সমস্যাবিমূঢ় কাঙাল মানুষের অসামর্থ্যকে ঢাকবার জন্যে, আঙুর ফল টক শ্রেণীর যুক্তি দিয়ে মহৎ প্রয়োজনের আয়োজনকে তাচ্ছিল্য দেখাবার আস্ফালনেই কেবল আমাদের আপত্তি।
যে-অর্থে আমাদের ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্র প্রয়োজনের; সে-অর্থে সাহিত্য কোনো কালে প্রয়োজন ছিল না–হতে পারে না। সাহিত্য করে কয়জন, আর পড়ে কয়জন? সাহিত্যই জীবনের অপরিহার্য সামগ্রী যে নয়, তার প্রমাণ (অশিক্ষিতের তো কথাই নেই) শিক্ষিত লোকদের গুটিকয়জনই সাহিত্য পড়ে। এবং তাও সারাজীবনে পড়ে কয়খানা? যারা পড়ে না, তারা জীবনে উপভোগ উপলব্ধির অসম্পূর্ণতাও অনুভব করে না। কাজেই সাহিত্যাদি কলা এমনিতেই কেজো জীবনের বাইরে। তাহলে যা আদপেই কেজো নয়, তাকেই কাজে লাগানোর এত আয়োজন কেন? কথাটা বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করা যাক।
জনমনে সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রচেতনা দানের জন্যে কিংবা স্বদেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, কল্যাণবুদ্ধি জাগানোর জন্যে, অথবা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা সমস্যা তুলে ধরে সমাধানের ইঙ্গিত কিংবা প্রেরণা যোগাবার জন্যেই যে সাহিত্য হওয়া উচিত, সে সম্বন্ধে আজকাল জীবন-সচেতন মানুষ মাত্রই একমত। এ যে-রচনায় নেই তা ব্যর্থ। এ-ই তাঁদের সুচিন্তিত অভিমত। আমরা তো স্বীকার করেছি যে কেজো সাহিত্যও আছে। আমাদের আপত্তি হচ্ছে প্রথমত কেজো সাহিত্যই একমাত্র সাহিত্য নয়, দ্বিতীয়ত কেজো সাহিত্য নিতান্ত কেজো বলেই মহৎ নয়, তৃতীয়ত কেজো সাহিত্য সৃষ্টি করাই কারো ব্রত হওয়া উচিত নয়। কেন, এবার তা-ই বলছি। শোনা যায় এবং ঘটা করে সারা দুনিয়ার নানা সাহিত্যের দৃষ্টান্ত দিয়ে শোনানোও হয় যে সমাজ সংস্কারে, ধর্ম-প্রচারে, পীড়ন-অপসারণে, আযাদী অর্জনে, রাষ্ট্রগঠনে, মতবাদ গড়নে,বিপ্লব-বিদ্রোহ সৃজনে, সংস্কৃতির উন্নয়নে, জাগরণ আনয়নে কিংবা সামগ্রিকভাবে জাতীয় চেতনা দানে কেজো সাহিত্যের মতো এমন অব্যর্থ অস্ত্র আর নেই। ঘরে বসে কলম পেষো, কাগজে ছেপে দাও, ব্যস, জাদুর মতো অভীষ্ট ফল ফলে গেছে!
কিন্তু প্রচার-সাহিত্য ছাড়া এসব ব্যাপারে সাফল্যের আর কোনো উপায় নেই, কিংবা সাহিত্যের মাধ্যমে প্রচারই একমাত্র পন্থা তা মানা যাবে না, কেননা আমরা চোখের সামনেই দেখছি, এক জায়গার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার খবরই অন্যত্র দাঙ্গা বাধানোর পক্ষে যথেষ্ট। অশিক্ষিতের দেশ কঙ্গোও যখন স্বাধীন হয়, খবরের কাগজে পরিবেশিত লুমুম্বা-হত্যার কেবল সংবাদই যদি উত্তেজনা সৃষ্টির প্রচুর কারণ হয়ে ওঠে কিংবা সম্পাদকীয় মন্তব্যই উত্তেজনা ও প্রেরণাদান তথা বিদ্রোহ-বিপ্লব ঘটানোর পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণিত হয়, তাহলে চেতনা দানের সাহিত্য অপরিহার্য বলে মানি কী করে? যেখানে স্বার্থ, গরজ ও পীড়ন সেখানে মনটি এমনিতেই Time-bomb-এর মতো তৈরি হয়েই থাকে, সামান্য উত্তেজনা কিংবা যোগ্য নেতৃত্বে গণশক্তি ফেটে পড়েই। এ আমাদের দেখা-জানা কথা। কাজেই কেজো সাহিত্য যে খুব কাজের তা ধ্রুব নয়। এক্ষেত্রে বরং রাজনীতিকের বক্তৃতাই বিশেষ কার্যকর। ভালো বক্তার ভালো লিখিয়ে হওয়া সম্ভব, কিন্তু বড় বক্তা বড় লিখিয়ে নন।
এবার অকেজো সাহিত্যের কথায় আসা যাক। ধর্মে, সমাজে ও রাষ্ট্রে আদর্শানুগত্য ও মতবাদনিষ্ঠা কেবল ভালো নয়, অতি প্রয়োজনীয়ও বটে। তাতে করে নিয়ম-নীতির বেষ্টনীর মধ্যে জীবন নির্বিঘ্নে উপভোগ করা সম্ভব ও সহজ হয়, তাতে মানুষের হাতে মানুষের লাঞ্ছনা-পীড়নের আশঙ্কা কমে। এতে করে সজ্জন, সচ্চরিত্র ও সুনাগরিকের সংখ্যা বাড়ে। এককথায় ব্যবহারিক জীবনের বাস্তব material ও লাভের ব্যাপারে একরকম নিশ্চিন্তই হওয়া যায়। কেজো জীবনের বাইরেও যে একটা মনোজগৎ রয়েছে! উপভোগ-উপলব্ধির নিবিড়তম যে-কেন্দ্র, তাতে কেজো কথার দাম নেই। সে হল অকাজের কাজী, অপ্রয়োজনের প্রয়োজন নিয়ে তার কারবার। সে স্কুল কিছু গ্রহণ করে না। হয়তো বা সহ্যও করে না। তার কাজ নির্যাস নেয়া, সেটি অবিমিশ্রতায় নিরূপ না হলেও স্বরূপে তাকে ধরা মুশকিল। ফুল গাছেই জন্মায়, তবু ফুল আর গাছ এক নয়; তেমনি বাহ্যঘটনা, পরিবেশ ও আচরণই সে-উপলব্ধি ও বয়সের ভিত্তি বা প্রসূতি, তবু মা-মেয়ের আদর্শে মিল খুঁজে পাওয়া ভার। কতটা স্বপ্নের মতোই। এ অবচেতন মনের লীলা। মনস্তাত্ত্বিক না হলে এ মনোরসের বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। যে-কারণে ফটো চিত্রকলা নয়, নক্সা সাহিত্য নয়, সে-কারণেই। কেজো সাহিত্য বিশুদ্ধ সাহিত্য নয়। কেজো সাহিত্যের বড় দোষ তার স্থূলতা ও বাস্তবানুরক্তি। আমরা এ-কথা হয়তো সবাই মানি যে প্রত্যক্ষকে পরোক্ষ করে তোলা এবং খণ্ড, ক্ষুদ্র ও তুচ্ছকে সমগ্রতার মর্যাদা ও গুরুত্ব দানই সাহিত্যের কাজ। কাজেই জীবনের রোজনামচা যেমন জীবনী নয়, সত্যকথার পদ্যরূপ যেমন সাহিত্য নয়, তেমনি কোনো ব্যবহারিক প্রয়োজন-মিটানো স্থূলতা এবং সাময়িকতাও অকেজো সাহিত্যের অবলম্বন হতে পারে না। কেননা অকেজো সাহিত্য যে-মনের খোরাক, তার সম্পর্ক পরিবেষ্টনীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ নয়–পরোক্ষ। কথাটা ব্যাখ্যা করে বলি, সমাজ ধর্ম-রাষ্ট্র ও ধন-জন-মান প্রভৃতি আমাদের জৈবিক প্রয়োজনেরই অবলম্বন। এ জীবনে দেশ আছে, ধর্ম আছে, আইন আছে, সংস্কার আছে এবং আছে আরো কত কি। আমরা এসব নীতিশাসনের হাজারো গিঁঠাতে বাঁধা। আমাদের একটি মনোজীবনও আছে, যেখানে দেশ-কাল-সমাজ-ধর্ম শাসন-নিয়ম কোনোটারই বন্ধন স্বীকার করিনে, বলা যায় এসবের অস্তিত্বই অনুভব করিনে। কাজেই সেখানে কোনো আদর্শবাদ কিংবা কিছুতে ঐকান্তিক নিষ্ঠার প্রশ্নই ওঠে না। সেখানে প্রাকৃতিক ঋতুবৈচিত্র্য নেই, স্থান-কালের তফাৎ নেই। এখানে যে-বোধ আছে তাকে বলা যায় মানবিক-বোধ। তা সচেতন নয়–সুপ্ত। একে বলা যায় Radical Humanism বা মৌল মানবিকতা। একে সযত্নে লালন করলে, সচেতনভাবে এর পোষকতা করলে পাই Rational Humanism বা বোধিসম্পন্ন মনুষ্যত্ব। এ মনুষ্যত্বের কাছে কালিক, ভৌগোলিক কিংবা সামাজিক বাছ-বিচার নেই। মৌল মানবিকতা বীজ হলে মনুষ্যত্ব হবে ফল। দেশ, কাল ও জাতিচেতনার ঊর্ধ্বে সর্বমানবিক, রসনিষ্যন্দী সাহিত্য এ বোধেরই সন্তান। যাতে মানুষ আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি। কারণ বিপুলা পৃথিবীর নিরবধি কালের মানস-সঞ্চয় নিয়ে এর কারবার। এ হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের পরিচয় করিয়ে দেয়। প্রাণের সাথে মিলায় প্রাণ। আবহমান কালের বুকে ধ্রুব হয়ে দাঁড়াবার কেরামতি থাকে এর। এক অবিচ্ছিন্ন যোগসূত্র দিয়ে এ খণ্ড-ক্ষুদ্র ও তুচ্ছকে সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে করে এক অদ্বয় চেতনার আবেশে মানুষ আনন্দলোকের অধিকার পায়, যেখানে দাঁড়িয়ে সে বলতে পারে এবং বলেও–এ জীবন মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধুলি, এখানে যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই। তখন সব সুন্দর এবং সুন্দর সর্বব্যাপী। তখন লোভে সুন্দর, ক্ষোভে সুন্দর, স্নেহে সুন্দর, প্রেমে সুন্দর, আনন্দে সুন্দর, বেদনায় সুন্দর। তখন দুবৃত্ত সুন্দর, নিপীড়িত সুন্দর, খল সুর, ছলও সুন্দর। তখন কেড়ে খাওয়া আর সেধে দেওয়া–দুই-ই সমান, দুই-ই অপরূপ। এমনি বোধের অধিকারী হলেই মানুষ হয় জীবনরসিক। তখন সে দৃশ্যজগতের সবকিছু থেকেই। কেবল আনন্দের উপাদানই পায়–সে-আনন্দে দৈবিক, মানবিক কিংবা আসুরিক বলে কোনো পরিমাণ বা স্তরভেদ থাকে না। একালের এক স্বীকৃত মহৎ লিখিয়ের মুখে তাই শুনি–আমি চোখ মেলে যা দেখলুম, চোখ আমার তাতে কখনো ক্লান্ত হলো না। বিস্ময়ের অন্ত পাইনি। চরাচরকে বেষ্টন করে অনাদিকালের যে অনাহত বাণী অনন্ত কালের অভিমুখে ধ্বনিত, তাতে আমার মনপ্রাণ সাড়া দিয়েছে; মনে হয়েছে, যুগে যুগে এ বিশ্ববাণী শুনে এলুম। আমি ভালোবেসেছি এ জগৎকে, আমি প্রমাণ করেছি এ মহৎকে। আমি কামনা করেছি মুক্তিকে।