ইনি আরো বলেন–
এ কথা যখন জানি
মানবচিত্তের সাধনায়
গূঢ় আছে যে সত্যের রূপ
সেই সত্য সুখ দুখ সবের অতীত।
তখন বুঝিতে পারি
আপন আত্মায় যারা
ফলবান করে তারে
তারাই চরম লক্ষ্য মানব সৃষ্টির।
এসবকিছুর মূলে রয়েছে সামগ্রিক ভালোবাসা, নির্বিচার প্রেম–এই হচ্ছে জীবনরস, একে যে নিতে শিখেছে তাকেই বলি জীবনরসিক। তার চিত্তকে একটিমাত্র বোধই আচ্ছন্ন করে রাখে, সে জানে–
এ বিশ্বেরে ভালোবাসিয়াছি
এ ভালোবাসাই সত্য,–এ জন্মের দান।
বিদায় নেবার কালে
এ সত্য অম্লান হয়ে মৃত্যুরে করিবে অস্বীকার।
শাদামাটা কথায় বলা যায়, মনের এ স্তর হচ্ছে জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে সূক্ষ্ম অনুভূতি ও উপলব্ধির স্তর, To know all is to Pardon all কথাটি যে-বোধের পরিচয় দেয়, আমরা সে-বোধের স্বরূপটিকেই Rational Humanism বা বোধিসম্পন্ন মনুষ্যত্ব বলছি। পূর্ণাঙ্গ জীবনালেখ্য দেয়া কিংবা নিখুঁত জগৎ উদ্ঘাটন করা, এমনি মনুষ্যত্বেই সম্ভব।
আমি কবি, তর্ক নাহি জানি। এ বিশ্বেরে দেখি তার সমগ্র স্বরূপে। মহৎ সাহিত্যিকের লক্ষ্য, সাধ্য ও ব্রত এ-ই। অতএব এক্ষেত্রে আদর্শানুগত্য, জাতি ও সমাজ-চেতনা প্রভৃতি অবাঞ্ছিত কথা। আদর্শানুগত্য মহৎ সৃষ্টির তো বটেই, ভালো সৃষ্টিরও পরিপন্থী। মন যার মুক্ত নয়, চিন্তা তাঁর। স্বাধীন হতে পারে না। আর স্বাধীন চিন্তা যেখানে অসম্ভব, সেখানে অনুভূতি খণ্ড আর উপলব্ধি পঙ্গু হবেই। কাজেই তাকে সত্য, সমগ্র ও সুন্দর ধরা দেয় না। তেমন লেখক, জাতীয় কবি হতে পারেন, সমাজ-দরদী ঔপন্যাসিক হতে পারেন, জনপ্রিয় মনীষীও হতে বাধা নেই, কিন্তু মানুষের : আত্মিক মিলন-ময়দানে তাঁর স্বীকৃতি নেই–সেখানে তিনি অচেনা–অবাঞ্ছিতও। পারিবারিক জীবনে ব্যক্তিক স্বার্থচেতনা যেমন পরিবারের অশান্তি ও বিপর্যয় ঘটায়, তেমনি স্বাজাত্য ও স্বারাষ্ট্রবোধ দেশে দেশে দ্বন্দ্ব-সংঘাত জিইয়ে রাখে। আজকের দুনিয়ার বারো আনা দুঃখের উৎস এটিই। আজ যখন পৃথিবীর ভৌগোলিক বাধা মুছে গেছে, রাজার রাজ্য উঠে গেছে, মানুষ রাষ্ট্রিক সীমাও অপসারণের স্বপ্ন দেখছে, তখন গোত্র, সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্র-সীমা-চেতনাপ্রসূত আদর্শবাদ কিংবা মতবাদ-প্রবণতা মনুষ্য মনন ও প্রগতির বাধা বৈকী! জাতীয় নয়–আন্তর্জাতিকতাই এ যুগের সাধ্য হওয়া উচিত–তাহলেই আশু মঙ্গল। বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতা নিয়েও যেমন পৃথিবী অখণ্ড, তেমনি দুনিয়ার মানুষের মনন ও আচার বৈচিত্র্য স্বীকার করেই মানুষ একজাত অর্থাৎ United in diversity–শতবছর পরে হলেও নিশ্চয়ই কোনো একপ্রকারের বিশ্বরাষ্ট্র গড়ে উঠবে। কাজেই দূরদৃষ্টি যার আছে, সে কেন বৃথা সাধনায় জীবন নষ্ট করবে!
বলেছি, আদর্শানুগত্য জীবনের আর আর ক্ষেত্রে বিশেষ ফলপ্রসূ, কিন্তু মানসসৃষ্টির ক্ষেত্রে অভিশাপ। স্রষ্টা নিজেকে কোথাও বিকোতে পারে না, তার স্বাধীনতা কারও কাছে বন্ধক রাখা যায় না। তাহলে প্রতিমুহূর্তে তাকে আত্মপ্রতারণা করতে হয়। কারণ আদর্শ বিচ্যুতির ভয়ে সে তার উপলব্ধির সত্যকে প্রকাশ করতে পারে না। অকৃত্রিম কাঞ্চন ফেলে, সে গিটিকে সোনা করবার বিড়ম্বনায় আত্মনিয়োগ করে। এতে হয়তো কেজো সাহিত্য সৃষ্টি হয়–কাজেও লাগে, কিন্তু অকেজো সাহিত্য হতেই পারে না। কেজো সাহিত্য হচ্ছে বেগুন-ক্ষেত আর অকেজো সাহিত্য ফুলবাগান। যার যা রুচি ও প্রয়োজন, সে তা-ই করবে।
গণসাহিত্য
গণসাহিত্য বা সাম্প্ৰত-সাহিত্য ও সাহিত্যাদর্শ সম্বন্ধে আজো অনেকেই বিরূপ ধারণা পোষণ করেন। এমন লোকও আছেন, যাঁরা একে রসসাহিত্য বলতে কিছুতেই রাজি নন। এক কথায়, তারা সাহিত্যের অত্যাধুনিক আদর্শে আস্থাবান নন।
দোষ তাঁদের নয়। নতুনকে দ্বিধাহীনচিত্তে গ্রহণ করা কোনোকালেই তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। নবীন ও প্রবীণে দ্বন্দ্ব নতুন নয়। প্রবীণের মনে প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার গর্ব থাকে, তাতেই প্রবীণরা রক্ষণশীল। যাকে প্রবীণেরা প্রজ্ঞা মনে করেন, তা আসলে সংস্কার; আর যাকে অভিজ্ঞতার কষ্টিপাথরে পরীক্ষিত ভাবেন, তা মূলত অভ্যস্ত সংস্কারের প্রতি অন্ধ মমতা। এজন্যেই প্রবীণমাত্রেই বিজ্ঞতার দাবী করেন। নবীনরা চলে প্রাণধর্মের প্রেরণায়। বয়োধর্মের গুণে সংস্কারবিমুক্ত একটি স্বচ্ছ অথচ উচ্ছ্বাসময় দৃষ্টি এদের স্বভাবজ। সে-দৃষ্টিতে জগৎ, জীবন, ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের অনেক খুঁত–বহু ত্রুটি ধরা পড়ে যায়। তারুণ্যের আর একটি লক্ষণ হচ্ছে বিসদৃশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, আর শক্তির প্রয়োগ। আশ্চর্য এই যে, এককালে যারা নবীন-নতুনের দিশারী ও পূজারী, তারাই বয়োধর্মের বিধানে প্রবীণ–বিজ্ঞতাভিমানী, নতুনের বিদ্বেষী, রক্ষণশীল; তারা এমন গোঁড়া। রক্ষণশীল যে, নতুন তুলিতে আর বুলিতে ভীত ও ত্রস্ত হয়ে উঠেন। সবল হলে সশস্ত্র রুখে দাঁড়ান, দুর্বল হলে কান্না জুড়ে বসেন। ধর্মে-দর্শনে-সমাজে-সাহিত্যে-রাষ্ট্রে চিরদিন এই দ্বন্দ্বই চলে আসছে।
অতএব, আমাদের আজকের দিনের সাহিত্যাদর্শও যদি পূর্বযুগের মনন-পুষ্ট কারো পছন্দসই না হয়, তবে দুঃখ করবার কিছুই নেই। তাদের কাছে স্বীকৃতি না পেলে ক্ষুব্ধ হওয়াও উচিত নয়।
তবে প্রথা আছে, প্রচারণা চালিয়ে স্বমতের প্রতিষ্ঠা করা–আর অবিশ্বাসীর মনে বিশ্বাস আনয়ন করা। আমরাই বা নিয়মের ব্যতিক্রম করব কেন! তাই দু-চারটা কথা বলতে চাই।