আমাদের রুচির বিকাশ হয়েছে, সৌন্দর্যবোধ সূক্ষ্ম হয়েছে। তাই আদ্যিকালীন কাব্যে নারীর রূপ-বর্ণনায় রূপ প্রত্যক্ষ করা দূরে থাক, মানবীকেই পাওয়া যায় না। অদৃষ্ট খঞ্জনের মতো আঁখি, বাজের চক্ষুসদৃশ নাসা, হেমকুম্ভ স্তন, মৃণাল ভুজ, রামরম্ভাতরুর মতো উরু, কামধনুর মতো জ্ব, তীরের মতো পক্ষ্ম, ঘটের মতো নিতম্ব, পদ্মের মতো পা, শকুনির ন্যায় গ্রীবা, পদ্মকোরকের ন্যায় নাভি, মেঘবর্ণ চুল, কুঁচবর্ণ রঙ, দ্বিতীয়ার চাঁদের ন্যায় কপাল, বিম্বফলের ন্যায় অধরোষ্ঠ, প্রভৃতি এমন কী সুপ্রযুক্ত উপমা যে স্মরণ মাত্র সুন্দরীর রূপ-লাবণ্য অন্তরে শেলসম বিদ্ধ হয়ে থাকবে? স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্রের রূপবর্ণন পদ্ধতি কী একালে টিকল? সুন্দরীর রূপ-মহিমা একালীন ভাষায় একবার দেখলে পিছন ফিরে আবার দেখতে হয় বা একবার তাকালে চোখ ফিরানো যায় না বা বারবার তাকাবার মতো রূপ বললে কী বর্ণনার আর কিছু বাকি থাকে! কিম্বা, খঞ্জন-হরিণ-পদ্মের উল্লেখ না করে পটল-চেরা কী টানা টানা চোখ বললে কী কিছু কম বলা হয়! রুক্ষ চুলের সঙ্গে মেঘের তুলনা চলে, কিন্তু কালো চুল নিশ্চয়ই মেঘের বর্ণ নয়, তার চাইতে ভ্রমরকৃষ্ণ, চুল তার কবেকার বিদিশার নিশা কিম্বা আলকাতরার, টেলিফোনের রিসিভারের, মোটরগাড়ির নয়া কালো টায়ারের বা প্লাস্টিকের কালো পাতের তুলনা আপাতত vulgar মনে হলেও অনেক বেশি সুপ্রযুক্ত। কাক পোষা পাখি নয় যে কাকচক্ষু বললেই বক্তব্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
অবশ্য পুরোনো রূপপ্রতীক মাত্রেই পুরোনো নয়, বেণীর সঙ্গে সাপের উপমা চিরনতুনই বটে! তেমনি চিরকালই উপমার অবলম্বন হয়ে থাকবে রাত্রির তমসা।
তাই বলে নতুন ভাব-চিন্তা-জ্ঞান-বস্তু পেলাম, অথচ নতুন অলঙ্কার তৈরি হবে না, এমন কথাই হতে পারে না। আগের কালে যেমন মানুষ নিজের জানা-ভুবন থেকে রূপ-প্রতীক সংগ্রহ করেছে, আজও তা-ই শুধু করা হচ্ছে। আগের মানুষের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার জগৎ আজকের চেয়ে অনেক ছোট ছিল, তাই তার ভাষণে থাকত পরিমিত ও স্বল্প-পরিচিত এমনকি কল্পজাত রূপ প্রতীক। আজকের মানুষের পায়ের নিচে বিশাল ভুবন, মাথার উপরে বিস্তৃত জগৎ। আজ এদের সঙ্গে তার পরিচয় কত ঘনিষ্ঠ, কত স্পষ্ট! সে মুখ খুললেই কত কথা, কত চিত্র, কত রূপপ্রতীক এসে ভিড় জমায় স্মৃতির সরণিতে–জিহ্বার ডগায়, এদের সে অস্বীকার করে কীভাবে! কাকে ছেড়ে কাকে নেবে তা-ই দাঁড়ায় সমস্যা হয়ে! শুধু কী তাই, নতুন সূর্যের উদয়ে নতুন ভাব-চিন্তা আসবেই, তাকে রোধ করবে–সাধ্য কার! রবীন্দ্রনাথও পয়ার-ত্রিপদীতে অনেক কবিতা রচনা করেছেন, ছন্দ একই হওয়া সত্ত্বেও ভাবে, ভাষায়, অর্থব্যঞ্জনায় ও ধ্বনি-মাধুর্যে পূর্বেকার পয়ার ত্রিপদীর সঙ্গে কী এদের তুলনা চলে? ভাবের ও চিন্তার বৈচিত্র্যে যে বাকভঙ্গিরও পরিবর্তন ঘটে, এর চেয়ে আর উৎকৃষ্ট নজির আর কী দেওয়া যায়! আবার ভাব-চিন্তার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শুধু নবীনেরাই নন, রবীন্দ্রনাথও পয়ার-ত্রিপদী ছেড়েছিলেন। কাজেই প্রয়োজনমতো প্রতিষ্ঠিত আঙ্গিকও বদলায়।
লঙ্ঘিয়ে সিন্ধুরে প্রলয়ের নৃত্যে
ওগো কার তরী ধায় নির্ভীক চিত্তে।
চলন্ত নৌকার কী চমৎকার বর্ণনা! কিন্তু কোনো অরসিক যদি বলে বসে কাঠের তৈরি নৌকায় চিত্ত কোথায়! তবে তো সকলি গরল ভেল। তেমনি চোখ হাসে মোর, বুক হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে–তখন আমদের কানে-মনে খটকা লাগে না। প্রশ্ন জাগে না যে খুন নাচতে পারে, হাসে কী করে? আকাশ আচ্ছন্ন করে মেঘ উঠলে তাকে নারীর এলোচুল বলতে আপত্তি থাকে না।-কে এসেছে কেশ এলায়ে কবরী এলায়ে? কিন্তু জীবনানন্দ দাস যখন লেখেন– রৌদ্র মাথা রেখে ধানক্ষেতে শুইয়ে আছ তখন আমাদের অবজ্ঞার অন্ত থাকে না। কিন্তু ভেবে দেখি না যে, আমাদের অতিপরিচিত একটি পুরোনো ভালো ইংরেজি কবিতায় অর্থাৎ Keats-এর Ode to Autumn-এধরনের প্রতীকই ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন–The (Autumn) sitting careless on a granary floor on a half reaped furrow. sound asleep Steady they laden head across a brook by a ciderpress, with patient look thou watchest the last oozings hours by hours to
আবার পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে উপমার এখন দেখছি আদর-কদর বেড়েই চলেছে। তাজমহল যখন কালের কপোলতলে একবিন্দু নয়নের জল কিংবা মেঘদূত কাব্যে মেঘ দূতরূপে বর্ণিত হয়, কিংবা অব্যক্ত ধ্বনির পুঞ্জ অনুভূত হয়, তখন আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে না। কিন্তু উনিশ শতকে হলে জাগত!
আসল কথা, নতুন কিছু কানে-মনে খাপ খাওয়ানো সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রায় অসাধ্য। তাই কেউ সমকালীন সমাজে নতুন কিছু করে স্বীকৃতি পায় না। কিন্তু উত্তর-পুরুষ ঐ আওতায় লালিত হয় বলে তার কাছে এককালের বেয়াড়া নতুনও গা-সহা এবং কান-সহা হয়ে ওঠে শুধু নয়, রস কল্পনার সহায়কও হয়ে উঠে।
আজকের দিনে ঝলসানো রুটিস্বরূপ চাঁদ, বোমা, টর্পেডো, শুটনিক (এমনকি লাইকাও), কুইসলিং প্রভৃতি আমাদের রচনার রূপপ্রতীকরূপে ব্যবহৃত না হয়ে যেমন পারে না; তেমনি আমাদের নতুনতর ভাব, চিন্তা ও দৃষ্টির প্রভাবে বাকভঙ্গিও বদলাবে, তার সঙ্গে বদলাবে আটপৌরে ব্যবহারের শব্দের ব্যঞ্জনাও। বিবেকে বৃশ্চিক দংশন বা বিছার কামড় যদি সম্ভব হয়, তাহলে হৃদয় আমার ছেঁড়া কাঁথা আর তুমি তার মাঝে ছারপোকা–আজ যতই vulgar মনে হোক, আমাদের উত্তরপুরুষদের কাছে তা কদর পাবে। আগেকার যুগের রূপপ্রতীকগুলো বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে, বহু অদ্ভুত প্রতীক আমাদের চিত্তবিনোদনের সহায়ক হয়েছে,–চাঁদপানা মুখ যখন বলি তখন আমরা চাঁদের প্রভাটাই নিই, চাঁদের থালা-আকৃতি বাদ দিই। যোগ-বিয়োগ এত সহজ-সাধ্য নয়, অভ্যাসবশে যত সহজভাবে আমরা উপলব্ধি করি। রবীন্দ্রনাথের কৃপণ কবিতার রথী রাজভিখারিটি কোনো বাস্তব চিত্রের সঙ্গে মেলে না, কাজেই বাস্তব প্রতীক হতে পারে না, তবু ভালো কবিতা বলে এটি কদর পেয়ে আসছে।