জন্ম-মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষ যেমন বদলাচ্ছে, অর্থাৎ নতুন মানুষকে ঠাই ছেড়ে দিয়ে পুরোনো মানুষ বিদায় নিচ্ছে,;তেমনি মানুষের ভাষা, সাহিত্য, শিল্প আর ভঙ্গিও বহতা নদীর মতো চিরকাল গড়িয়ে চলেছে, চলেছে এগিয়ে। কাজেই তাদের কোনো স্থায়ী নিগড়ে বেঁধে স্থির রাখা যাবে না। এ সহজ সত্যটি মনে মেনে নিলে আর কোনো দ্বিধা থাকে না। কেননা পৃথিবীটা পুরোনো বটে, কিন্তু তার জনপ্রবাহ নতুন। তাই তার অধিবাসীদের চোখে এ ভুবন চিরনতুন। জীবনযাত্রায় তারা নতুনভাবে আবিষ্কার করে জগৎকে, অনুভব করে জীবনকে, রচনা করে ভবন, বিকশিত হয় জীবন। এ চলার পথের উল্লাস কিংবা যন্ত্রণা, জিজ্ঞাসা কিংবা অভিজ্ঞতা অভিব্যক্তি পায় তাদের কাজে, কথায় অথবা লেখায়।
অতএব মানুষের মনটি তাজা আর অনুভূতি মাত্রই চিরনতুন। এই পুরোনো বিলাসী জগতের প্রতিবেশ প্রাণে প্রাণে যে-সাড়া জাগায়, চোখে-চোখে সুন্দরের যে-অঞ্জন মেখে দেয় তাতে হৃদয়-মন মুখর হয়ে ওঠে। সে-ই উচ্ছল আবেগই প্রকাশ পায় কবিতায়–নতুন মানুষের নতুন অনুভবের আনন্দ-বেদনা নবতর ভাষায়, ছন্দে ও রূপকল্পে প্রকাশিত হবে–এ-ই তো বাঞ্ছনীয় এবং স্বাভাবিক। নতুন অনুভবে যদি তিলে তিলে নতুন হয়ে নতুন তাৎপর্যে ও লাবণ্যে জগৎ ও জীবনকে উপলব্ধি ও উপভোগ করা না গেল, তা হলে চকিত ও চমকৃত করার অসামর্থ্যে পুরোনো পৃথিবী মানুষের বাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে।
কেজো ও অকেজো সাহিত্য
জার্নাল কাব্য হয় কি-না কিংবা কাব্য জার্নাল হতে পারে কি-না এ নিয়ে তর্ক চলতে পারে। কিং নিরর্থক। কেননা, পরিণামে স্বীকার করতেই হবে যে জার্নালও সাহিত্য হয়, আর সাহিত্যও জার্নাল হতে পারে। এ-কথা এমন নিঃসংশয়ে বলতে পারছি, রবীন্দ্রনাথের শেষের দশ-বারো বছরের রচনার নজির সামনে রয়েছে বলেই।
এ যদি সত্য হয়, তাহলে জটিল কথার জাল না-পেতেই বলা যায় সাহিত্যের দুই তত্ত্ব দুইরূপ, একটি তার ব্যবহারিক ও প্রাত্যহিক দিক, অপরটি তার আত্মিক ও চিরন্তন রূপ। এমনকি শক্তিমানের হাতে পড়লে একাধারেই দুইরূপ–দুইতত্ত্ব পাওয়া যেতে পারে; শেক্সপীয়র-ভিক্টর হুগো-গ্যেটে-টলস্টয় ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে তার দৃষ্টান্ত রয়েছে। এবং বড়-ছোট সব লেখকেরই সার্থক রচনায় এর প্রমাণ কিছু কিছু মিলবে।
যেহেতু মানুষের কোনো আচরণই স্থানিক, কালিক ও ব্যক্তিক প্রভাব-নিরপেক্ষ নয়, সেহেতু প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে পারিবেশিক প্রভাব রচনায় না-থেকেই পারে না। সাধারণভাবে বলতে গেলে, চিন্তার উৎপত্তি ঘটে পরিবেশ থেকেই। Thought-provoke করাবার কারণ সবসময়ই আবেষ্টনীর মধ্যে ব্যাপ্ত থাকে। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে কোনো ভাবই নিরূপ-নিরপেক্ষ হতে পারে না, যেমন আগুন হতে পারে না নিরবলম্ব। কাজেই চিন্তার জাগরণ যখন আপেক্ষিক এবং তা পরিবেষ্টনী-উদ্ভূত–তথা সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্র-সংস্কারপ্রসূত অন্তত সে-সংস্কার সংপৃক্ত, তাহলে। মানবিক আচরণে নির্জলা নিরূপ-নিরপেক্ষ কিছু আরোপ করা অসম্ভব। এদিক দিয়ে যাচাই করলে আমরা দেখতে পাব যে মানুষের ভাব-চিন্তা-অনুভূতি বাহ্য প্রয়োজন, প্রেরণা বা উত্তেজনা জাত–তা স্কুলও হতে পারে, আবার এমন সূক্ষ্মও হয়, যা সচেতনভাবে ঠিক উপলব্ধি করা যায় না। কিন্তু অবচেতনার প্রভাবে অভিভূতি আনে। যা স্কুল তা বাহ্য প্রয়োজন মিটায়। যা সূক্ষ্ম ও পরোক্ষ তা দিয়ে ব্যবহারিক জীবনের কোনো কাজই হয় না হয়তো। যেমন কেজো কিছু হয় না ফুল বা পাতাবাহারের গাছ দিয়ে। কাজেই দেখা যাচ্ছে সাহিত্যও দুই প্রকার-কেজো আর অকেজো। অপ্রয়োজনের প্রয়োজন বোঝানো সহজ নয়, তেমনি অকেজো সাহিত্যের কার্যকরতা দেখানো কঠিন। তবে বলা যায়, জীবনে সুন্দরের যে-স্থান, মনে অকেজো সাহিত্যেরও সে-চাহিদা। আজ স্বার্থবুদ্ধির ফেরে পড়ে দুনিয়ার লোক কেজো সাহিত্যের অনুরাগী হয়ে উঠেছে। অকেজো সাহিত্যের নামে তারা চরম অবজ্ঞায় নাক সিটকায়। তাদের বক্তব্য অনেকটা এরকম : অন্নের কাঙাল চাষীর ধান-পাটের চাষই জীবনের ব্রত। কেননা ক্ষুধার অন্ন যোগাড় করাই তার লক্ষ্য। সে যদি ধান-পাট ক্ষেতে ফুলের বাগান করার শখ করে, তাহলে তা হবে তার পক্ষে আত্মহত্যার সামিল। তাকে আমরা বলব মূর্খ, বিকৃতবুদ্ধি কিংবা নির্বোধ। সে ঘৃণ্য। আজকের দিনে সমস্যা-বিমূঢ় কাঙাল মানুষ তাই কেজো সাহিত্যের পক্ষপাতী। তাদের মতে সাহিত্য-বিলাসের পরিবেশ পৃথিবীতে আজ দুর্লভ। তাই রসকৈবল্যাদর্শের প্রতি তারা মারমুখো। তারা সংখ্যাগুরু। কাজেই সবাই তাদের দাপটে কাবু-খামোশ হয়ে আছে।
তাই বলে অকেজো সাহিত্য আজও অনর্থক নয় এবং কোনোকালেই একেবারে নিরর্থক মনে হবে না। কেননা তেমনি নির্বুদ্ধিতা হবে রমনার্থীনে ধানচাষ করবার আয়োজন করলে। ধান-পাটের প্রয়োজন যতই গুরুতর হোক, ফুল-বাগানের সাথে তার তুলনা হতে পারে না যেমন তুলনা হয় না লোহায়-সোনায় ফুল-বাগানের বিরোধিতা যদি করতে হয়, তা হলে তা অসামর্থ্যের অজুহাতেই করব, অপ্রয়োজনের বলে নয়। ধান-পাটে জৈব-প্রয়োজন মিটে, ওটি চাষীরও জীবনের লক্ষ্য নয়–means to an end মাত্র। আমরা উপায়কেই লক্ষ্য ঠাওরেছি, আমাদের জীবনের বিড়ম্বনা এখানেই। ধান-পাট উপলক্ষ মাত্র–লক্ষ্য তো নিশ্চিত মানসানন্দ উপভোগ। বাগান সে চাহিদা। মিটায়। কাজেই যেখানে জৈব-প্রয়োজনের শেষ, মানস-আয়োজনের সেখানেই শুরু। অতএব, অকেজো সাহিত্য কেবল উঁচুস্তরের নয়, যথার্থ কাজেরও; কেবল উপভোগের. নয়, পরম উপকারেরও।