সাম্প্ৰত-সাহিত্য সম্বন্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে–এ সাহিত্য হৃদয় ও কল্পনাধর্মী নয়, নিছক ব্যবহারিক জীবনের অভাব-অভিযোগ নিয়ে একপ্রকার মানসিক ব্যায়াম অথবা অশিক্ষিত মনের অসংযত উত্তেজনা। অর্থাৎ তাদের মতে, আজকের সাহিত্য রসসাহিত্য নয়–অভিযোগ অভিযানের বাণীবাহক প্রচারপত্র বিশেষ। তারা বলেন–সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, অভাব-অভিযোগ, অত্যাচার-নিপীড়ন চিরদিন মনুষ্য-জীবনে ওতপ্রোতভাবে মিশে রয়েছে। ব্যবহারিক জীবনে এসবের প্রতিষ্ঠা, প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্যে সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় স্তম্ভটি তো রয়েছেই, এগুলো নিয়ে আবার সাহিত্য করা কেন? আর এগুলোতে সাহিত্যের উপাদানই বা কোথায়? সাহিত্য হবে। ব্যবহারিক জীবনের এক কল্পজগতের দিশারী, সে-জগৎ হবে সব পাওয়ার দেশ। জীবনে যা পাইনি, যা পারিনি–সেখানে থাকবে তারই সমাবেশ। সেখানে রাজা আর ভিখারি সমভাবে—‘আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি’।–এ মতের সমর্থক একজন কবি বলেছেন :
জীবন যাহার অতি দুর্বহ দীন দুর্বল সবি–
রসাতলে বসি গড়িছে স্বর্গ–সে-জন বটে কবি। (মোহিত মজুমদার)
অপর একজন বলেছেন :
জীবনে যে-সাধ হয়েছে বিফল
সে-সাধ ফুটিছে গানে। (রবীন্দ্রনাথ)।
সুতরাং তাদের সুদৃঢ় অভিমত হচ্ছে—আধুনিক সাহিত্য-প্রচেষ্টা কোনোমতেই কবিকৃতি বা শিল্পীর সৃষ্টি নয়। কারণ সাম্প্ৰত-সাহিত্যের আদর্শ বা বিষয়বস্তু কোনোটারই রচনাকে রসায়ত্ত করবার যোগ্যতা নেই। কেননা–এ আদর্শে ও বিষয়বস্তুতে মানব-মনের ও হৃদয়ের চিরন্তন অনুভূতি ও প্রেরণা নিহিত নেই।
বিরুদ্ধবাদীদের অভিযোগ শোনা গেল, এখন আমাদের বক্তব্য পেশ করতে হয়।
প্রথমত, দেশ-কাল-পাত্র-নিরপেক্ষ সাহিত্য নেই–তা সেই সাহিত্যের আদর্শ art for arts sake ই হোক, আর সমাজ-রাষ্ট্র বা ব্যক্তিজীবন-বোধই হোক। হোমারের ইলিয়ড ওডেসিতে যে-ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, যেসব চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে, যে-নীতির তারিফ করা হয়েছে, তা এদেশের নয়, এ যুগের নয়, এ জাতিরও নয়। তবে তা আজো বিশ্বমানবের সম্পত্তি হয়ে রইল কী করে? ইরানের সেই বীর-বাদশা নেই, সে-কালও নেই, কিন্তু শাহনামা আজো আছে। জাঁ ভাজার দিনের সেই ফ্রান্স আজ ইতিহাসের অন্তর্গত। আজকের ফরাসি-জাতিতে ও ফরাসি দেশে সে-ফ্রান্সের সমাজের, রাষ্ট্রের, মানুষের চিহ্নমাত্র নেই; তবে ল্য মিজারেবল আজো টিকে রইল কী করে? একদিন যা ছিল একান্তভাবে একটি বিশেষ দেশের, কালের ও মানুষের নিতান্ত ঘরোয়া ব্যাপার, তা-ই আজ দেশ-কাল-পাত্র-নিরপেক্ষ বিশ্বমানবের সর্বজনীন হৃদয়ের ধন হয়ে উঠল কিরূপে? জানি, বিরুদ্ধবাদীরা বলবেন–এতে মানব-মনের ও হৃদয়ের চিরন্তন অভিব্যক্তি ছিল– যা সর্বকালের, সর্বদেশের ও সর্বমানবের। ল্য মিজারেবল-এর মতো আরো দুটো পরিচিত গ্রন্থের নাম করব–একটা হচ্ছে Uncle Toms Cabin অপরটা নীলদর্পণ। এ দুটোও প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে দুটো দেশে বিপ্লব ঘটিয়েছিল। নীলদর্পণের আবেদন নীল-চাষ উচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছে। এটি স্বদেশেও কালজয়ী হতে পারেনি। Uncle Toms Cabin-এর আবেদনও কী আজ আছে? কিন্তু ল্য মিজারেবল-এর গৌরব আজো অম্লান। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সাহিত্যের বিষয়বস্তু কোনোকালেই চিরন্তন নয়, আদর্শও অনেক সময় নিতান্ত সাময়িক সমস্যা নির্ভর। তবু রসসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ আসনে এদের অনধিকার নেই।
অতএব একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছা গেল–তা হচ্ছে রসসাহিত্য বা চিরন্তন আবেদনের সাহিত্য সৃষ্টিতে বিষয়বস্তু বা আদর্শ বড়কিছু নয়, লেখকের শক্তিই আসল। ল মিজারেবল-এ যে-সার্জেন্ট টার চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে, তা কোনো ব্যক্তিবিশেষের চরিত্র নয়–সে হচ্ছে আইনের মূর্তিমান প্রতীক (personification of the spirit of law)। জঁ ভাজাও নির্যাতিত মানবতার প্রতিমূর্তি একটি বিদ্রোহী আত্মাবিশেষ (a personified soul of the suffering humanity and its revolt against mankind)। ল্য মিজারেবল-এর তাই এত কদর এবং অমর-সৃষ্টি বলে গোটা দুনিয়ায় অভিনন্দিত। অথচ একটা দেশের একটা বিশেষ যুগের আর্থিক বিপর্যয় ও রাষ্ট্রীয় কুশাসনের চিত্র বই এ আর কিছু নয়।
ওথেলো নাটকের কথাই ধরা যাক্। বিষয়বস্তু হচ্ছে–এক তরুণ স্বামী তার স্ত্রীর চরিত্রে সন্দিহান হয়ে স্ত্রীকে হত্যা করে। এমন ঘটনা হয়তো আজো দৈনন্দিন ঘটছে। নিতান্ত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ঘটনা। কিন্তু শুধু কী তাই! ওথেলো ও ডেসডিমোেনায় কী প্রেমের দুটো দিক মূর্তি পরিগ্রহ করেনি, ইয়াগো কী সর্বধ্বংসী মন্দশক্তির প্রতীক হয়ে ওঠেনি? এখানেও প্রেম, প্রতিহিংসা ও ঘৃণা মূর্তি ধারণ করেছে (The sprit of love, malice and hatred is manifested)। এজন্যেই ওথেলোর কাহিনী ব্যক্তির হয়েও সমষ্টির হয়ে উঠতে পেরেছে। এখানেই কবিকৃতি–শিল্পীর গৌরব এবং সৃষ্টির স্থায়িত্বও নির্ভর করে সম্পূর্ণ শিল্পকৌশলের উপর বিষয়বস্তু বা আদর্শের উপর নয়।
দ্বিতীয়ত, আমরা আজকের দিনে যে-জীবন-সমস্যার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি, এমন সমস্যা দুনিয়ায় কোনোদিন ছিল না। ব্যক্তিসত্তাবোধ ও. তীব্র গণচেতনা এ-যুগের পূর্বে কখনো দেখা যায়নি। শিক্ষা-সভ্যতার প্রসারে আধুনিক যুগের মানুষ জগৎ, জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তি সম্পর্ক নতুনভাবে যাচাই করে নিতে বদ্ধপরিকর। কেননা শিক্ষা ও সুরুচি মানুষকে দিয়েছে তীব্র মর্যাদাবোধ ও আত্মবিশ্বাস। এদিকে পরিবেশও হয়ে উঠেছে প্রতিকূল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে গোটা দুনিয়ায় জীবন-ধারণযোগ্য দ্রব্য-সামগ্রীর অভাব ঘটেছে একান্ত। ফলে লোভ আর কাড়াকাড়ি ও হানাহানি তীব্রতর হয়ে উঠেছে সর্বত্র। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা, তাই দুর্বল জনসাধারণ ব্যবহারিক জীবনে শোষণ, অত্যাচার, পীড়ন ও অভাব-অনটনে জর্জরিত হয়ে নিছক বস্তুতান্ত্রিক হয়ে উঠতে বাধ্য হয়েছে। এইরূপে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কলকারখানা স্থাপিত হওয়ার ফলে ধন-বৈষম্য মানুষের ব্যবহারিক জীবনে এনেছে ক্ষোভ আর গ্লানি, মনন জীবন করেছে পঙ্গু। অধিকাংশ লোকের ডাল ভাতের সংস্থান না-থাকায় তারা বুনিয়াদি শিল্প-কলা, স্থাপত্য-ভাস্কর্য প্রভৃতির উপর ক্ষোভে উত্তেজনায় মারমুখী হয়ে উঠেছে। বস্তুত বেঁচে থাকাই যখন দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে, তখন মনুষ্যত্ব বিকাশক সুন্দর, বৃহৎ ও মহতের সাধনায় আত্মনিয়োগ করা সম্ভব নয়। তাই অধিকারবাদের সগ্রাম শুরু হয়েছে দুনিয়াময়। সে-সগ্রাম দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে আর শ্রেণীতে শ্রেণীতে অবিরাম চলছে।