থায় যে-আর্থিক বিপর্যয় আসে, তাতে বুভুক্ষাপীড়িত নিরন্ন রুগ্ণ-ক্লিষ্ট-পিষ্ট কোটি কোটি হতভাগ্য মানবসন্তান অপঘাত অপমৃত্যু থেকে বাঁচবার জন্যে আনচান করেছিল? তারা কী উপলব্ধি করবে না ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এই হতভাগ্যেরা বৃহৎ ও মহতের সাধনায়, সুন্দরের সাধনায় আত্মনিয়োগ করবার সুযোগ-অবসর পায়নি? এ কলঙ্কিত যুগের মানুষের ও মনুষ্যত্বের অপমৃত্যুর ইতিহাস কী তাদের জানবার দরকার হবে
আমাদের ব্যবহারিক জীবনের বেদনার কাহিনী, আমাদের সংগ্রামের বাণী যদি তাদের কাছে কদর না পায়, তবে তা বিষয়বস্তু ও আদর্শের অযোগ্যতার দরুণ নয়, বরং তা আমাদের বাচনভঙ্গির ত্রুটি ও চিত্রণশক্তির অপটুতার জন্যেই উপেক্ষিত হবে।
আগেই বলেছি, রচনাকে রসায়ত্ত শিল্পরূপে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে শক্তি ও শিল্পকুশলতা প্রয়োজন। অন্যথায় রচনা রচনাই থেকে যায়, সাহিত্য হয় না।
একটা দৃষ্টান্ত নেয়া যাক্। আমরা স্বাধীনতা হারিয়েছিলাম বলেই নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও পলাশীর কাহিনী আমাদের উত্তেজিত করত, প্রেরণা দিত। আজ আজাদী পেয়েছি। পলাশী যুদ্ধ বা নবাব সিরাজদ্দৌলার কাহিনী আমাদের মনে আর সাড়া জাগাবে না; ইতিহাসের অসংখ্য যুদ্ধ, বিশ্বাসঘাতকতা ও হত্যা-কাহিনীর মতো এও একটি কাহিনী হয়েই থাকবে। তার বিশেষ আবেদন, বিশেষ ব্যঞ্জনা ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু কেউ যদি জুলিয়াস সিজারের মতো নাটক রচনা করে এ কাহিনীকে ভিত্তি করে, তবে তার আবেদন থাকবে চিরস্থায়ী হয়ে। ফলে, পলাশীর যুদ্ধ ও নবাব সিরাজদ্দৌলার ঐতিহাসিক মূল্য শুধু ইতিহাসের ছাত্রের কাছেই থাকল, কিন্তু পলাশীযুদ্ধ বা সিরাজদ্দৌলা নাটকের আবেদন সর্বদেশের, সর্বকালের ও সর্বমানবের কাছে সমভাবে পৌঁছবে। একেই বলে শিল্প, এতেই হয় সাহিত্য।
সুতরাং আধুনিক গণসাহিত্যকে প্রচারপত্রিকা বলে উপহাস করবার কারণ নেই। এ আদর্শে রচিত কোনো রচনা যদি পাঠক-হৃদয়ে সাড়া না জাগাতে পারে, তবে বুঝতে হবে, লেখক অক্ষম প্রতিভাহীন। আদর্শ ছোট নয়–বিষয়বস্তুও সাহিত্যের উপাদান হবার অযোগ্য নয়।
আধুনিক সাহিত্যের বিরুদ্ধে আর একটা নালিশ এই যে–এতে প্রাচীন বিশ্বাস, সংস্কার, রীতিনীতি প্রভৃতিকে অস্বীকার ও উপহাস করা হচ্ছে। নরনারীর সম্পর্ক, প্রেম-স্নেহ-মমতা প্রভৃতির আধুনিক-মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রাচীন সংস্কার ও বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত করেছে, ফলে যা একসময় আত্মিক ও আধ্যাত্মিক আবরণে বরণীয় ও সহনীয়রূপে পরম পবিত্র বলে বিবেচিত হত, তাকেই একান্ত জৈব-ব্যবহারিক প্রয়োজনের সামগ্রী বলে মাহাত্ম্যহীন করে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, এর সাথে বিপর্যস্ত করা হচ্ছে মানুষের আস্তিক্য বুদ্ধিকেও। শ্রদ্ধা, ভক্তি প্রভৃতির মতো পবিত্র বৃত্তি ব্যঞ্জনাগুলোকেও যেন করা হচ্ছে উপহাস। সমাজ-রাষ্ট্র ও ব্যক্তিসত্তার চিরন্তন সংস্কারকেও দলিত করে সমাজের ভিত জীর্ণ করে দিচ্ছে। এর ফলে সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের সামঞ্জস্য সৌষ্ঠব-শান্তি নষ্ট হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। স্ত্রী-পুত্র-পরিজন নিয়ে যে-সংসার–সে-সংসারে প্রয়োজনের ব্যবহারিক বন্ধনের উপর ধর্মীয়, আত্মিক ও আধ্যাত্মিক মর্যাদা আরোপ করে পারস্পরিক সহযোগিতা ও নির্ভরশীলতার মধ্যে যে একটা পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের সংস্কার জাগিয়ে রাখা হয়েছিল, তা যদি নষ্ট হয়ে যায়; তবে সংসার, পারিবারিক বন্ধন টিকবে কোনো আদর্শের জোরে?–এ-ই হচ্ছে তাদের জিজ্ঞাসা।
অবশ্য এ-কথা সত্যি যে, আমরা যে-পরিমাণে কার্লমার্কস্ ও ফ্রয়েডের অনুরাগী হচ্ছি, ঠিক তার দ্বিগুণ পরিমাণে প্রাচীন বিশ্বাস ও সংস্কার থেকে দূরে সরে আসছি, ফলে প্রাচীনরাও ঠিক সেই পরিমাণে মানুষ ও মনুষ্য-সমাজের পরিণাম চিন্তায় ভীত-ত্রস্ত হচ্ছেন। কিন্তু প্রাচীনদের ভুলে চলবে না যে, কালস্রোত নদীর স্রোতের চেয়ে কম বেগবান নয়। কিছু ধরে রাখতে চাইলেই রাখা যায় না; নতুন সূর্যের উদয়ে, নতুন মানুষের আবির্ভাবে নতুন দিন নতুন চিন্তা না এসে পারে না। প্রকৃতির রাজ্যে অহরহ পরিবর্তন চলছে-বীজে মূল, মূলে কাণ্ড, কাণ্ডে শাখা, শাখায় পাতা-কলি ফুল-ফল, ফলে আবার বীজ। স্রষ্টার কল চলছে অনবরত–সৃষ্টি আর ধ্বংস, ধ্বংস আর সৃষ্টি, এই তার কাজ। যা যাচ্ছে তা আর ফিরে আসে না এবং Old order changeth yeilding place to new.
কিন্তু তবু নতুন যা আসছে, তার সাথে পুরাতনের অনৈক্য নেই, যদিও নতুন ও পুরাতন দুটোর আলাদা রূপ। তেমনি মনুষ্য-সমাজেও নতুন ও পুরাতনে রূপগত, পথগত অনৈক্য থাকলেও মৌলিক ঐক্য সর্বত্র বিদ্যমান, উদ্দেশ্যগত বিরোধ নেই কোথাও। প্রাচীন বিধি-ব্যবস্থা, শিক্ষা সংস্কারের উদ্দেশ্য যেমন সুশৃঙ্খল; জীবন ও সমাজবোধ, আজকের বিচার-বিশ্লেষণ, গ্রহণ-বর্জন, বিশ্বাস-শ্রদ্ধা, উপহাস-উপেক্ষাও ঠিক একই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সুতরাং প্রাচীন বিশ্বাস-সংস্কার পালটাতে পারে, কিন্তু মানুষ চিরদিন সামাজিক জীবই থাকবে–তাতে সন্দেহ নেই। অতএব বলা যেতে পারে, এ পথে মানুষের পরিণাম ভয়াবহ হবে না বরং সামাজিক ও পারিবারিক জীবন আরও সুন্দর, আরো সার্থক, আরো মধুর হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়। সুতরাং প্রাচীনদের আশঙ্কা করার কিছুই নেই, বরং ভরসা করার রয়েছে অনেক কারণ। কেননা শিক্ষা-সভ্যতার প্রসারের ফলে মানুষের উৎকৃষ্ট বৃত্তিগুলো অধিকতর বিকাশ লাভ করছে, বেহেস্ত-দোজখের শান্তি-শাস্তি নিরপেক্ষ সহজ মনুষ্যত্বের প্রেরণায় মানুষের মানবতাবোধ ও সুরুচি মানুষকে বিবেচক ও ন্যায়ানুরাগী করে তুলতে বাধ্য, যা আগের যুগে আধ্যাত্মিক-আধিদৈবিক শক্তির দোহাই কেড়েও সম্ভব হয়নি।
জাতীয় জীবনে লোকসাহিত্যের মূল্য
সুর মানুষের আদিম সৃষ্টি। যা কিছু মহৎ, সুন্দর, শোভন ও কাম্য–তাকেই মানুষ সুরের বন্ধনে সুন্দর করেছে। বিলাপে, ভ্যাংচিতে, গানে, কথায়–এক কথায় সর্বপ্রকার হৃদয়ানুভূতির অভিব্যক্তিতে মানুষ তাই সুরের আশ্রয় নেয়।