রূপকথা অচল হল, উপকথা উবে গেল, পুরাণ তলিয়ে গেল; কারণ তাদের কাঠামো যে উপাদানে তৈরি, ভোজবাজির মতো মন থেকে মুছে গেল সে-সব। তাই আজকের দিনে আর রূপকথা তৈরি হয় না, উপকথা বলবার লোক নেই, পুরাণ শুনবার ধৈর্য নেই। মানুষের যুগযুগান্তর লালিত বিশ্বাস ও সংস্কার ভেঙে চুরমার হল। আদি বা মধ্যযুগের সে-জগৎ নেই, তাই সে-জীবনও, নেই, তাতেই সে-সাহিত্য-শিল্প আর ধর্মবোধও নেই।
নতুন বিশ্বাসের অবলম্বন খুঁজে পেল, তাই নিয়ে সে নতুন করে গড়ছে স্বপ্নসৌধ, সাধের জগৎ, শখের ইমারত আর গরজের বুরুজ।
.
০৩.
স্থানিক, কালিক আর পাত্রিক বিবর্তনে সাহিত্যের রসকল্পে নয় শুধু, রূপকল্পেও পরিবর্তন আসতে বাধ্য। বলেছি, মানুষের জীবনের তথা সাহিত্যের আদি ও মধ্য স্তর ছিল অজ্ঞতার যুগ; তাই কল্পনা, বিস্ময় এবং উচ্ছ্বাসই ছিল সাহিত্য-দেহের হাড় ও প্রাণ। কল্পনায় ভাটা পড়লে কল্প-সৃষ্ট বস্তুর মূল্য কমে যাবেই, বিস্ময় উবে গেলে বিস্ময়ের অবলম্বনও বাজে হয়ে যায়, আর কল্পনা-রূপ আধার না থাকলে আধেয় বিস্ময়ও পায় লোপ, কাজেই বিস্ময়জাত উচ্ছ্বাসের জন্মউৎসই যায় শুকিয়ে। আর এসবকিছুর উৎস ছিল হৃদয়বৃত্তি এবং তজ্জাত বোধি। মুক্তবুদ্ধি পাত্তা পায়নি সে যুগে।
বলেছি, উচ্ছ্বাসের সঙ্গে অতিভাষণের যোগ নিত্যকালের। আগে ছন্দের পরিপ্রেক্ষিতে এ উক্তি যাচাই করা যাক। সমিল ছন্দের খাতিরে আমাদের সবসময় ভাব প্রকাশের পক্ষে অপ্রয়োজনীয়, এমনকি অবান্তর কথা যোগ করে দিতে হয়। মনে করা যাক, একটি চরণে একটি ভাব প্রায় অভিব্যক্তি লাভ করেছে, শুধু একটিমাত্র শব্দ বাকি। কিন্তু যেহেতু চরণে আর জায়গা নেই, সেজন্যে একটি শব্দ প্রয়োগের গরজে আমাকে একটি পুরো চরণ তৈরি করতে হয়। ফলে কতগুলো অপ্রয়োজনীয় শব্দ শুধু ধ্বনি ও ছন্দ রক্ষার খাতিরে জুড়ে দিতে হয়। উচ্ছ্বাসের ভাষা যেমন :
১. হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মতো
নাচেরে হৃদয় নাচেরে
২. আজি এ প্রভাতে রবির কর কেমনে পশিল প্রাণের পর
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান।
৩. এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর।
পুণ্য হল অঙ্গ মম, ধন্য হল অন্তর
সুন্দর হে সুন্দর। ….
এই তোমার পরশ-রাগে চিত্ত হল রঞ্জিত,
এই তোমারি মিলন-সুধা রইল প্রাণে সঞ্চিত।
৪. আমার যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি
আমার যত বিত্ত প্রভু, আমার যত বাণী–
আমার চোখের চেয়ে দেখা আমার কানের শোনা,
আমার হাতের নিপুণ সেবা, আমার আনাগোনা।
৫. আজি কী তোমার মধুর মূরতি হেরিনু শারদ প্রভাতে
হে মাতঃ বঙ্গ শ্যামল অঙ্গ ঝলিছে অমল শোভাতে।
মাঝখানে তুমি দাঁড়ায়ে জননী শরৎকালের প্রভাতে
ডাকিছে দোয়েল গাহিছে কোয়েল তোমার কানন সভাতে।
৬. তোমার ছুটি নীল আকাশে, তোমার ছুটি মাঠে,
তোমার ছুটি থইহারা ওই দিঘির ঘাটে ঘাটে।
তোমার ছুটি তেঁতুল তলায়, গোলাবাড়ির কোণে,
তোমার ছুটি ঝোপে ঝাপে পারুল ডাঙার বনে।
মানুষের জ্ঞান-প্রজ্ঞা বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষ হৃদয়বৃত্তির আশ্রয় ত্যাগ করে বুদ্ধিবৃত্তির নিশ্চিত স্মরণ নিয়েছে। আজকের মানুষের বুদ্ধিনির্ভর। হৃদয়-ধর্ম জল-শোধন যন্ত্রের মতো বুদ্ধিকে আশ্রয় করে, বলা যায়-বুদ্ধির দ্বারা শোধিত হয়ে প্রকাশিত হয়। এভাবে মিতালি ঘটেছে মন মস্তিষ্কের। আবেগও তাই উদ্বেগ বলে ভ্রম জন্মায়। মানবসভ্যতার তথা সাহিত্য-শিল্পের ক্রমবিবর্তনের ধারা এভাবে লক্ষ্য করেছিলেন বলেই লর্ড মেকলে সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পুরানো রীতির কবিতার অপকর্ষ ঘটবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করেছিলেন।
বুদ্ধিবৃত্তিতে উচ্ছ্বাসের ঠাঁই নেই। কাজেই আমাদের কাব্যকলার ছন্দে ও বাক-পদ্ধতিতে পরিবর্তন না এসে পারে নি। বুদ্ধি লব্ধ তথ্য, বুদ্ধি-নির্ভর ভাষণ চটুল হতে পারে, সরস হতে পারে, বিদ্রুপাত্মক হতে পারে; দীপ্ত হতেও বাধা নেই, কিন্তু ললিত-মধুর, আবেগ-বিভোল হতে পারে না। নূপুরের দিন নেই, কাজেই শিঞ্জন শোনার আশা বিড়ম্বিত হবেই।
তাই আজকের কবিতা তথাকথিত ছন্দ বিহীন।
.
০৪.
শারীর প্রেমের উপর আগের যুগে মানুষ Divinity বা দিব্যতা আরোপ করে একপ্রকার আত্মবঞ্চনামূলক আত্মপ্রসাদ লাভ করত। যদিও মনে জানত–এ ফাঁকি, তবু মহত্ত্ব ও দিব্যতা আরোপ করে, একে নির্বিশেষ ভাবলোকে স্থাপিত করে, এর মহিমা ঘোষণা করে নিজেদের মহিমান্বিত করে তুলত। এতে সুখ ছিল কিনা জানিনে, তবে মুখরক্ষা হত! এ-যুগের বিজ্ঞান সব রহস্য বেফাঁস করে দিয়ে বলল, প্রেম আকাশের নয়, নিতান্ত পঙ্কজ। খগজ প্রেম শুধু ভুইয়ে লুটিয়ে পড়ল, তা নয়; বিজ্ঞান জানাল–এটা হচ্ছে জীবনের প্রবলতম প্রবৃত্তি, বিশেষ বয়সের ধর্ম, এবং সৃষ্টি প্রক্রিয়ারই অঙ্গ, একান্তই প্রাকৃতিক নিয়মের ফল। বিশেষ বয়সের পূর্বে বা পরে–অপর জীবের তো নয়-ই,–স্বাভাবিক মানুষেরও তা থাকে না। প্রেম-মহিমা তাই আর কথার সাগর মন্থন করে শব্দ চয়ন করে যোচ্ছাসে গাওয়া চলে না। তেমনি ভূতে যার বিশ্বাস নেই, তাকে ভূতের ভয় দেখাননা যায় না।
পুরোনো বিশ্বাস-সংস্কার যখন মিথ্যে হয়ে গেল, তখন পুরোনো রূপপ্রতীক কী সত্য থাকতে পারে? চাঁদ-সূর্যের গোপন তত্ত্ব জানার পরে তাদের সেবাকালীন স্বরূপে রূপপ্রতীক সৃষ্টি করা কী চলে? চকোর দেখিইনি, কাজেই চাঁদ-চকোরের উপমা দিতে আমার যুক্তি-বুদ্ধি বাধা দেবেই। ক্ষীণ মাঝার সঙ্গে কেশরী বা চুলের উপমা শুধু সেকালেই চলতে পারত; যেকালে বিশাল নথও নাকে শোভা পেত, পুরুষের কানে কুণ্ডল আর হাতে বালা মানাত ও পাজব-চন্দ্রহারে নারী লোম লাবণ্যে ললনা হয়ে উঠত!