Site icon BnBoi.Com

বিচিত চিন্তা – সংস্কৃতি চিন্তা – আহমদ শরীফ

বিচিত চিন্তা - আহমদ শরীফ

 ঐতিহ্যবোধ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র

এতকাল ধরে মানুষ ঐতিহ্যবোধের মহিমা কীর্তন করে এসেছে। ঐতিহ্য-চেতনা মানুষকে এগিয়ে চলার বা আত্মোন্নয়নের প্রেরণা দেয়, এ তো সবারই জানা কথা। কেননা এ অনুভূত সত্য–সেদিক দিয়ে কম-বেশি স্বতঃসিদ্ধ। পূর্বপুরুষের গৌরব থাকলে মানুষ তা বজায় রাখার এবং গ্লানি থাকলে তা আত্মপ্রতিষ্ঠার তথা কৃতির ও কীর্তির গৌরব দিয়ে ঢেকে রাখার কিংবা মুছে ফেলার প্রেরণা বোধ করে–এ-ই সাধারণের বিশ্বাস। কাজেই জীবনে প্রেরণার উৎসরূপে মানুষ পারিবারিক ও জাতীয় ঐতিহ্য স্মরণে রাখবার ও আচরণে প্রকাশ করবার প্রয়াস পায়। তাই ঐতিহ্য ও ঐতিহ্যবোধ মানুষের কাছে খুব মূল্যবান। একে ব্যক্তিক ও জাতিক জীবন-সাধনায় প্রেরণার উৎস, কর্মপ্রচেষ্টার ভিত্তি ও জীবনযাত্রার অবলম্বন হিসেবে গুরুত্ব দেয়া হয়। কিন্তু সম্প্রতি এর নতুন মূল্যায়নের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। নতুন দৃষ্টির তৌলে একে যাচাই করে এর ওজন, উপযোগ ও মূল্য নির্ধারণ হয়ে উঠেছে অপরিহার্য। কেননা আজকাল এটিই মানুষের মনোবেদনা ও মানসিক লাঞ্ছনার অন্যতম প্রধান কারণ। এককালের অমৃত একালে বিষে পরিণতি লাভ করছে, সেকালের বর একালে শাপে রূপান্তরিত হচ্ছে। কেন এবং কেমন করে তা-ই বলছি।

আগেরকার দিনে সাধারণত ধর্মীয় গোষ্ঠী ও গো-চেতনা ছিল, আর ছিল রাজা ও রাজ্য। কাজেই সে-যুগে অধিকাংশ দেশে বা রাজ্যে নির্বিশেষ ও অবাধ নাগরিকতা (সিটিজেনশিপ) ছিল না। রাজা যে-মতে বিশ্বাসী ছিলেন, সে-মতবাদীরাই ছিল দেশের বা রাজ্যের শাসকজাতি। অন্যেরা ছিল শাসিত। কাজেই বিভিন্ন ধর্ম বা মতবাদীর মিলনে এক জাতি গড়ে উঠতে পারেনি। এরূপ ক্ষেত্রে স্ব স্ব ঐতিহ্য-প্রীতি বিভিন্ন জাতিগুলোকে নিজেদের বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখবার প্রেরণা দিত। এ চেতনা শাসক-শাসিতে কিংবা বিভিন্ন ধর্মবাদী প্রতিবেশীতে দ্বেষ, দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সৃষ্টির কারণ হত বটে; কিন্তু স্বাজাত্যাভিমান ও স্বাতন্ত্রবোধ তাতে আরো প্রবল ও প্রখর হয়ে উঠত। ফলে দৈহিক, মানসিক ও আত্মিক শক্তি সঞ্চয়ের প্রতিদ্বন্দ্বীসুলভ আকাঙ্ক্ষাও হত তীব্রতর। ইত্যাকার উত্তেজনা ও উদ্দীপনা জাতিগুলোকে অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করত। একসময়ে দাসত্ব-মুক্তও করত। অবশ্য বৈষয়িক ক্ষতি ও পীড়ন থেকে বাঁচতে পারত না। যাহোক সে-যুগ আর নেই, কাজেই সে-যুগের সমস্যাও নেই। কিন্তু তার জের রয়ে গেছে। সে-কথাই এখানে আলোচ্য।

আগেকার যুগে জাতীয়তার ভিত্তি ছিল ধর্ম, বর্তমান যুগে হয়েছে রাষ্ট্র এবং এটি একান্তভাবে রাষ্ট্রান্তর্গত ভূ-নির্ভর। কাজেই আজকের জাতি গড়ে ওঠে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী, মতবাদী ও নানা গোত্রীয় লোকের সমবায়ে। ফলে সাধারণ না হলে কোনো মত, আদর্শ, ঐতিহ্য কিংবা নীতি সর্বজনগ্রাহ্য হওয়া সম্ভব নয়। কেননা প্রত্যেক মানুষের স্ব স্ব ধর্ম, ঐতিহ্য ও গোত্রপ্রীতি রয়েছে, আরো রয়েছে পরশ্রীকাতরতা। সেজন্যে একের ধার্মিক, ঐতিহ্যিক ও গৌত্রিক আদর্শ ও সংস্কৃতির প্রতি অপরের স্বাভাবিক বিরূপতাও আছে। একেরটা অপরে পসন্দ করে না, তাই সহ্যও করতে চায় না।

তাই কোনো প্রবল পক্ষ যদি নিজের ধার্মিক কিংবা সাংস্কৃতিক আদর্শ অন্যদের উপর নিছক ভোটের জোরে চাপায়, তাহলে অন্যদের মন ভাঙে। সেই মনঃপীড়া কায়িক নির্যাতনের চাইতে গুরুতর এবং তাতে যে-ক্ষতি হয় তার সঙ্গে কোনো ব্যবহারিক ক্ষতির তুলনা হয় না। কেননা মানুষ ধনে-প্রাণে মরতে রাজি হলেও হতে পারে, কিন্তু মনে মরতে কখনো প্রস্তুত থাকে না।

কয়েকটি দৃষ্টান্ত নেয়া যাক। জার্মানির ইহুদীদের অন্য কোনো স্বদেশ ছিল না, তারা পুরুষানুক্রমে জার্মান। জনে না হলেও ধনে-মানে তারাই ছিল প্রবল ও প্রধান। কিন্তু সংখ্যাগুরু খ্রীস্টান জার্মানদের কাছে তাদের ধার্মিক ও ঐতিহ্যিক প্রতিপত্তি ছিল না। তাই তারা ছিল মনে কাঙাল। স্বদেশ ও রাষ্ট্রিক স্বজাতির প্রতি তাদের জাগে বিদেশী ও বিজাতিসুলভ বিরূপতা। ফলে জার্মানির স্বার্থ আর তাদের স্বার্থ এক রইল না। প্রথম মহাযুদ্ধে তাই তারা চরম আত্মরতি ও দেশদ্রোহিতা দেখিয়েছে। তবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, মূলত দোষ এদের নয়; দোষ আবেষ্টনীর ও সংখ্যাগুরু খ্রীস্টান জার্মানদের। স্বতন্ত্র ধর্ম, সংস্কৃতি ও গৌত্রিক ঐতিহ্য-প্রীতিই ইহুদীদের মনে, দেশের প্রতি বিরাগ জাগিয়েছিল।

ধর্মনিরপেক্ষ ভারত-রাষ্ট্রে প্রবলপক্ষের ঐতিহ্যানুগ পতাকা ও লাঞ্ছন গ্রহণ আর বিশুদ্ধ হিন্দিবরণ অহিন্দু ভারতবাসীর মনে নিশ্চয়ই বিরূপতা সৃষ্টি করেছে। যদি রাষ্ট্রের পতাকা চরকা চিহ্নিত হত কিম্বা লাঞ্ছনটি হিন্দুর ধর্ম ও ঐতিহ্য-নিরপেক্ষ হত অথবা গান্ধীজীর হিন্দুস্তানী রাষ্ট্রভাষারূপে গৃহীত হত, তাহলে অহিন্দুও আন্তরিকভাবে হিন্দুর স্বজাতি ও স্বদেশী হয়ে উঠতে পারত। যাদের সহজে আপন করা যেত, এভাবে সংখ্যাগুরুর আত্মরতির ছিদ্রপথে তারা হয়ে রইল পর। কোনোকিছু বিশেষ এক পক্ষের ঐতিহ্যিক কিংবা সাংস্কৃতিক প্রেরণার উৎস হলেই বুঝতে হবে তা অপর পক্ষগুলোর বেদনার কারণ হয়েছে। এ তো নেহাত সহজবোধের কথা। কেননা একে যেখানে নিজের গোত্রীয় গৌরবময় ঐতিহ্যের ও আদর্শের সন্ধান পেয়ে সগর্বে জেগে উঠে, অপরে সেখানে নিজেদের খুঁজে না পেয়ে, নিজেদের আগ্রহ ও আবেগের অবলম্বন না পেয়ে হতাশ হয়। রাষ্ট্রিক, শাসনতান্ত্রিক কিংবা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কোনো একপক্ষের গোত্রীয় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা থাকলে সুইটজারল্যান্ড কোনোক্রমেই এমন উদার ও আদর্শ রাষ্ট্র হতে পারত না। সে অবস্থায় হয়তো গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে দেশটি টিকতই না। অথচ সেদেশে যারা বাস করে তাদের কারুর কারুর দুই থেকে আড়াই হাজার বছরের পুরোনো বিশ্বনন্দিত ঐতিহ্য রয়েছে।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল কথা অধিকারের সমতাবিধান–সে সামঞ্জস্য অবশ্যই মানসিক হওয়া চাই। সমাজ ও শাসন সংক্রান্ত আদর্শের বিভিন্নতার কোনো বিশেষ মানস প্রতিক্রিয়া নেই–কারণ, তা একান্তভাবে দলভিত্তিক। একই পরিবারের বিভিন্ন পরিজন বিভিন্ন দলভুক্ত থাকতে পারে। কিন্তু ধর্ম, ঐতিহ্য প্রভৃতি বিষয়ে মানুষের Sentiment ভিন্ন প্রকৃতির এবং মানুষের মানস-সত্তায় এর প্রভাব অপরিমেয়। কাজেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দলীয় রাজনীতি ও আদর্শ চলতে পারে, কিন্তু কোনো একপক্ষের ধর্মীয় ও গোত্রীয় আদর্শ কিংবা ঐতিহ্যের আধিপত্য চলতে পারে না। এ-যুগে রাষ্ট্রের দুর্বলতা ও সর্বনাশ যদি কোথাও লুকিয়ে থাকে তবে তা এই ধর্ম, গোত্র ও ঐতিহ্যপ্রীতিপ্রসূত গোঁড়ামির মধ্যেই। এতে অগ্রগতি এবং উন্নতিও ব্যাহত হয়। এ-যুগে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যা-কিছু হবে, তা সর্বজনীন আগ্রহ ও আবেগের প্রতীকই হবে। নইলে মানস-দ্বন্দ্বের আর তার থেকে বিপদকালে বিপদ বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকবেই। কাজেই এ-যুগের সাধনা পুরাতনের নিছক জের টানাতে নয়, নতুনেরও প্রতিষ্ঠায়—-নিছক ঐতিহ্যানুসরণে নয়, ঐতিহ্য সৃজনে। এ-যুগের শান্তি ও নিরাপত্তা কোনো বিশেষ গোত্রের গৌরববোধে নেই, রয়েছে রাষ্ট্রভিত্তিক জাতি গড়ে তোলার মধ্যেই। আর এক হিসেবে সর্বজনীন মিলনক্ষেত্রে স্ব স্ব গোত্র ও ঐতিহ্যপ্রীতির উগ্র প্রকাশ সংকীর্ণতা, আত্মরতি ও আদিম গোত্রীয় মনোভাবেরই পরিচায়ক। এটি পশ্চাদুখিতারও প্রমাণ। পরমতসহিষ্ণুতা ও উদারতাই এ-যুগের সাধ্য। ক্ষতি স্বীকারের শক্তিতেই মনুষ্যত্বের প্রকাশ, আর বরণ করবার সামর্থ্যেই সংস্কৃতির পরিমাপ। আছে তো রইলই, যা নেই তা অর্জনের প্রয়াসই তো জীবন-সাধনা। প্রাণের স্ফূর্তি, মনের মুক্তি এবং মানের বৃদ্ধি এভাবেই সম্ভব, আর এ-যুগে তা প্রয়োজনও। এ-যুগ স্বাতন্ত্রবোধের নয়, সাকুল্য বোধের–বিযুক্তির নয়, সংযুক্তির। আভিজাত্য গর্বের নয়, গণসংযোগের। ব্যষ্টির নয়, সমষ্টির। পুরোনো দিয়ে ঘট ভরে রাখলে নতুনকে কিছুতেই ঘরে তোলা যাবে না। তাই জীর্ণ পুরোনোকে বর্জন করে সার্থক নতুনকে গ্রহণ করার প্রস্তুতি চাই। ঐকিক মৌলিকের মাহাত্ম্য যা-ই থাক না কেন, এ-যুগে মানব-মহিমা যৌগিক সামগ্রিকতায় অভিব্যক্ত। ব্যষ্টির বাসনা নয়, সমষ্টির প্রয়োজন মিটানোই যুব্রত। জনে জনে জনতা হয় বটে কিন্তু তা অকেজো; গণভোটে হয় গণনেতা, তার শক্তির সীমা নেই।

ব্যক্তিক স্বার্থ আলাদা হওয়া সত্ত্বেও যেমন প্রীতিপূর্ণ পারিবারিক ও সামাজিক যৌথজীবন অকৃত্রিম এবং বাস্তব; তেমনি ধর্ম, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি পৃথক হলেও ভেদবুদ্ধিহীন একক রাষ্ট্রিক জাতীয় জীবন গড়ে তোলা সম্ভব।

জীবনবোধ ও সংগ্রাম

মানুষের যাযাবর বৃত্তি আমাদের কৌতূহল জাগায়, আকৃষ্ট করে, এমনকি বিস্মিত করে অনেক সময়। অথচ জীবের চলমানতা একটি স্বাভাবিক বৃত্তি। তবু যে এটি আমাদের আকৃষ্ট করে, তার কারণ হয়তো এই বাহ্য-পরিচয়ের গভীরে একটি প্রবল উদ্ভিদ-স্বভাব রয়েছে আমাদের যাকে ঠিক জড়তা বলা চলে না। উদ্ভিদ যেমন সজীব হওয়া সত্ত্বেও মাটি বা জল আঁকড়ে হতে চায় দৃঢ়মূল ও নিশ্চল, প্রাণীজগতেও আমরা তেমনি দেখতে পাই স্থায়ী নিবাসের তীব্র আগ্রহ। মানুষের আদর্শ, উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যও এই নিশ্চিন্ত স্থায়িত্বকামী মনের আকাক্ষাপ্রসূত। আমরা কেবল ধরে রাখতে চাই, ভরে তুলতে চাই, হারাতে চাইনে কিছুই, ফেলতে চাইনে ভালোলাগা কিছুকেই। আমাদের অমরত্ব কামনার উৎসও এখানেই। আত্মার চিরন্তনত্বের ধারণাও গড়ে উঠেছে এই আত্যন্তিক স্থায়িত্ব কামনা থেকেই। জীবের সন্তান কামনা এই স্থায়িত্ব-লোভ তথা অমরত্ব বাঞ্ছার বিকল্প রূপ।

এ কারণেই কোনো বস্তুর দীর্ঘস্থায়িত্বের সম্ভাবনা না থাকলে আমরা উৎকণ্ঠা কিংবা অশ্রদ্ধা পোষণ করি মনে মনে। ভারতীয় বৌদ্ধমত ও মায়াবাদ এই উৎকণ্ঠা, অস্বস্তি ও অশ্রদ্ধারই অভিব্যক্তি। এজন্যেই জানা অতীত ও নিশ্চিত বর্তমানের প্রতি আমাদের এত আস্থা ও আকর্ষণ, আর অজানা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের প্রতি শঙ্কিত দৃষ্টি। পুরোনো-প্রীতি ও নতুন-ভীতির মূল এখানেই। তাই আমাদের জীবন-সাধনা তথা জীবনে সাধ্য হচ্ছে স্থায়িত্ব, নিশ্চয়তা ও নির্ঘাকি নির্বিঘ্নতা। এ-ই হচ্ছে মানুষের তথা জীবের সচেতন জীবন-প্রচেষ্টা। আর অবচেতন আকাঙ্ক্ষা যার নাম দেয়া যায় ঔৎসুক্য হচ্ছে নতুনকে চাওয়া ও পাওয়া। যাযাবর বৃত্তির মধ্যে এই নতুন প্রীতি তথা adventure-প্রবণতাই ক্রিয়াশীল। আমাদের অবচেতন-লোলুপতা যাযাবর তথা বেপরওয়া জীবনের পরিপোষক। তাই জীবনের স্বরূপ–সুনিশ্চিত ও স্থির-লক্ষ্য জীবন-প্রচেষ্টায় রূপায়িত কিংবা অনিশ্চিত দ্বান্দ্বিক জীবন-জিজ্ঞাসায় প্রকটিত, তা এককথায় বলা যায় না নিঃসংশয়ে।

তবে বাহ্যত নিশ্চিত আশ্রয় সন্ধান জৈবধর্ম হলেও মানুষের অন্তরতম প্রদেশে যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত-প্রীতি রয়েছে, তা অস্বীকার করবার উপায় নেই। আমরা দেখছি, মানুষের মধ্যে যে সহজ প্রাণশক্তির অধিকারী ও যে আত্মপ্রত্যয়শীল, সে আত্মপ্রসারে উনুখ ও উদ্যোগী। আত্মপ্রসার করতে চাইলেই নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত জীবনে স্বেচ্ছায় বরণ করতে হয় দ্বন্দ্ব ও সংঘাতকে, নিতে হয় বাঁচামরার ঝুঁকি। যেমন, রাজা সুখে রাজ্য করছেন হঠাৎ তার বুকে জাগল আত্মশক্তি সম্বন্ধে দৃঢ়প্রত্যয়, মাথায় চাপল সে-শক্তি প্রকাশের খেয়াল। তাকে ঘাড়ে ধরে চালিত করে পর নিপীড়নের ভূত। বাঁচা-মরার ঝুঁকি নিয়ে বিচিত্র উল্লাসে তিনি চালান অভিযান। আত্মশক্তিতে আস্থা এবং অপরের দুর্বলতার সন্ধানই তার কাছে আত্মবিস্তারের ও আত্মপ্রতিষ্ঠার সুযোগ। সে-সুযোগ তাকে নামায় দ্বন্দ্বে ও সংঘাতে! কাজেই সংগ্রামে সামর্থ্যই তাঁর মতে সুযোগ। সংগ্রামই তাঁর কাছে জীবন-প্রচেষ্টা, সংঘাত সৃষ্টিই জীবন-সাধনা; জয়েই জীবনের উল্লাস, বিকাশ ও বিস্তার; সাফল্যেই স্বপ্রতিষ্ঠা ও সার্থকতা। আর দ্বন্দ্ব-ভীরু সাধারণ মানুষের কাছে সুযোগ মানে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনুপস্থিতি। সাধারণ মানুষের এ পরিচয়-যে জীবনের ও প্রাণধর্মের বিকৃতরূপ, তার প্রমাণ মেলে আমাদের খেলায় ও সাহিত্যে।

খেলা মানেই কৃত্রিম দ্বন্দ্ব ও সংগ্রাম। প্রিয়-পরিজন নিয়েই খেলি আমরা। তাদেরই প্রতিপক্ষ করে সংগ্রাম করি আত্মপ্রতিষ্ঠায়। তাই হার-জিতে উপভোগ করি আনন্দ-বেদনা। খেলা অবসর বিনোদনের উপায়রূপে উদ্ভাবিত। কাজেই এ একান্তভাবে আনন্দের উপকরণ। তেমন উপকরণের স্বরূপ হচ্ছে দ্বন্দ্ব তথা প্রতিপক্ষতা, সহজ কথায় বিরোধ সৃষ্টি। মানুষের অবসর বিনোদনের আর একটি অবলম্বন হচ্ছে সাহিত্য। খেলা ও সাহিত্য একই প্রয়োজনে দু-কোটির সৃষ্টি। রূপকথার দৃষ্টান্ত নেয়া যাক। রাজপুত্তুর যদি অনায়াসে রাজকন্যে লাভ করে, তাহলে হতাশ হই আমরা। যেন রাজকুমারের যোগ্য হল না কাজটা। তাই তার পায়ে পায়ে বাধা, পথে পথে শুক্র। তাকে সাত সমুদ্দরে পাড়ি জমাতে হয়, তেরো নদী পার হতে হয়, আরো অতিক্রম করিতে হয় গিরি-মরু কান্তার। সে-পথে সাপ, বাঘ, দেও, জীন, যক্ষ-রক্ষঃ হয় বৈরী, ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী হয় সহায়। তাই তো কুমারের সাফল্যে আমাদের এত উল্লাস, এত তৃপ্তি। এজন্যেই তো সার্থক ট্র্যাজেডির নায়ক আমাদের এত প্রিয়। দ্বন্দ্ব ও সংঘাতমুখর সাহিত্যের এত কদর।

অতএব, সংগ্রামই জীবন। তাই দুর্বল মানুষ কৃত্রিম সগ্রামেই জীবনের চরিতার্থতা খোঁজে। ভীরুহৃদয়ের ভিখারী পিপাসা পর-পরাক্রমে মিটিয়ে নিয়ে সে লাভ করতে চায় আত্মপ্রসাদ। কাজেই নিশ্চয়তার প্রশ্রয়ে নিশ্চিন্ত আশ্রয়প্রীতি মানুষের স্বভাব নয়– স্বভাবের বিকৃতি।

তাই অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে সংগ্রাম অথবা জীবনযুদ্ধ কথাটি আক্ষরিক অর্থে সত্য নয়। কেননা ব্যঙ্গ্যার্থে জীবনই সংগ্রাম, অন্যকথায় সংগ্রামের মধ্যেই জীবন-রস নিহিত। এজন্যেই জীবন-রস রসিকের সগ্রামী না হয়ে উপায় নেই। আটপৌরে ব্যবহারে কথাটি বাচ্যার্থে তুচ্ছ এবং শব্দটির ব্যঙ্গ্যার্থ প্রায় লোপ পেয়েছে বটে কিন্তু এ কথাটি যতদিন আমরা স্বরূপে ও সদর্থে উপলব্ধি না করব, ততদিন জীবনের সত্যকার প্রসাদ থেকে বঞ্চিত থাকতে হবে আমাদের।

সাধারণভাবে চিন্তা করলেও দেখতে পাব, প্রতিকূল পরিবেশ ও শক্তির সঙ্গে সংগ্রামে জয়ী হয়েই জীবন-পথে এগিয়ে চলি আমরা। মাথায় চুল বাড়ে, হাতে-পায়ে গজায় নখ, মুখে জন্মায় দাড়ি–এসব অস্বস্তিকর প্রতিকূলতা যেমন জয় করি সুকৌশলে ও সুপরিকল্পিতভাবে, তেমনি রোদ বৃষ্টি-শৈত্যেও করে নিতে হয় আত্মরক্ষার সুব্যবস্থা। এসব আজ তুচ্ছ বটে; কিন্তু একদিন এসব প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা ছিল মানুষের বহু চিন্তা-ভাবনা ও চেষ্টার কারণ। এমনি করে প্রতিকূলতার সঙ্গে সগ্রাম করে আজকের স্বস্তি-স্বাচ্ছন্দ্য, যোগ্যতা ও প্রভুত্ব অর্জন করেছে মানুষ।

কাজেই সম্মুখগতি মানেই প্রতিকূল পরিবেশে চলার পথ করে নেয়া। আর এগিয়ে যাওয়া মানেই নতুনকে পাওয়া, বরণ করা, কিংবা জয় করা। তাই নতুন-ভীতি মাত্রই জীবনবিমুখতা। কোনো পুরোনোই পারে না নতুন দিনের পুরো চাহিদা মেটাতে। নতুন যদিবা অশ্চিয়তার মরু হয়, তবে পুরোনো নিশ্চিতই মরীচিৎকার মায়া। তাহলে মরীচিৎকার পিছু ধাওয়া নয়, মরু-উত্তরণের সাধনাই হওয়া উচিত কাম্য। আসলে কোনো নতুন ভাব, চিন্তা বা বস্তু মানুষের অমঙ্গলের জন্যে আসেনি। নতুনই তো চিরকাল এগিয়ে দিয়েছে মানুষের মানস-সংস্কৃতি ও ব্যবহারিক সভ্যতা। অতএব আমরা যে কেবল নতুন ভাব, চিন্তা ও আদর্শ গ্রহণ করব, তা নয়; নতুন দিনে সাহস ভরে মাথা পেতে নেব অনিশ্চিত জীবনের ঝুঁকি। নইলে জীবনের প্রসাদ থেকে, জীবনের উল্লাস-রস থেকে থাকব বঞ্চিত। এই জীবনচেতনা, এই জীবন-রস-রসিকতা, এই জীবন-জিজ্ঞাসা নিয়েই নির্ভয়ে ও নিঃসংশয়ে সাড়া দেব সর্বপ্রকার নতুনের ডাকে। সুস্থ ও স্বস্থ জীবন মাত্রই বহতা নদী।

পুরোনো দিনের অবসানে নতুন সূর্যের উদয়ে কেবল বিকৃতবুদ্ধি ও দুৰ্বলচিত্ত ব্যক্তিই মিয়মাণ হয় হারানোর বেদনায়, পাণ্ডুর হয়ে উঠে মৃত্যুর বিভীষিকায়। তারই পড়ে দীর্ঘশ্বাস; সে-ই কেবল বলে দিন গেল। আর যে প্রাণধর্মের তাগিদে চলে, সে মনে জানে দিন এল। একটার পর একটা দিন আসে, আর সে ভাবে এ বুঝি নতুন জীবনের তোরণে উত্তরণ।

জেহাদের স্বরূপ

কী করে কখন থেকে যে জেহাদ কথাটির অর্থ অমুসলমানের কাছে বিকৃত হয়ে গেছে, তার দিন ক্ষণ নির্ণয় করা সহজ নয়। জেহাদ বলতে তারা বিধর্মী-বিধ্বংসী মুসলিম বর্বরতাই বোঝে। এ বিরূপতা আজকের উন্নতমনা সংস্কৃতবান তরুণ-মনেও কিছুটা জেগেছে, বিজাতি প্রভাবে তারাও মুজাহিদ বলতে আসুরিক উত্তেজনা-সর্বস্ব ধর্মোন্মত্ত খুনীই বোঝে। এ নিশ্চিতই দুর্ভাগ্যের কথা।

কেননা  জেহাদ মুসলিম জীবনের অপরিহার্য অংশ। সেজন্যে জীবনের আর আর ব্রতের মতো জেহাদও তাদের সময়োচিত ব্রত। কথাটা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।

ইসলাম হচ্ছে প্রথমত এবং প্রধানত মানুষের পার্থিব জীবনের ব্যবহার বিধি। এর মধ্যে কোনো জটিলতা কিংবা অধ্যাত্ম-রহস্য নেই। দ্বৈতবাদই ইসলারে শিক্ষা : স্রষ্টা ও সৃষ্টি কেবল যে আলাদা তা-ই নয়, মানুষ ও আল্লাহর সম্পর্কও হচ্ছে বান্দা-মনিরে। বান্দার কাছে মনিবের নিজের জন্যে কিছুই কাম্য নেই। তিনি চান মানুষের পারস্পরিক ব্যবহার এমন হবে, যাতে কেউ কারো দুঃখ-বেদনা ও ক্ষতির কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি কোনো মর্ত্য-মানবের কোনো নালিশ না থাকে, তাহলে সে নিপাপ। আল্লাহর কাছে তার জবাবদিহির আর কিছুই থাকে না। ইসলামে বিশ্বাসের (ইমানের) সঙ্গে সঙ্কর্ম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। যা তোমার নিজের জন্যে কাম্য নয়, তা তোমার ভাইয়ের জন্যেও কামনা করো না। বেঁচে থাকো বাঁচতে দাও, ভালো চাও, ভাল কর–এই হচ্ছে ইসলামের শিক্ষা। কোরআনের সর্বত্র পার্থিব জীবনে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পারস্পরিক ঘরোয়া ও সামাজিক ব্যবহারের বিধিনিষেধই নির্দেশিত হয়েছে। অতএব ইসলাম মুখ্যত ব্যক্তিক ও সামাজিক জীবনবিধি (code of life)। জেহাদও এ বিধির অন্যতম অঙ্গ। পার্থিবতাই ইসলামের বৈশিষ্ট্য এবং অন্যান্য ধর্মের তুলনায় এর শ্রেষ্ঠত্বও এখানেই।

এবার আমরা জেহাদের গুরুত্ব ব্যাখ্যার চেষ্টা করব। যে-কোনো আদর্শবাদের জন্যে সংগ্রামই জেহাদ। এ যুগে ism–গুলো যেমন এক-একটি রাষ্ট্রনৈতিক ও সামাজিক জীবনাদর্শ, পার্থিবতা প্রধান ইসলামও তেমনি রাষ্ট্র ও সমাজ বিধান। তফাৎ এই, ইসলামে সার্বভৌম-শক্তি মানুষ নয়– আল্লাহ। এ যুগে হলে তা আল্লাহবিহীন একটি উৎকৃষ্ট ism হতে পারত। খ্রীস্টধর্ম বা ইসলাম কার্যত সেকালীন রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রও বটে, নইলে পোপ ও খলিফা প্রতিষ্ঠা পেতেন না। আল্লাহর দোহাই কাড়া হলেও আল্লাহ পার্থিব জীবনে দেখাজানার বাইরে। কাজেই আল্লাহ নির্দেশিত বিধিনিষেধ আচরণে পালন করতে ও করাতে হলে রাজার বা রাষ্ট্রের অনুমোদন ও সহায়তা প্রয়োজন। এ কারণেই দারুল হরব মুসলমানের কাছে বিভীষিকা স্বরূপ, এবং দারুল হরব থেকে সম্ভব হলে হিজরত করার নির্দেশও দেয়া হয়েছে এ অসুবিধের কথা বিবেচনা করেই।

ইসলামে সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামো প্রায় অভিন্ন। ধর্মে যা নিষিদ্ধ, রাষ্ট্রে তা বেআইনি এবং সমাজে তা-ই গর্হিত। কাজেই ধর্মে যা পাপ (Sin), রাষ্ট্রে তা-ই অপরাধ (Crime) এবং সমাজেও তা-ই অবাঞ্ছিত কু-আচার (Vice)। অতএব মুসলিম জীবনে নামাজ, রোজা, জাকাত, সত্যকথন, ভ্রাতৃত্ববোধ, পারস্পরিক সহযোগিতা প্রভৃতি যেমন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আবশ্যিক আচার ব্যক্তিগত নয়; তেমনি মহাজনী, মিথ্যাচার, নামাজ-রোজা-জাকাতে অবহেলা, লাম্পট্য, বেশ্যাবৃত্তি, অপব্যয়, নাচ-গানাদিও একান্তভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রদ্রোহী কর্ম-ব্যক্তিক অনাচার নয়। কেননা ইসলামী বিধানে সমাজভুক্ত মানুষের ব্যবহারিক জীবনে ব্যক্তিক (Private বা Personal) খেয়ালখুশির তথা স্বেচ্ছাচারিতার অবকাশ বিশেষ নেই। এ যেন People for the Society and State for the Society. যেহেতু মানুষের পারস্পরিক ব্যবহারবিধির উপরই সমাজ গড়ে উঠেছে, সেহেতু ব্যক্তিক আচরণে যদি সমাজনীতির মর্যাদা রক্ষিত হয় এবং রাষ্ট্রসংস্থাও যদি সমাজ-বিধি কার্যকর রাখতে সহায়তা করে, তা হলে কোনো মানুষই মানবিক জুলুমের কবলে পড়ে না। এমনি অবস্থাটা democratic right-এর পূর্ণতার ও পূর্ণ উপভোগের অবস্থা।

কাজেই ইসলামী ধারণায় সমাজই হচ্ছে জনজীবনের নিশ্চিন্ত আশ্রয় এবং রাষ্ট্রসংস্থা সেই সমাজস্বাস্থ্য রক্ষার অছি। ব্যক্তিজীবনের নিরাপত্তার জন্যেই ব্যক্তির পক্ষে সমাজানুগত্য আবশ্যিক হয়ে উঠে, আর ব্যক্তি-জীবনের চাহিদা মেটাবার জন্যেই সমাজের প্রতিপত্তি ও মর্যাদা রক্ষাই রাষ্ট্র সংস্থার একমাত্র কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। এ-যুগের ব্যক্তি স্বাতন্ত্রকামী গণধর্মীদের কাছে এমনি ধরনের। সমাজ-গুরুত্ব অশ্রদ্ধেয় হওয়ারই কথা। তাই কথাটি বিশদভাবে বলার চেষ্টা করা যাক।

সমাজভুক্ত কোনো মানুষেরই ব্যক্তিগত (Private বা Personal affairs) বিষয় বা ব্যাপার বলে কিছুই থাকতে পারে না। আমার পার্শ্ববর্তী লোকটির যদি চোখে পিচুটি, নাকে শ্লেষা এবং ঠোঁটে ঘা থাকে, তাহলে তা আমার অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে আমার কক্ষ-সাথীর যদি যক্ষ্মা থাকে তা আমার সর্বক্ষণের ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়; আমার প্রতিবেশীর ঘরে যদি কলহ কেদলের চেঁচামেচি চলে তাহলে তা আমার শান্তির বিঘ্ন হয়ে উঠে। আমার পাশের বাড়িতে যদি কেউ গান গায় তা আমার চিত্ত-প্রশান্তি আনে। আমার সামনের অপরিচিত লোকটি চুলে যদি সুগন্ধ তেল কিংবা গায়ে সেন্ট মাখে, তাহলে তা আমার চিত্ত-প্রসন্নতার অবলম্বন হয়, রূপবান কিংবা শ্রদ্ধেয় গুণবান ব্যক্তির সান্নিধ্য আমার আত্মপ্রসাদ লাভের কারণ হয়; তেমনি কুৎসিত, ইলুত ও নিগুণ লোক আমার চিত্তবিকার ঘটায়। এমনিভাবে কোনো সাক্ষাৎ সম্পর্ক ছাড়াও মানুষের সুখ-দুখ, আনন্দ-বেদনা, উচ্ছ্বাস-উত্তেজনা, আবেগ-উদ্বেগ, স্বস্তি-বিচলন, শান্তি-শঙ্কা, প্রীতি-ভীতি প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ করে অপর মানুষের অস্তিত্ব ও নিঃসম্পর্ক আচরণ। কাজেই যে-কোনো সমাজভুক্ত মানুষের অস্তিত্ব ও আচরণের অপ্রতিরোধ্য প্রতিক্রিয়া রয়েছে অপর মানুষের দেহ-মন-আত্মার উপর। এ প্রভাব-প্রতিক্রিয়া যে পারস্পরিক তা না বলেও চলে। অতএব মনুষ্যসমাজে individualism বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের তেমন কোনো স্থানই নেই। যদিও এ-যুগে আমরা অতিপ্রগতি ও সংস্কৃতিচর্চার নামে এই স্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিক আচরণে স্বাধীনতার প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাবান এবং গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রসংস্থায় এর উপরই আত্যন্তিক গুরুত্ব দেয়ার রেওয়াজই যে কেবল চালু হয়েছে তা নয়, সংস্কৃতিচর্চার প্রথম পাঠ হিসেবে এদিকে লোক-প্রবণতাও বিশেষভাবে দেখা দিয়েছে। এজন্যে পুরোনো চারিত্রিক ও সামাজিক নীতিবোধ বদলাতে হয়েছে। কেননা সমাজ-শাসনের অনুপস্থিতিতে স্বেচ্ছাচার বা স্বৈরাচারের (শব্দার্থে ব্যবহৃত) অধিকারের ভিত্তিতেই ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিমাপ হয়। ফলে জীবনের ও আচরণের মূল্যবোধে হেরফের দেখা দিয়েছে; তাতে পুরোনো উচ্চ হয়েছে তুচ্ছ, আবার তুচ্ছ পেয়েছে উচ্চের মর্যাদা, মহৎ হয়েছে মামুলি, বৃহৎ পাচ্ছে তাচ্ছিল্য। আবার আগেকার দিনের কাঁচ এ-যুগে কাঞ্চন মূল্যে বিকোচ্ছে।

অনেক তুচ্ছ নীতি, আদর্শ ও আচরণ একালে মাহাত্ম্যে ও মহিমায় উজ্জ্বল ও আরাধ্য হয়ে উঠেছে। ভালো হল কি মন্দ হল তা অন্য তর্ক, তার হিসেব আলাদা। আমাদের বক্তব্য : যে গুরুত্ব ও মর্যাদা সমাজেরই একচেটিয়া ছিল, তা এ- যুগে বাক্তির উপর আরোপিত হওয়ায় আমাদের জীবনের জমা-খরচের খাতা পালটাতে হয়েছে। হিসেবের পদ্ধতিও হয়েছে বদলাতে। আগে ছিল সমাজের জন্যই ব্যক্তি ও রাষ্ট্র। এখন হয়েছে ববির জন্যই রাষ্ট্র, আর সমাজ পেয়েছে বড়জোর Club-এর মর্যাদা–এর অপরিহার্যতা এ-যুগে আর স্বীকৃত নয়। ফল দাঁড়িয়েছে এই, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র তথা ব্যক্তি-স্বাধীনতার-বাঞ্ছরূপ আত্মরতির ছিদ্রপথে সমস্ত গুরুত্ব ও মর্যাদা গিয়ে বর্তেছে রাষ্ট্রসংস্থার উপর। যার ফলে Ism-প্রবণ জনগণ রাষ্ট্রসংস্থাকে পছন্দসই Ism অনুগ করতে গিয়ে জান-মাল রাষ্ট্রদানবের পদমূলে কোথাও বিকিয়ে দিয়েছে, কোথাওবা বন্ধক রেখেছে, আবার কোথাওবা স্বেচ্ছায় সমর্পণ করে আত্মপ্রসাদ লাভ করছে–ধন্যও হচ্ছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ মনে করা যাক, রাশিয়া-চীনে যারা কম্যুনিস্ট তাদের একটি দল কোসিগিন কিংবা চৌ-এন-লাইকে তাদের ব্যক্তিক আচরণের জন্যে পছন্দ করছে না, অথচ সরাবার-তাড়াবার সাধ্যিও তাদের নেই। কাজেই তারা মনে মনে রাষ্ট্র প্রধানের উপর বিরূপ এবং ক্ষুব্ধ। এমনি অবস্থায় কোনো-অক্যুনিস্ট যদি কোসিগিন-চৌ-কে তাড়াতে এগিয়ে আসে, তখন ঐ বিরূপ বিক্ষুব্ধ দলের ভূমিকা কী হবে? তারা কি তখন অকমুনিস্টের বিরুদ্ধে জান-মাল পণ করে রুখে দাঁড়াবে না? তাদের কাছে তাদের আদর্শবাদ যেমন প্রাণপ্রিয়, মুসলমানদের কাছেও তাদের সমাজাদর্শ তেমনি অপরিত্যাজ্য। এজন্যে মুসলমান কেবল খলিফাতান্ত্রিক তথা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্যেই নয়, অত্যাচারী মুসলিম রাজার রাজ্যরক্ষার জন্যেও অমুসলমান আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে জীবনপণ সংগ্রাম করবে। কেননা মুসলিম শাসনে মুসলমানের যা আবশ্যিক সামাজিক ও নাগরিক আচরণ তা অমুসলিম শাসনে ব্যক্তিগত ও ঐচ্ছিক আচরণের রূপ পায়। যেমন পাপের ভয় যে মুসলমানের নেই, সে ইচ্ছা করলেই সুদখোর হতে পারে, জাকাত দেয়া বন্ধ করতে পারে, জুয়াড়ি হতে পারে, সামাজিক সাম্যে আস্থা হারাতে পারে, বৈষম্যের অবাঞ্ছিত ব্যবধান সৃষ্টি করতে পারে। এক কথায় সে যে-কোনো বে-ইসলামী কাজ ও আচরণ করতে পারে। তা ছাড়া মুসলিম শাসনে ব্যক্তিগতভাবে একজন মুসলমান সাম্যভিত্তিক ইসলামী সমাজের যেসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পেত, বৈষম্য কণ্টকিত বিধর্মী সমাজের কোনো শাসকের অধীনে সে-যুগে তা ছিল কল্পনাতীত।

মুসলিম সমাজে ব্যক্তিক জীবনের ও জীবিকার নিরাপত্তাব্যবস্থা সুনিশ্চিত হয়েছে রসুলের নির্দেশে এক মুসলমানের ধনপ্রাণ অপর মুসলমানের পক্ষে পবিত্র। এবং মুসলমানরা পরস্পর ভাই ও বন্ধু। স্ত্রীর প্রতি সদ্ব্যবহার করো আর দাসের প্রতি সদয় হও এবং নিজের মতো করে তার খোর-পোষ দাও। তাই মুসলমান বিধর্মী শাসনের আশঙ্কায় বিচলিত হত। কেননা সে জানত এর ফলে তার নিশ্চিন্ত নির্বিঘ্ন জীবনে নিশ্চিতই বিপর্যয় আসবে! কাজেই যে-ইসলাম একান্তভাবে সমাজ-কাঠামো ভিত্তিক, তা এভাবে লোপ পেতে পারে। এই সমাজ-গুরুত্ব ও কর্তৃত্ব রক্ষার জন্যেই মুসলমানের পক্ষে মুসলিম শাসক আবশ্যিক। তাই জেহাদ মাত্রই আত্মরক্ষা বা প্রতিরোধমূলক (Defensive & Resistive)। জেহাদ আক্রমণাত্মক (Offensive or Aggressive) হতেই পারে না। এ অর্থেই জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের হয়ে সংগ্রামই শ্রেষ্ঠ জেহাদ।

জেহাদ মুসলমানের সামাজিক কর্তব্য ও ব্যক্তিগত দায়িত্ব। জেহাদের জন্য প্রস্তুত থাকা মুজাহিদের ভাব জিইয়ে রাখা মুসলমানের ঈমানের অঙ্গ। এ অর্থে মুমিন মাত্রই মুজাহিদ। যে জেহাদ করে সেই মুজাহিদ, বেঁচে থাকলে হয় গাজী আর মরলে হয় শহীদ। Ism আবর্তিত আজকের দুনিয়ায় আদর্শবাদী তথা মতবাদ-ধারী মানুষ মাত্রই মুজাহিদ। কেননা আদর্শের জন্যে ও ন্যায়ের পক্ষে যে-কোনো প্রকারের সংগ্রামের নামই জেহাদ। তবু জেহাদ শব্দটি ঘৃণ্য হয়ে আছে। এর মূল্য-মাহাত্ম্য এ-যুগে মনে হয় মুসলমানদের কাছেও নেই। অবশ্য এজন্যে মুসলমানেরা নিজেরাই দায়ী। কেননা মুসলিম শাসনেও ইসলামী বিধান অনুসৃত হয়েছে কৃচিৎ আর রাজ্য-লোলুপ মুসলমান বাদশা-সুলতানেরা আত্মস্বার্থে আক্রমণাত্মক কাজে অর্থাৎ চড়াও হয়ে অপরের উপর হামলা ও জুলুম চালাবার জন্যেও অজ্ঞ-জনসাধারণকে জেহাদের ভাঁওতা দিয়ে উত্তেজিত করেছেন ও অনেক অনর্থ ঘটিয়েছেন। তাই জেহাদের নামে এমন ত্রাস ও অবজ্ঞা। যা অভিনন্দিত ও মহিমান্বিত মহৎ ব্রত হতে পারত, তা-ই হল অবাঞ্ছিত ও ঘৃণিত। তবু সমাজ-স্বার্থে নিত্য জেহাদ চাই। মুজাহিদ ছাড়া কে মানুষকে প্রাত্যহিক শাসন-শোসন-পীড়ন-পেষণ থেকে মুক্ত করবে, মুক্ত রাখবে।

দুর্দিন

০১.

আযাদী লাভের পর বিশ বছর কেটে গেল। কিন্তু আমাদের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঘুচল না ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিক্ষেত্রে। আজো চলছে দলাদলি ও কোন্দল। অবশ্য মতাদর্শের বিতর্ক ও সংগ্রাম মন্দ কিছু নয়, অভিনব তো নয়ই। কিন্তু একই সমস্যা নিয়ে বিশ বছর ধরে মাথা ঘামানো, আর তার সমাধান খুঁজে না-পাওয়া এ-যুগের পক্ষে অদ্ভুত, অযৌক্তিক ও অকল্যাণকর।

দল মোটামুটি দুটোই। একদল ধর্মীয় জাতীয়তায়, ঐতিহ্যে ও সংস্কৃতিতে আস্থাবান। অন্যদল দেশীয় ও ইউরোপীয় ভাব-চিন্তার অনুগত। প্রথম দল Nationalist, দ্বিতীয় দল Rationalist। আদর্শ হিসেবে কোনোটাই নিন্দার নয়। প্রথম দল ধর্মভাবে নয়–ধর্মীয় পরিচয়ে স্বাতন্ত্রকামী। তাঁদের আত্মপ্রীতি ও মর্যাদাবোধ তীক্ষ্ণ ও তীব্র। তাঁরা ঋণের কিংবা অপরের অনুসৃতির লজ্জা থেকে জাতিকে বাঁচাতে চান। তাঁদের যুক্তিতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একাকার। কেননা ইসলাম হচ্ছে সর্বকালীন সর্বমানবিক সমস্যার সমাধান আর মানব-কাম্য কল্যাণের দিশারী। কাজেই ইসলামের অনুগত হও, কোরান-হাদিস অনুসরণ কর আর সুখে নিদ্রা যাও।

মুশকিল হল এই তাঁরা মুখে বলছেন বটে, কিন্তু অন্তরে তাঁদের দ্বিধা ঘোচেনি, আর তাই হয়তো আচরণে তাদের কোনো সঙ্গতি দেখা যায় না। কেননা য়ুরোপীয় আদলে জীবন রচনায় তাঁরাও প্রয়াসী। য়ুরোপীয় মানস-সংস্কৃতির ফসল গ্রহণে কিংবা ব্যবহারিক জীবনের প্রাত্যহিকতায় য়ুরোপীয় জীবনধারার অনুকরণে তাদের সংকোচ দেখিনে। তা হলে তাদের স্বাতন্ত্র্যবাদ কী নিলক্ষ্য ফাঁকা বুলি মাত্র? তাও নয়। আসলে ব্রিটিশ ভারতে রাজনৈতিক স্বার্থে যে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রচেতনা জাগে, তাকে স্থায়ী ও জোরালো করবার জন্যে স্বতন্ত্র জাতীয়তায় বিশ্বাস ও তার ভিত্তি দৃঢ়মূল করবার প্রয়োজন হয়। আর এ লক্ষ্যে সিদ্ধির অনুষঙ্গ হিসেবে আসে ধর্মীয় ঐতিহ্যের ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের যুক্তি। আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছিল, জয়ী হয়েছিলাম আমরা। কাজেই আমাদের সে প্রয়োজন ফুরিয়েছে, বিশ বছর আগে। ওরা এখন আমাদের পাতের ভাতের ভাগী নয়, প্রতিবেশী মাত্র। তবু আমাদের দেশ ও জাতির হিতকামী অতি-সচেতন একদল বুদ্ধিজীবী অহেতুক শঙ্কা থেকে মুক্ত হতে পারছেন না। একটা অসুস্থ চিন্তা, একটা বিকৃত বুদ্ধি, একটা বিদ্বিষ্ট মন ও একটা অহেতুক শঙ্কা নিয়ে দেশের স্বার্থ ও জাতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্যে অতন্দ্র প্রহরীর ও গণ-অভিভাবকের ভূমিকা গ্রহণ করেছেন তারা।

যা তারা প্রচ্ছন্ন রাখতে চান, খোলাখুলিভাবে তার নাম দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গীয় হিন্দু ও হিন্দুয়ানী ভীতি। এ কারণেই তারা বলছেন– হরফ বদলাও, বানান বদলাও, শব্দ বদলাও, ভাষা বদলাও, ভঙ্গি বদলাও; বদলাও বিষয়বস্তু, বদলাও নাম, বদলাও ভাব, বদলাও চিন্তা। কেবলই বদলাও যাতে বাঙলা ও বাঙালিত্বের নাম-নিশানা ঘুচে যায়, বিলীন হয় সাদৃশ্য, প্রতিষ্ঠা পায় পূর্ণ স্বাতন্ত্র। এর আগে নিশ্চিন্ত হওয়া চলে না। কেননা শত্রুকে ছোট ভাবতে নেই।

বিশ বছর ধরে ক্রমবর্ধমান অসাফল্যের মুখ্য কারণ হচ্ছে, তাঁদের অভিপ্রায় প্রচ্ছন্ন করে তারা কেবলই ধর্মীয় ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের গর্ব আর জাতীয় স্বাতন্ত্রের গুরুত্ব উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন। অথচ দেহ-মনে তারা বরণ করেছেন য়ুরোপকে। কথায়-কাজে এ অনৈক্য, বুকে-মুখে এ বিরোধ অন্যের অশ্রদ্ধা জাগায়। অবচেতন ভাবেই শ্রোতার মন হয়ে ওঠে বিরূপ। তারা যদি সোজাসুজি বলতেন এড়িয়ে চলো হিন্দুর সাহচর্য, পরিহার কর হিন্দুয়ানী প্রীতি, বর্জন কর হিন্দুর সাদৃশ্যজ্ঞাপক সবকিছু, তা হলে হয়তো রাষ্ট্রিক অসদ্ভাবের সুযোগে সমর্থন পেতেন অনেক। কিন্তু তা তাঁরা বলেননি–বলেন না। হেঁয়ালি ছাড়তে চান না তাঁরা।

এর ফলে বেড়ে যায় সাধারণের তাচ্ছিল্য আর বিরুদ্ধবাদীদের উত্তেজনা। বিরুদ্ধবাদীরা তখন যুক্তির আশ্রয় নেন। তাদের যুক্তি কতকটা এরূপ–যুগের সঙ্গে তাল রেখে চলার অন্য নাম সংস্কৃতি। সংস্কৃতি কখনো পুরোনো হতে পারে না, তা হবে নিত্য নতুন। প্রতিদিনকার সূর্যের মতোই নতুন। বহতা নদীর স্রোতের মতোই নতুন। কেননা সংস্কৃতি পুরোনো হলে তা আর সংস্কৃতি থাকে না, হয় আচার। তখনকার ইসলামী সংস্কৃতির তথা এখনকার ইসলামী আচারের অনেক ভালো রীতি-পদ্ধতিই যুডাইজম থেকে নেয়া, যার নাম সুন্নত-ই-ইব্রাহীম। অতএব ইসলামী সংস্কৃতিও অবিমিশ্র ছিল না। সংস্কৃতি চালু থাকে সৃজনশীলতায় ও গ্রহণশীলতায়। যারা সৃষ্টি করতে পারে না, অন্যের সৃষ্টি বরণ করেই তারা হয় সংস্কৃতিবান। যারা সৃষ্টিও করতে পারে না, গ্রহণও করতে চায়, তারা আদিম স্তর পার হতে পারেনি, যেমন আফ্রো-এশিয়ার পার্বত্য ও আরণ্যক গোত্রগুলো। অতএব সংস্কৃতি কখনো অবিমিশ্র হয় না হতে পারে না। আমরা বাঙালিরা সৃজন করে নয়– গ্রহণ করেই হয়েছি সংস্কৃতিবান। আমাদের ধর্ম আরবের ও উত্তর-ভারতের। আমাদের ভাষা উত্তরভারতের বা আরো দূরের। আমাদের প্রশাসনিক সংস্কৃতি মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন, তুর্কী, মুঘল ও ইংরেজ থেকে পাওয়া। আমাদের সমাজ সংস্থা এই ধর্ম আর প্রশাসনিক আদর্শভিত্তিক। আমরা নিজেরা হলাম অস্টো-মঙ্গোল-নিগ্রো-আর্য-সামীয়ের বর্ণসঙ্কর বা রক্ত-সঙ্কর জাতি। অতএব, পাঁচ রকমের মানুষ নিয়ে গড়ে উঠেছে আমাদের জাতি। পাঁচমিশেললি হয়েছে আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। তাহলে কোনো অর্থে আমরা সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের কথা বলি? আমরা গ্রহণ করি, আর নিজের মতো করে নিই, যার নাম স্বাঙ্গীকরণ। এই হচ্ছে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের রূপ আর জাতীয় স্বরূপ। আমাদের পূর্বপুরুষ বিদেশী বিজাতি আরবের ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বলে কী আমরা লজ্জায় মরি, না স্বস্তিবোধ করি!

গ্রহণে-বরণেই যদি আমরা আজ অবধি টিকে থাকি, তাহলে আজকে হঠাৎ জাত গেল, ধর্ম গেল, ঐতিহ্য গেল, গেল ভাষা, গেল সাহিত্য, গেল সংস্কৃতি, বলে আর্তচিৎকারের বা আর্তনাদের কী কারণ ঘটল? বিশেষ করে আমরা যখন জানি যে সংস্কৃতির কোনো স্থায়ী রূপ বা স্বাতন্ত্র থাকতেই পারে না। এমনকি জীবন-চেতনা, নীতিবুদ্ধি, ধর্মবোধ, ঐতিহ্যের মূল্য, ভাষার রূপ বা সাহিত্যের আঙ্গিক ও বক্তব্যই কী অবিচল অবিকৃত থাকে? এক কোরআন কেন্দ্র করেই হাদিস অবলম্বন করেই কী আমাদের বাহাত্তর ফেরকা হয়নি? জীবনে কী প্রয়োজন-বুদ্ধি ও উপযোগ-চেতনা বদলাচ্ছে না? জীবনযাত্রী কী চলার পথে এগোয় না? মানুষের মন-বুদ্ধি-আত্মার কী বিকাশ নেই? সমাজ কী স্থাবর? তার কী কেবল অতীতই আছে, ভবিষ্যৎ নেই? তার কী কেবল অতীতের মোহ থাকাই বাঞ্ছনীয়, ভবিষ্যতের আকর্ষণ থাকা কাম্য নয়? নিজেকে নতুন করে রচনা করা কী অপরাধ না অমানবিক?

যাঁরা সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের প্রবক্তা, তারাই আবার য়ুরোপীয় গণতন্ত্রের ভক্ত, গণতন্ত্রী সংবিধানের দাবীদার, রোমান-আইনের অনুরাগী, বিজ্ঞান ও প্রকৌশলবিদ্যায় উৎসুক, রেডক্রসের মহিমায় মুগ্ধ, য়ুরোপীয় বৈজ্ঞানিক আবিস্ক্রিয়ার প্রসাদ গ্রহণে উন্মুখ। য়ুরোপীয় মনীষার ফসল ইতিহাস, দর্শন, অর্থনীতি, বাণিজ্যবিদ্যা, প্রাচ্য-শাস্ত্র বিশ্লেষণ বিদ্যা, বিভিন্ন বিজ্ঞান, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা আর সাহিত্যশাস্ত্র শিক্ষায় এবং অনুকরণেও তারা লজ্জাবোধ করেন না, কিংবা সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের কথা ভাবেন না। য়ুরোপীয় আদলে প্রশাসনিক সংস্থা গড়ে তুলতে, স্কুল-কলেজ রাখতে, সৈন্যবাহিনী বিন্যাস করতে, কিংবা কলকারখানা স্থাপনে, পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধানে, গৃহনির্মাণে ও আসবাবপত্র ব্যবহারে তাঁদের আত্মসম্মানে বাধে না। এঁরা গরুর গাড়ি-ঘোড়ার গাড়ি ছেড়ে মোটরে বিমানে-জাহাজে চড়তে, কিংবা হেকিম বাদ দিয়ে ডাক্তার ডাকতে, রেড়ির তেল ছেড়ে কেরোসিনের ব্যবহারে কিংবা বৈদ্যুতিক শক্তির প্রয়োগে আত্মধিক্কারে মাথা নত করেন না।

আজ আমাদের চুল কাটার ধরন থেকে জুতোর অবয়ব অবধি সবকিছুই য়ুরোপীয়। এভাবে অন্তরে-বাইরে মনে ও মেজাজে য়ুরোপীয় মানুষেরই প্রতিকৃতি আমরা। এমনকি য়ুরোপীয় জীবন চিন্তার প্রভাবে কোরআনের কানুন–আল্লাহর নির্দেশ সংশোধনেও তারা দ্বিধান্বিত নন জন্মনিয়ন্ত্রণ, উত্তরাধিকার বিধানের সংশোধন ও পত্নীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি স্মর্তব্য। তাহলে তাঁদের সংস্কৃতিটা কী বস্তু আর তার স্থিতি কোথায়, বোঝা ভার। তাঁরা পেন্টালুন ও পেন্টালুনের আদলে তৈরি পাজামা পরেন, আসকান-পাঞ্জাবির নিচে গেঞ্জি রাখেন, বুফে খান এবং পাওরুটি ও সুপে আসক্ত; তবু সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের বড়াই করেন।

আরো মারাত্মক ব্যাপার এই যে, তারা মুসলিম সংস্কৃতির কথা বলেন না–বলেন ইসলামী সংস্কৃতির কথা। এবং ইসলামী সংস্কৃতি নামটা তাঁদের যথেচ্ছ প্রয়োগে হাস্যকর হয়ে উঠেছে। নাচ-গান-নাটক-চিত্রকলা প্রভৃতি ইসলামে অবিধেয় বিষয়গুলোও তারা ইসলামী সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। যেমন বুলবুল চৌধুরীর নাচ, নজরুলের গান, মুসলিম চরিত্র নিয়ে রচিত নাটক, আবদুর রহমান চুঘতাইর চিত্র প্রভৃতি এবং যা-কিছু মুঘলাই ও ইরানি–তাঁদের কাছে ইসলামী। এভাবে যা-কিছু মুসলমান করে তা-ই ইসলামী হয়ে উঠেছে; যেমন ইসলামিয়া হোটেল, ইসলামিয়া কলেজ, ইসলামিয়া লাইব্রেরী, ইসলামিয়া ব্যাঙ্ক, ইসলামিয়া ইস্যুর্যান্স প্রভৃতি।

আমাদের না হোক, আরব-ইরানির কিংবা মুঘলের একটা সৃষ্টিশীল ও গ্রহণশীল মুসলিম সংস্কৃতি ছিল। য়ুরেশিয়ার সর্বত্র তা যথাকালে অনুকৃতও হয়েছিল। কিন্তু সে তো দূর অতীতের ইতিহাস। আজকের দিনে তার Revival-এর চিন্তা দিবাস্বপ্ন মাত্র। এরূপ চিন্তা দুর্বলতার ও অসামর্থ্যের সাক্ষ্য। এ সংস্কৃতির গৌরব-গর্বে নিষ্ক্রিয় থাকাও বিকৃত বুদ্ধির পরিচায়ক। গৌড় সুলতানের যে-বংশধর আজ অজপাড়াগাঁয়ের অশিক্ষিত দিনমজুর, সে যদি তার খান্দানের গর্ব করে, যথার্থ হওয়া সত্ত্বেও তা মূল্যহীন ও অশ্রদ্ধেয়। কেননা ঐ পরিচয়ের যোগ্যতা হারিয়েছে সে। আমাদেরও যখন আজ বিশ্বকে দেবার মতো কিছুই নেই, আমাদের যখন আজ কেবল গ্রহণ করা ও গড়ে তোলার পালা চলছে, তখন পূর্বপুরুষের মহান সংস্কৃতির কথা বলে নিজেদের হাস্যাস্পদ করা অসমীচীন। কথায় বলে : স্বনামা পুরুষ ধন্য পিতৃনামা চ মধ্যমা। আমরা স্বনামে ধন্য নই, পিতৃনামেও নই পরিচিত। বিশ্বের বিভিন্ন জাতি যখন জ্ঞানে, কর্মে ও চিন্তায় বিস্ময়করভাবে নিজেদের বিকাশ সাধন করছে, তখন আমরা পূর্বপুরুষেরও নয়–ধর্মীয় ঐক্যের সুবাদে আরব ইরানির অতীত কৃতির আস্ফালনে নিজেদের নিঃস্বতা, নিজেদের অযোগ্যতার লজ্জা ঢাকা দেবার প্রয়াসী। আত্মধ্বংসী এ আত্মপ্রবঞ্চনা কোনো শ্রেয়সের সন্ধান দেবে আমাদের?

তাই সংস্কৃতির নামে এঁদের রক্ষণশীলতা, গ্রহণবিমুখতা, অসহিষ্ণুতা আর প্রতিক্রিয়াশীলতা আমাদের অগ্রগতি ব্যাহত করছে মাত্র। আমাদের প্রগতি ঠেকিয়ে রাখার সামর্থ্য এঁদের ছিল না, কিন্তু ইসলামের নামে জনপ্রিয়তাকামী সরকারের সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েই এঁরা প্রবল। এভাবে সরকারি প্রশ্রয়ে ও উৎসাহে সংস্কৃতির ও মননের ক্ষেত্রে জনগণের স্বাভাবিক আত্মবিকাশের পথ করেছেন তারা বন্ধুর এবং দেশের rational বুদ্ধিজীবীদের স্বাধীন আত্মপ্রকাশের সুযোগ করেছেন হরণ।

যে-দল Rationalist, তাঁরা জ্ঞান, কর্ম ও চিন্তার বিস্ময়কর য়ুরোপীয় বিকাশে মুগ্ধ। এতে তারা পেয়েছেন মানব-মহিমার সন্ধান। জীবন-সম্ভাবনার অনন্ত বিস্তার দর্শনে তাঁদের চিত্তলোক আন্দোলিত। জগৎ-রহস্যের নিঃসীম গগনে পাখা মেলতে চায় তাদের মনোবিহঙ্গ। তারা দেহ-মন আত্মার অবগাহন কামনা করেন এই নব-উপলব্ধ চেতনা-সমুদ্রে। চিত্তের এ চেতনালোকে ভূগোল নেই, ধর্ম নেই, জাত নেই; আছে কেবল মানুষ আর আছে মানবিকতা ও মানবতার বিচিত্র বিকাশের আভাস ও আশ্বাস। অখণ্ডের সন্ধান যে পেয়েছে, খণ্ডে তার মন ভরে না। সমুদ্র-পর্বত যে দেখেছে, নদী আর টিলা তার অবহেলা পাবেই! Rationalist-রাও তাই জীবনকে রাষ্ট্রিক ও ধর্মীয় গণ্ডীর মধ্যে প্রত্যক্ষ করে না, দেখতে চায় নিখিল জগতের পটে। বিচিত্র ও বর্ণালি, বিমূর্ত ও বিমুক্ত অনুভবের সূক্ষ্ম শিকড় চালিয়ে দিয়ে জগৎ-রহস্য ও জীবন-ভাবনার স্বরূপ-চেতনার গভীরে উপলব্ধি করার প্রবণতা এ-যুগে অত্যন্ত প্রবল। সূর্য আজ প্রতীচ্য গগনে। তার আলো ও আলোর প্রসাদ পেয়ে জগদ্বাসী আজ ধন্য ও কৃতার্থ। পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার, সেথা হতে সবে আনে উপহার। যে আনে না–আনতে জানে না, সে হতভাগ্য। মানস-ঐশ্বর্যের দ্বার অবারিত দেখেও যে অবহেলা করে সে কৃপার পাত্র। সমুদ্র সামনে পেয়েও যে তাকিয়ে দেখে না, সে হৃদয়হীন।

প্রতীচ্যের জ্ঞানে-বিজ্ঞানে ও জীবন-চেতনায় মুগ্ধ আমাদের Rationalist-রা তাই চরম তাচ্ছিল্যে শুচিবাইগ্রস্ত রক্ষণশীলদের বলতে চান : যে-সংস্কৃতি জীবনের প্রয়োজন মিটায় না, আত্মরক্ষার অস্ত্র যোগায় না, রোগের প্রতিষেধক জানে না, সিনেমা-রেডিয়ো-টেলিভিশন-টেলিফোন টেলিগ্রাফ কিংবা জাহাজ-বিমান দিতে পারেনি, যে-সংস্কৃতি বিজ্ঞানে-দর্শনে-সমাজতত্ত্বে-রাষ্ট্রতত্ত্বে, অর্থনীতি কিংবা বাণিজ্য বিজ্ঞানে কোনো নতুন চিন্তায় সমর্থ নয়; অন্য কথায় যে-সংস্কৃতি আধুনিক জীবন-ভাবনার সহায়ক নয়, জীবনের মানস-সমস্যার সমাধান দেয় না, মনের খোরাক যোগায় না, ব্যবহারিক জীবনের কোনো অভাব মিটানোর যোগ্যতা যাতে অনুপস্থিত; যে-সংস্কৃতি কেবল নরকের ভয় ও স্বর্গের লোভ দেখিয়ে মানুষের জীবন ও জীবিকা নিয়ন্ত্রণে তৎপর; ভাব, চিন্তা, জ্ঞান ও কর্মের উদ্যোগে ও প্রসারে রক্তচক্ষু কিংবা কাতর; যে-সংস্কৃতি সৃষ্টির প্রেরণা যোগায় না, যে সংস্কৃতি কল্যাণকে গ্রহণেও উৎসাহিত করে না, যে-সংস্কৃতি কেবল ধরে রাখে, কেবলই পিছুটান দেয়, অথচ যা দিয়ে মনও ভরে না, প্রয়োজনও মেটে না, এগিয়ে যাবার দিশাও দেয় না, বেঁচে থাকার উপায়ও বাতলায় না–সে-সংস্কৃতি দিয়ে আমরা কী করব?

.

০২.

Rationalist-দের কেউ কেউ পড়াশোনা ও দেখার মাধ্যমে য়ুরোপীয় চিত্তের–প্রতীচ্য মনীষার ও জীবন-ভাবনার স্বরূপটি জেনেবুঝে নিয়েছেন। তাদের চেতনায় জগৎ-ভাবনা উদ্দীপ্ত আর মানবিক আকাক্ষার ও জীবন-সমস্যার আঞ্চলিক পার্থক্য অবলুপ্ত। এঁরা শান্তিকামী, স্বস্তিপ্রয়াসী ও বিশ্বমানবতায় বিশ্বাসী। বর্ণ, ধর্ম ও রাষ্ট্রিক স্বাতন্ত্রের স্বীকৃতিতে এঁরা সম অধিকার ও সম। সুযোগের ভিত্তিতে সহ-অবস্থান নীতিতে আস্থাবান। এ হল দক্ষিণপন্থীদের কথা। এঁদের মধ্যে যারা বামপন্থী তাঁরা নিজেদের পরিকল্পনামতো বিশ্ব-সংসারকে ঢালাই করতে চান। মানুষের বর্ণ, ধর্ম, মনন ও প্রয়োজনের পার্থক্য স্বীকৃতি পায় না তাঁদের কাছে।

এ দুই পন্থের অন্যান্যরা কিছু জেনে এবং কিছু শুনে প্রাগ্রসর প্রগতিবাদী আধুনিক মানুষ বলে আত্মপরিচয় দেন। কতগুলো বুলি কপচিয়ে তাঁরা সমাজ, রাষ্ট্র ও মানবসমস্যা সচেতনতার আভাস দিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। এরাই যন্ত্রযুগের যন্ত্রণার কথা, অবক্ষয়ের কথা, সমাজের বিবর্তনধারার কথা বলে শ্রোতার মনে চমক লাগিয়ে দেন।

মানুষের জীবনপ্রবাহে যে অবক্ষয় নেই, যান্ত্রিকতা যে যন্ত্রণার নয়, সমাজ বিবর্তন যে মানুষেরই অগ্রগতির ফল–এসব কথা তাদের বোঝানো যায় না। মানুষের অগ্রগতির তথা চলমানতার লক্ষণই এই যে, তার জীবনবোধ হবে বিচিত্রতর, সূক্ষ্মতর ও তীব্রতর। আর এর ফলে বাড়বে প্রয়োজনবোধ, দেখা দেবে অভাব, উদ্ভব হবে সমস্যার, খুঁজবে সমাধান। ফলে উপায় হবে বিচিত্র, উদ্দেশ্য হবে বিভিন্ন, মত হবে বিবিধ, পথ হবে বহুধা আর ঋজু থাকবে না জীবনচর্যা, সহজ হবে না বেঁচে থাকা। স্বাতন্ত্রে কিংবা আত্মনির্ভরশীল হয়ে চলা হবে অসম্ভব। পৃথিবীর মানুষ কেবল পারস্পরিক সহযোগিতায় বাঁচবে। মানুষ ফেরেস্তা নয়, অতএব জীবনযাত্রা হবে জটিল ও দুঃসাধ্য। দেখা দেবে দ্বন্দ্ব, লাগবে লড়াই, বাধবে সংঘর্ষ, এড়ানো যাবে না সংঘাত। তা হবে ব্যক্তিক, পারিবারিক, দৈশিক ও রাষ্ট্রিক। অতএব দোষ যন্ত্রের নয়, কারণও অবক্ষয় নয়, সমাজ কাঠামোও দায়ী নয় এর জন্যে। মানুষের লোভ ও কল্যাণবুদ্ধির অভাবই এর জন্যে দায়ী। তাই জীবন সংগ্রামের শেষ নেই। মানুষ যতই এগুবে, যতই দিন যাবে, সংগ্রামও হবে বিচিত্রতর, কঠিনতর আর জটিলতর। সে সংগ্রাম করবে প্রবৃত্তির ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে, অভাবের ও অকল্যাণের বিরুদ্ধে, রোগ ও মৃত্যুর বিরুদ্ধে।

আর দেশ ও ধর্মের প্রতি অনুরাগ স্বাভাবিক মানুষের আজন্মের সংস্কার। স্বদেশ প্রেমিক ও সুনাগরিক মাত্রই স্বভাবত নিজের রাষ্ট্রের স্বার্থসচেতন। রাষ্ট্রের প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সে নিজের স্বার্থেই বিস্মৃত হতে পারে না, পারে না অবহেলা করতে। আর কোনো আস্তিক মানুষই তার ধর্মীয় চর্যায় আকর্ষণ হারায় না। কাজেই এ ব্যাপারে কারো উদ্বিগ্ন-উৎকণ্ঠ হওয়ার কারণ দেখিনে।

আমাদের দুর্দিন বলছি এজন্যে যে আমাদের একদল এগুতে চান না, তাঁরা সংগ্রাম-বিমুখ। স্থিতির মধ্যেই তাঁরা স্বস্তি খোঁজেন, পূর্বপুরুষের রিকথ সম্বল করে নিশ্চিন্ত হতে চান। তাঁরা আকাভ ক্ষাহীন, অনিশ্চয়তায় পা বাড়াতে অনিচ্ছুক তারা। আত্মরক্ষণই তাঁদের কাম্য, আত্মপ্রসারে আগ্রহ নেই।

আর এক দলের সাধ আকাশ-ছোঁয়া। কিন্তু সাধ্য সামান্য। তাদের আকাঙ্ক্ষা প্রবল কিন্তু যোগ্যতা অর্জনে আগ্রহ ক্ষীণ, সাধনায় উৎসাহ দুর্লক্ষ্য। তাই সৃষ্টিশীল তো নয়ই, গ্রাহিকাশক্তিও তাঁদের সুষ্ঠু নয়। তাই আজো আমরা অনুকারক মাত্র। মনের দিক দিয়ে সুস্থ ও স্বস্থ কেউই নন। একদলের দৃষ্টি দূর অতীতের আরব-ইরান পানে। আর এক দল তাকিয়ে আছেন সুদূর পিকিং, মস্কো কিংবা লন্ডন-প্যারিস-নিউইয়র্কের দিকে। এসব কারণে আমাদের অগ্রগতি আশানুরূপ হয়নি।

দেশ, জাত ও ধর্ম

মানুষের জীবনের প্রয়োজনেই ধর্মমতের সৃষ্টি। ধর্মের যূপকাষ্ঠে আত্মবলিদানের জন্যে জীবন নয়। কাজেই জীবনই মুখ্য। আর সব গৌণ। জীবন গড়ে ওঠে দেশে ও কালে। মানুষের জীবন স্বাতন্ত্রে উপভোগ সম্ভব নয়, তাই পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক সংস্থা ও দেশকাল ভিত্তিক জাতীয়তা তার প্রয়োজন। মানুষের পক্ষে এ এমনি স্বাভাবিক যে এ নিয়ে বিচার-বিতর্কের অবকাশই নেই।

মুসলমানেরা যে-ধর্ম মানে তা আরবোদ্ভূত। সেখানকার লোক ইসলাম মানে, কিন্তু দেশের অমুসলিম ও মুসলিম কোনো ঐতিহ্যকেই অবহেলা করে না। ইরানেও ধর্মমত দৈশিক ঐতিহ্যবোধের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়নি। তুরস্ক-ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রেও দেখি লোকের ধর্মমতে ও ঐতিহ্যবোধে কোনো বিরোধ নেই। আমাদের দেশেই কেবল শাসন-শোষণের প্রয়োজনে কৃত্রিমতত্ত্বের অবতারণা করে দেশ, জাত ও ধর্মের দ্বান্দ্বিক ধারণা দানের অপচেষ্টা হচ্ছে।

আমরা একাধারে বাঙালি ও মুসলমান। আমাদের ধর্মীয় জীবন যেমন আছে, তেমনি রয়েছে ব্যবহারিক জীবন। আমরা নামাজ পড়ব, মসজিদ গড়ব, আল্লাহকে ডাকব, যথাবিধি ধর্মীয় আচরণে নিষ্ঠ থাকব। আবার আমাদের ব্যবহারিক প্রয়োজনে আমরা বিদেশী পণ্য নেব, বিজাতির জ্ঞান নেব, যা-কিছু ভালো লাগে তা-ই বরণ করব, পরের বলে বর্জন করব না। জীবনকে উপভোগের ও কল্যাণের অনুগত করব। সুন্দরের ও কল্যাণের প্রসাদকে বিদেশী ও বিজাতির বলে এড়িয়ে চলব না–বঞ্চিত করব না নিজেদের।

মানুষের জীবন রূপ পায় মুখ্যত দেশ ও কালের প্রভাবে। ধর্মের প্রভাব খানিকটা কৃত্রিম। রাষ্ট্রিক জাতীয়তাবোধ তো কৃত্রিম বটেই। কেননা ওটি সচেতন অনুশীলন ও অনুধ্যানের অপেক্ষা রাখে। এজন্যে জাতীয়তার কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। জাতীয়তা অভিন্ন স্বরূপে গড়েও ওঠেনি কোথাও। কারো জাতীয়তা রাষ্ট্রসীমাভিত্তিক, যেমন আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে; কারো জাতীয়তা ধর্মভিত্তিক, যেমন ইসরাইলে; কারো জাতীয়তা গোত্রনির্ভর, যেমন আফগানিস্তানে; কারো জাতীয়তা রাজনৈতিক আদর্শকেন্দ্রী, যেমন সোভিয়েট ইউনিয়নে। আজকের দুনিয়ায় সাধারণভাবে রাষ্ট্রিক-সীমাভিত্তিক জাতি-চেতনাই প্রবল। এ ধরনের জাতীয়তাবোধে রাজনৈতিক চেতনা ও স্বার্থবুদ্ধিই বন্ধনসূত্র, ধর্মমতের অভিন্নতা, সাংস্কৃতিক ঐক্যবোধ ও অভিন্ন-ঐতিহ্য-চেতনা তাতে অনুপস্থিত।

এজন্যে রাষ্ট্রভিত্তিক জাতীয়তাবোধ ও জাতি-পরিচয় নেহাত কৃত্রিম। রাষ্ট্রসীমার সংকোচন ও প্রসারণের সাথে কিংবা রাষ্ট্র ভাঙা-গড়ার সঙ্গে এমনি জাতীয়তার ও জাতির জন্ম-মৃত্যু ঘটে। রোমক জাতির অস্তিত্ব এমনি করেই লোপ পায়।

অতএব, রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রিক প্রয়োজনে যে-জাতি-চেতনা জাগে, রাজনৈতিক ও আর্থনীতিক অভিন্ন স্বার্থবোধই তার জনক। এইস্বার্থ সূত্রে আবদ্ধ জাতির জীবন টেকসই নয়। স্বার্থগত বিরোধে সে সূত্র ছিঁড়ে যায়, জাতীয়তাও যায় উবে, যেমন মিশর-সিরিয়ার যুক্তরাষ্ট্রে।

রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভের বাঞ্ছায় এবং আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য অর্জনের উপায় হিসেবে ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানেরা মুসলিম জাতীয়তায় বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। ইসলাম ও মুসলিম-সংস্কৃতি-চেতনা এর গৌণফল, মুখ্য লক্ষ্য নয়। অতএব, পাকিস্তান মুসলমানের রাজনৈতিক ও অর্থনীতিক স্বার্থচেতনা প্রসূত, ইসলাম ও মুসলিম সংস্কৃতির প্রতি প্রীতিজাত নয়।

আত্মবিকাশের ও আত্মবিস্তারের সুযোগ মেলে বলেই স্বাধীনতা মানুষের কাম্য। যে নামসার স্বাধীনতা প্রবলপক্ষের কাছে আত্মবিক্রয়ে দুর্বলপক্ষকে বাধ্য করে, সে-স্বাধীনতা তো বর নয়– অভিশাপ।

আমরা জাতে বাঙালি। আত্মবিকাশের সুযোগ পাব বলেই আমরা পাকিস্তান গড়েছি– আত্মবিলোপের জন্যে নয়। আমরা বাঙালি থেকেই, বাঙালিত্ব রেখেই পাকিস্তানী। কেননা, বাঙালি হিসেবে বাঙলার আবহাওয়ায় বাঙালি জীবনের প্রসার লক্ষ্যেই পাকিস্তান চেয়েছি–ইসলামের সেবার মহৎ উদ্দেশ্যেও নয়, ইসলামী সংস্কৃতির হাওয়াই সৌধ নির্মাণের স্বপ্নেও নয়। আমাদের সত্তা নিয়ে, স্বাতন্ত্র নিয়ে, বৈশিষ্ট্য নিয়ে এবং বিকাশের পথ উন্মুক্ত ও প্রশস্ত রেখেই আমরা পাকিস্তানের নাগরিক। আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ হবে সমান ও অভিন্ন। আমাদের নাগরিকত্ব হবে সমঅধিকারের ভিত্তিতে সমপর্যায়ের ও সমমর্যাদার। যেখানে মিল নেই, সেখানে মিলন অসম্ভব। অসমানে একত্রিত হতে পারে, কিন্তু মিলতে পারে না। এখানে অভিভাবকত্ব অচল। আমরা স্বধর্মী নিয়েই সমাজ করি, আত্মীয় নিয়ে করি ঘর, তাই বলে স্বার্থ ছাড়িনে। স্বার্থ বজায় রেখেও সৌজন্য দেখানো সম্ভব কিংবা সদ্ভাব রেখেও স্বার্থসচেতন থাকা অসম্ভব নয়। স্বার্থে ও সৌজন্যে দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলাই সুনাগরিকতা ও সংস্কৃতিপরায়ণতা।

আমাদের এবাদতে থাকবে ইসলামী বিধি, আমাদের মসজিদে থাকবে ইসলামী রীতি, আমাদের বোধে থাকবে ইসলামী নীতি, আমাদের রাজনীতিতে থাকবে পাকিস্তানী আদর্শ, আমাদের নাগরিক দায়িত্ব, জ্ঞান ও কর্তব্যবুদ্ধি চালিত হবে রাষ্ট্রের স্বার্থে–এ সব হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রিক ও বাহ্যিক জীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্যবুদ্ধিপ্রসূত চর্যা। আর আমাদের অনুভবের যে জীবন–যেখানে আমরা স্বাধীন, স্বতন্ত্র ও খেয়ালি তার রসদ যোগাবে আমার দৈশিক পরিবেশ, আমার দৈশিক ও জাতিক ঐতিহ্য এবং গ্রহণে-সৃজনে পাওয়া নতুন উপকরণ–ভাব, চিন্তা ও বস্তু।

কেউ তার স্বদেশের ঐতিহ্যকে অবহেলা করে না। কেননা ঐতিহ্যকে ভিত্তি করেই আত্মবিকাশ সহজে সম্ভব। তাই আমরাও স্বদেশের ঐতিহ্যকে পরিহার করব না। আমরা বাঙালি-চেতনা নিয়ে বিদেশী গুপ্ত-শাসনে গ্লানিবোধ করব, পাল-গৌরবে গর্বিত হব, স্বাধীন সুলতানী আমলের ঐশ্বর্য গর্বে উল্লসিত হব, মুঘল শাসনে হতবার বেদনাবোধ করব, ব্রিটিশ শাসনে অপমানের জ্বালা অনুভব করব।

আমরা বৌদ্ধযুগের মূর্তিশিল্পে পিতৃপুরুষের নৈপুণ্য প্রত্যক্ষ করব, সেন আমলের সংকীর্ণ ব্রাহ্মণ্যবাদের নিন্দা করব, মসলিন শিল্পের গৌরব করব, মসজিদ শিল্পের প্রসারে উল্লাসবোধ করব, বাঙলা ঘরের আকর্ষণে আকুল হব। ধনপতি-চাঁদ সওদাগরে বাঙালির উদ্যম দেখে খুশি হব, সত্যপীর-বড়গাজীতে বাঙালির কল্যাণবুদ্ধির বিকাশ দেখে আশ্বস্ত হব। বাউল-দর্শনের গৌরব করব। আমরা রাষ্ট্রের সেবায় রত থাকব। পাকিস্তানের আপদে বিপদে জান-মাল কোরবান করব। আমরা কোরান-হাদিস জানব, ইসলামের ইতিহাস স্মরণ করব। সে-সঙ্গে চর্যাগীতির রহস্য উদঘাটন করব, বেহুলা-লখিন্দরের গল্প পড়ব, বৈষ্ণব পদাবলী আস্বাদন করব, বিদেশী তুর্কী-মুঘল শাসক বিদ্বেষী বঙ্কিম-সাহিত্যের রস-গ্রহণ করব, রবীন্দ্রসাহিত্য-সমুদ্রে অবগাহন করব। কেননা ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় জাতীয়তার চেয়ে দেশ, গোত্র ও ভাষাগত ঐক্যের বন্ধন যে অনেক দৃঢ় তার সাক্ষ্য রয়েছে ইতিহাসের সর্বত্র। সে-সত্য অবহেলা করা জীবনকে তথা কল্যাণকে অস্বীকার করারই নামান্তর। এ তত্ত্ব জানে বলেই পশ্চিম পাকিস্তানীরা ময়েনজোদাড়ো-হরপ্পা ঐতিহ্যের সংরক্ষণ করে এবং হিন্দু-বৌদ্ধ ঐতিহ্যবাহী গান্ধার-এ নিজেদের খুঁজে পায়। আমরাও আমাদের পিতৃপুরুষের উত্তরাধিকার ছাড়ব না। ভুলব না আমাদের রিকথ।

সাংস্কৃতিক শুচিতার কথামাত্রই অবান্তর। কেননা সংস্কৃতি বদ্ধকূপের জিয়েল মাছ নয়। সংস্কৃতি বহতা নদীর স্রোত। প্রতিদিনের সূর্যের সঙ্গে তাল ঠুকে চলার নামই সংস্কৃতিপরায়ণতা। তাই সংস্কৃতি কখনো অবিমিশ্র হতে পারে না, গ্রহণে-সৃজনেই তার স্থিতি ও বহমানতা। বিকাশমানতাই সংস্কৃতি। সুন্দর ও কল্যাণকে প্রতিমুহূর্তে অনুভব করা, উদ্ভাবন করা, আবিষ্কার করা, জীবনে গ্রহণ করা ও ফুটিয়ে তোলাই সংস্কৃতি। যে সৃজন করতে পারে না, গ্রহণ করেই তাকে সংস্কৃতি চালু রাখতে হয়। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে শুচিবাই সংস্কৃতিবিমুখতার অন্য নাম। সৌন্দর্যচেতনা, কল্যাণবুদ্ধি, সৃজনশীলতা অন্তত গ্রহণশীলতা সংস্কৃতিপরায়ণতার লক্ষণ। To know all is to pardon all- তত্ত্বে উত্তরণই সংস্কৃতিপরায়ণ লোকের চরম লক্ষ্য।

সুস্থ ও স্বস্থ জীবন ও মননের বৈশিষ্ট্যই এই। ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিবিম্ব ধারণেই ঘট-জীবনের তুচ্ছতা এড়ানোর একমাত্র উপায়। নিজের সত্তার স্বাতন্ত্র রক্ষা করেও বসুধৈব কুটুম্বকম তত্ত্বের উপলব্ধি করাই মনুষ্যজীবনের লক্ষ্যহীনমন্যের আত্মসংকোচনে নয়। এ বিশ্বেরে দেখি তার সমগ্র স্বরূপে। ছন্দ নাহি ভাঙে তার সুর নাহি বাধে। স্বাতন্ত্রের মধ্যে, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যবোধ এভাবেই আসে। আত্মবিলোপে বিশ্ববোধ জন্মায় না, আত্মোপলব্ধিতেই চিত্তশুদ্ধি সম্ভব। কেননা আমি আছি বলে বিশ্ব আছে, অতএব নিজের সত্তার সঙ্গে বিশ্বের সম্পর্ক স্থাপনই জীবনের লক্ষ্য। নইলে জীববোধে আসে বিকৃতি। জীবনের প্রসাদ থাকে অজ্ঞাত। তখন এক পাশব প্রাণের ভার বয়ে জীবন হয় অনর্থক অবসিত। যদি আমরা বুঝতাম যে–এ দেহ-প্রাণ এক মহৎ শিল্পের ইজেল, তা হলে।

ধর্মবুদ্ধির গোড়ার কথা

মানুষের জ্ঞান সীমিত কিন্তু অজ্ঞতা অসীম। অজ্ঞতা থেকেই ভয়, বিস্ময় ও কল্পনার উদ্ভব। যা জানিনে, যা বুঝিনে তা জানবার-বুঝবার আগ্রহ থেকেই কল্পনার প্রসার। আদিম অজ্ঞ মানুষের জীবন ছিল ভয়, বিস্ময় ও কল্পনাশ্রিত। ফল ও মৃগয়াজীবী মানুষের সংখ্যাধিক্যে খাদ্যবস্তু যখন দুর্লভ হতে থাকে, তখন বাঞ্ছসিদ্ধির আত্যন্তিক কামনা মানব-মনে এক অদৃশ্য তৃতীয় শক্তির জন্ম দেয়। এর নাম জাদুবিশ্বাস। অভাব ও অতৃপ্তি বোধ থেকে উদ্ভূত হয় পাওয়ার বোধ। এর নাম কামনা বা আকাঙ্ক্ষা। অভাব-অতৃপ্তি মিটানোর জন্যে জাগে প্রাপ্তির ইচ্ছা। এই ইচ্ছার অভিব্যক্তি প্রচেষ্টারূপে শারীরক্রিয়ায় পরিণত হয়। এর নাম কর্ম। কিন্তু কর্ম মাত্রই সফল হয় না। তাই মানুষের অভাব মিটে না–সব প্রয়োজন সিদ্ধ হয় না। ব্যর্থতায় বিক্ষুব্ধ অসহায় মানুষ তাই কল্পনা করেছে অরিশক্তি ও মিত্রশক্তি-ইষ্টদেবতা ও অপদেবতা। জাদুবিশ্বাসে তাই দেখতে পাই ইষ্ট ও অরি দেবতার উপস্থিতি, তাদের দ্বন্দ্ব, তাদের হার-জিৎ। জীবনধারণের পক্ষে যা-কিছু প্রতিকূল তা-ই মন্দ আর যা কিছু অনুকূল তা-ই-ভালো। ভালো-মন্দ ধারণার ভিত্তি এ-ই। তাই ভালো-মন্দের সর্বজনীন চিরন্তন কোনো রূপ নেই। সত্যবোধও হচ্ছে ভালোমন্দ প্রসূত। তাই সত্যেরও কোনো একক রূপ স্বীকৃত নয়। কেননা ভালো, মন্দ ও সত্য আপেক্ষিক ধারণা– অনপেক্ষ নয় (relative, absolute নয়)। উপযোগই ভালো, মন্দ ও সত্যের মাপকাঠি। তাই কলা পাকলে হয় খাদ্য, বেগুন পাকলে হয় অখাদ্য। রাজায় বা রাজাদেশে কাড়লে-কাটলে দোষ নেই, পাপ নেই। কিন্তু ব্যক্তিক জীবনে তাই যুগপৎ vice, crime ও sin–সমাজে অন্যায়, রাষ্ট্রে অপরাধ, ধর্মে পাপ।

জাদুবিশ্বাস-অনুগ আচার-আচরণই মানুষের আদিম ধর্ম। যেহেতু বুনো ফল-মূল ও মৃগজীবী মানুষের বাঞ্ছাসিদ্ধিই এর লক্ষ্য, সেজন্যে এ-ধর্ম মানুষে মানুষে কোনো বিভেদ, বিদ্বেষ ও দ্বন্দের কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি। কেননা তখন প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে করে টিকে থাকাই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। যেখানে আত্মশক্তির তথা বাহুবলের শেষ, সেখানেই জাদুবিশ্বাসের উদ্ভব, সেখান থেকেই জাদুনির্ভরতার শুরু। মিত্রশক্তির আবাহনে অরিশক্তির বিতাড়নই ব্রত। আদিম মানবের অবোধ বাসনা চরিতার্থ করবার অক্ষম প্রয়াসে সৃষ্ট হয় প্রাকৃত শক্তির কাল্পনিক অনুকৃতিজাত তুকতাক-দারু-টোনা-মন্ত্র-তন্ত্র। ভাগ্য বা অদৃষ্টতত্ত্ব এ স্তরের বোধের দান।

কল্পিত তত্ত্বজিজ্ঞাসা প্রবর্তনা দেয় নিষ্ক্রিয় নিরীক্ষায় ও সক্রিয় পরীক্ষায়। এর থেকে অর্জিত হয় অভিজ্ঞতা। একের দেখে-জানা অভিজ্ঞতাই হয় অপরের শুনে-পাওয়া জ্ঞান। ক্রমে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান বাড়তে থাকে। কালে জ্ঞানে-বিশ্বাসে সংস্কার হতে থাকে জটিল ও বহুধা। কালের চাকা ঘুরছে অনবরত আর মানুষের জ্ঞান-বিশ্বাস-সংস্কারও হচ্ছে জটিলতর। বিশ্বাসের পরে এল জ্ঞান। তবু বিশ্বাসও রইল, জ্ঞানেরও ঠাই হল। জ্ঞান যুক্তির জনক। যুক্তি সংস্কার ভাঙে। বিশ্বাস সংস্কারকে প্রবল করে। যুক্তির আশ্রয় জ্ঞান বুদ্ধি, বিশ্বাসের প্রশ্রয় ভীরু মানুষের দুর্বলতায়, লোভী মানুষের অক্ষমতায়। যদিও বোধের থেকে বোধি, তা থেকে বুদ্ধির উন্মেষ, আর জ্ঞান বোধির যোগে আসে প্রজ্ঞা, তবু এর মধ্যে একটি প্রত্যয়স্বল্প অস্থির মানস-স্তর রয়েছে, যার ফলে জ্ঞান ও বিশ্বাসের মিশ্রণে গড়ে উঠে অধ্যাত্মবুদ্ধি, যা সুবিধেমতো কখনো জ্ঞানবাদী, কখনো বিশ্বাসপন্থী। এ বুদ্ধি এক অপার্থিব রহস্যলোক সৃষ্টি করে। ইহলোকে এ আলো-আঁধারির অস্পষ্টতা কখনো ঘুচবার নয়। কারণ অজ্ঞতা অসীম এবং জ্ঞানে অজেয়। তাই ইবনে রুশদ যখন বলেন– শাস্ত্র হচ্ছে সাধারণের জন্যে, আর জ্ঞানীর জন্যে প্রয়োজন দর্শনের, তাতে কোনো ইতর-বিশেষ হয় না। কারণ ফল ও প্রভাব অভিন্ন থেকে যায়। কেননা দুটোই কল্পনাপ্রসূত এবং পরিণামে সংস্কার-রূপেই স্থায়িত্ব পায়।

জ্ঞান-বুদ্ধি ও নৈপুণ্যের বৃদ্ধিতে ক্রমে বুনো-মানুষ উৎপাদনে ও পশু-লালনে জীবিকার ব্যবস্থা করল। তখন মানুষ কৃষিনির্ভর আর পশুজীবী। তখন প্রকৃতি ও পরিবেশই কেবল তার প্রতিপক্ষ নয়, উৎপাদন ক্ষেত্রের ও চারণভূমির সীমাবদ্ধতা এবং সামর্থ্যের পরিমিতি মানুষকেও করে তুলল মানুষের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। তখন ঈর্ষা-দ্বেষ কাড়াকাড়ি-হানাহানি হয়ে উঠল পারস্পরিক। তখন মানুষের সংগ্রাম দ্বিমুখী হলেও মানুষই প্রথম নম্বরের শত্রু বলে বিবেচিত হল। ফলে জাদুবিশ্বাস তো রইলই, তার উপর জগতে ও জীবনে নতুনতর তত্ত্বও হল আরোপিত। দুর্বলের নিরাপত্তা ও সান্ত্বনার জন্যে এবং সবলকে সংযত ও শৃঙ্খলিত রাখবার প্রয়োজনে কল্পিত হল ইহ-পরলোকে। প্রসারিত জীবন ও আত্মার অমরত্ব। রচিত হল অপৌরুষের শাস্ত্র। এই অভিনব উপায় উদ্ভাবিত হল গোত্র ও সমাজ শাসনের প্রয়োজনে। উদ্ভাবন করলেন যাঁরা, তাঁরা একাধারে জ্ঞানী এবং অধ্যাত্মবুদ্ধিসম্পন্ন। এ এক অদ্ভুত ফাঁদ যা জানবার বুঝবার কিংবা এড়াবার সাধ্য নেই কারো। কেননা বিশ্বাসে এর দিশা মেলে না, আবার বুদ্ধি ও জ্ঞানে এর ওর পাওয়া ভার।

এ শাস্ত্র জাগাল ন্যায়-অন্যায় বোধ এবং তজ্জাত পাপ-পুণ্যের ধারণা। এ পাপ-পুণ্যের ফল পরলোকে তো বটেই, ইহজীবনেও সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্যের কারণ হতে পারে। আবার এ ন্যায়-অন্যায় স্থান-কাল-পাত্রভেদে বিচিত্র। সবল ও দুর্বলের ন্যায়-অন্যায় অভিন্ন নয়! তিন টাকা দিয়ে কেনা গোলাম তার ত্রিশপুরুষ অবধি দেহ-মন ও মনুষ্যত্ব দিয়ে মালিকবংশের সেবা করলেও তিন টাকার ঋণ শোধ হয় না কেন, কিংবা ত্রিশ টাকা দিয়ে কেনা জমিতে তিনশ বছর গতর খাঁটিয়েও কৃষকের দাবী প্রতিষ্ঠিত হবে না, অথচ ত্রিশ টাকায় পাওয়া স্বত্ব অক্ষয় হয়ে থাকবে কেন–এ প্রশ্ন সে বোধের অন্তর্গত নয়। আবার রাজায় কেড়ে নেওয়াতে দোষ নেই, সামান্য লোকের কেড়ে খাওয়াতে বা চুরিতে পাপ কেন–সে-জিজ্ঞাসা হয়েছে অবান্তর বিবেচিত। সবলের পরিপূর্ণ সুবিধা-সুযোগের জন্যেই এ শাস্ত্র সবলপক্ষের তৈরি।

এই শাস্ত্র গোত্র-শাসন উদ্দেশ্যেই মূলত রচিত। সে উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু তা সমস্যা হয়ে দেখা দিল পরে, যখন নিঃসম্পর্কীয় গোত্রগুলো জীবন-ধারণের প্রয়োজনে সহযোগিতার নামে পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এল এবং একক দেবতা বা স্রষ্টার নামে ঐক্য স্থাপনের উদ্দেশ্যে তথা গোত্রীয় স্বাতন্ত্র্য-চেতনা লোপ করার প্রয়াসে অভিন্ন আদর্শভিত্তিক সমাজ গড়ার চেষ্টা হল। কেননা ইতিমধ্যে স্ব স্ব আচার-সংস্কার, নিয়মনীতি ও শাস্ত্রজবোধ গোত্রীয় ঐতিহ্যে ও মানস-সম্পদে পরিণত হয়েছে। পার্থিব আর আর ধন-জন-সম্পদের মতো এও প্রিয় ও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। এভাবে এটি যখন গোত্রীয় মর্যাদার ও গৌরবের প্রতীক হয়ে দেখা দিল, তখন দলে টেনে দল ভারী করার লোভে এর উৎকর্ষ ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনের মানবপ্রবণতাও পষ্ট ও সক্রিয় হয়ে উঠল। একের উৎকর্ষ ও শ্রেষ্ঠত্ব দেখাতে হলে অপরের অপকর্ষ প্রমাণ করতে হয়। নিন্দা থেকে দ্বন্দ্বের শুরু; বিরোধের পরিণামে বাধল সংগ্রাম। ধর্মীয় সে-কোন্দলের আজো ইতি ঘটেনি। একে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে সমাজ, সম্প্রদায় ও জাতি। বিলুপ্ত হয়েছে গোত্রবোধ। আজো সমাজে-ধর্মে-জাতে রাষ্ট্রে ধর্মই নিয়ন্ত্ৰীশক্তি, বিদ্বেষ-বিরোধের উৎস, জীবন-প্রচেষ্টার নিয়ামক, প্রীতি-সম্ভাবনার অন্তরায়। এর সঙ্গে সামান্য-অর্থে তুলিত হতে পারে এ-যুগের অর্থনীতি। দ্রব্য বিনিময় রীতির অসুবিধে দূর করার জন্যে চালু হল মুদ্রা। সমস্যার সহজ-সরল-সুন্দর সমাধান! সে-ব্যবস্থার অলক্ষিত-অভাবিত জটিলতায় আজ মানুষের দেহ-মন-আত্মা জলাবদ্ধ। ধনী-নির্ধন সমভাবে পীড়িত তার অদৃশ্য পাশ-বেষ্টনে। এ এক মায়াফাঁদ–ছাড়া যেমন অসম্ভব, সহ্য করাও তেমনি আত্মপীড়নের নামান্তর।

কালে কালে মানুষের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বোধি-বুদ্ধির প্রয়োগে ও পরিচর্যায় তত্ত্বে ও তথ্যে, চিন্তায় ও চিন্ময়তায়, উপলব্ধি ও অনুভূতির ঐশ্বর্যে, যৌক্তিক বিশ্লেষণের ঔজ্জ্বল্যে, তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার সূক্ষ্মতায় মানুষের শাস্ত্র বিপুল ও বক্র, বিচিত্র ও বর্ণালি হয়েছে। কিন্তু মৌল আদর্শে ও লক্ষ্যে কোনো বিবর্তন আসেনি। কেবল যখন জনচিত্তে স্বধর্মের গর্ব ও অনুভূতির উষ্ণতা মন্দা হয়েছে, তখন পুরোনো বুলির চমক-লাগানো নব-উচ্চারণে কেউ কেউ সমাজে সংসারে সহজ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। অথবা কোনো বাকপটু ব্যাখ্যার মারপ্যাঁচে জনমন ধাধিয়ে পুরোনো ধর্মের প্রশাখা কিংবা উপশাখা সৃষ্টি করে দেশকালের নেতৃত্ব পেয়েছেন। ন্যায়-নীতি সত্য-সদাচারের নামে সবাই কেবল বিভেদ বিদ্বেষ-বিরোধের কারণ বাড়িয়েছেন, ব্যবধানের প্রাচীর তুলেছেন, ঐক্য ও অভিন্নতার বুলি আওড়িয়ে খণ্ডের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছেন। মিলন-ময়দান তৈরির নামে খাদই খনন করেছেন বেশি। অবস্থা এমন যে, সন্ধির শর্তালোচনার জন্যে দাঁড়াবার ঠাইটুকু যেন আর অবশিষ্ট নেই।

আগের দিনে জীবন-যাপনের উপকরণ ছিল স্বল্প ও বৈচিত্র-বিরল। ঋজু জীবনের একঘেঁয়েমির মধ্যে বিচিত্র অভিলাষ জাগিয়ে প্রাণের উত্তেজনা-উৎসাহ বাড়ানোর উপায় ছিল না। জীবনধারণের কোনো দৃষ্টিগ্রাহ্য মান ছিল না জনগণের। ডাল-ভাত নয়, শাক-ভাত নয়–নুন ভাতেও তৃপ্তি মিলত। তাদের মনের দিগন্ত ছিল সংকীর্ণ, তাতে মন-বলাকা অভিলাষের পাখা মেলার কল্পনাও করেনি। গৃহাশ্রিত হাঁস-মুরগির মতো কেবল কুটিরের চারধারেই দেহ-মনের খাদ্য খুঁজত। তৃপ্তি পেত খণ্ড ও ক্ষুদ্রের তুচ্ছ সাধনায়। বিপুল পৃথিবী, মনুষ্যত্বের বিরাট সম্ভাবনা তাদের থাকত অজ্ঞাত। বহু বিচিত্রভাবে প্রসারিত-পরিব্যাপ্ত জীবনের প্রসাদ লাভের স্বপ্নও জাগেনি মনে। তা তারা রেখে দিয়েছিল রাজপুত্রের অধিকারে। তাই বেকার মনের অবলম্বন হয়েছিল সমাজ, সংস্কার, শাস্ত্র ও স্বার্থ। তুচ্ছকেই উচ্চ করে ধরে তারা জীবনে স্বস্তি ও উত্তেজনা খুঁজেছে। পরশ্রীকাতরতা আর পর-পীড়নের মধ্যেই পেয়েছে প্রাণের সাড়া। ভূত-প্রেত, দেও-দানব, জীন পরী-হুঁর কিংবা বিদ্যাধরী-অন্সরা রচনা করেছিল তাদের মনের কোণে প্রীতি-ভীতির অপরূপ জগৎ। সে-জগতের প্রভাব ছিল তাদের প্রাত্যহিক জীবনে। তাদের বাহ্য আচরণে ও মানস অভিব্যক্তির মধ্যে দেখা যেত সে-জগতের ছায়া।

কৌতূহলী মানুষের অনবরত অনুশীলনের ফলে জ্ঞানের পরিধি গেছে বেড়ে। বৈজ্ঞানিক অবিস্ক্রিয়ায় বিজ্ঞান বুদ্ধি হয়েছে প্রবল। অজ্ঞতার অরণ্যের ফাঁকে ফাঁকে পড়েছে জ্ঞান ও যুক্তি-সূর্যের ঝলমলে আলো। অলৌকিকতার বিস্ময়জাত আকর্ষণ গেছে কমে। ভোগ্যসামগ্রী হয়েছে বহুবিচিত্র। পৃথিবী হয়েছে অনেক বড়। মনের দিগন্তের প্রসার হয়েছে অসীম। অভিলাষ হয়েছে গণনচুম্বী। বুভুক্ষু গরু যেমন চারণভূমির উন্নতশীর্ষ কচি-নধর ঘন ঘাস অনন্যচিত্তে অনবরত গিলতে থাকে, ভোগ্যবস্তুর আধিক্যে লুব্ধ এবং বৈচিত্র্যে মুগ্ধ আজকের মানুষও একান্তই ভোগকামী হয়ে উঠেছে। সেজন্যে একদিকে দেও-দানো-হুঁরপরী যেমন সে ছেড়েছে, অন্যদিকে তেমনি পরিহার করেছে সংস্কার। অস্বীকার করেছে সমাজ ও শাস্ত্রবিধি। বৈরাগ্য ও ত্যাগের মহিমা হয়েছে ম্লান। আজকের পৃথিবীতে প্রাণ মেতে উঠবার, আবেগ উথলে উঠবার কারণ রয়েছে অনেক। এভাবে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলে গেছে বলে এ-যুগে ধর্ম আর প্রবর্তিত হয় না। ধর্মান্দোলন কিংবা ধর্মবিপ্লবের মাধ্যমে নেতৃত্বও মেলে না। তাই সে পথ হয়েছে পরিত্যক্ত। ভোগকামী মানুষের চিত্তহরণের নবতর পন্থাও হয়েছে আবিষ্কৃত। সে-পথেই জনচিত্ত জয় করে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা অর্জন সম্ভব। ধন-বণ্টন নীতি ও শাসন রীতি সম্পর্কিত নব নব পরিকল্পনা তৈরি করে, সম্পদ উপভোগ তত্ত্বের চমকপ্রদ ব্যাখ্যা দিয়ে, কিংবা দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকার তত্ত্বের মানস অনুশীলন-লব্ধ যুক্তিবুদ্ধি-অনুগ বিশ্লেষণ-চাতুর্যে জনমন মুগ্ধ করে, দেশে কালে ও সমাজে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব লাভ অসাধ্য নয় আজও। আগে যা ধর্মের নামে পাওয়া যেত, আজ তা Ism-এর দোহাই দিলে মেলে। লক্ষ্য ও ফল অভিন্ন। কেবল পরিবর্তিত পরিবেশে নতুন পদ্ধতি ঠাই নিয়েছে, কলাকৌশলের রূপান্তর ঘটেছে।

আসলে গোড়া থেকেই মানুষ এ জীবনকেই চরম বলে জেনেছে, এ পৃথিবীকেই ভালোবেসেছে। পার্থিক জীবনকে নির্ধ-নির্বিঘ্ন করবার জন্যেই জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা-বাঞ্ছায় মানুষ জাদুতে বিশ্বাস রেখেছে, দেও-দানো-ভূত-প্রেত মেনেছে, দেবতা এবং অপদেবতার পূজা করেছে, গড়েছে সমাজ ও শাস্ত্র। কল্পনা করেছে ইহ ও পরলোকে প্রসারিত জীবন। স্বীকার করেছে আত্মার অস্তিত্ব ও ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব। সৃষ্টি করেছে ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পুণ্য, নিয়ম-নীতি-সত্যের ধারণা। এই জীবনের প্রয়োজনই কর্মপ্রচেষ্টা ও ধর্ম-প্রেরণার ভিত্তি। এ কারণেই ভূতে ও ভগবানে মানুষের বিশ্বাস ও বিশ্বাসের উৎস অভিন্ন। ক্ষতি স্বীকারে অনিচ্ছুক বাঞ্ছসিদ্ধিকামী অসমর্থ মানুষ কাকেও অবহেলা করতে পারে না। জানে না কিছুই তাচ্ছিল্য করতে। চিরন্তন সুখ-লোভী, দুঃখ ভীরু মানুষ তাই স্বর্গের স্থায়ী সুখের লোভে স্বল্পকালীন পার্থিব জীবনের বঞ্চনা-দুঃখকে সহজে বরণ করার নির্বোধ প্রয়াসেও তৃপ্ত। আবার অসংযত অপরিণামদর্শী মানুষ সমাজের নিন্দা, রাষ্ট্রের শাসন ও পাপের শাস্তি অবহেলা করে বিধি-বহির্ভূত কাজ করে এই সুখের লোভেই।

এজন্যেই আদিম জাদুবিশ্বাস থেকে আধুনিক বিজ্ঞানবুদ্ধি অবধি মানুষের সব বিস্ময়, কল্পনা, চিন্তা ও জ্ঞানের সম্পদ মানুষ সযত্নে লালন করেছে, কিছুই পরিহার করেনি। সীমিত শক্তির মানুষ কোনোটাই তুচ্ছ বলে হেলা করে না। তুকতাক-দারু-টোনা, মন্ত্র-তন্ত্ৰ-পূজা-অর্চনা প্রভৃতি থেকে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া অবধি তার কাছে সবকিছুর সমান মূল্য-মর্যাদা। সে গরজ বুঝে সবকিছু সমভাবে কাজে লাগায়, সমান আগ্রহে মেনে চলে। এজন্যেই জগৎ ও জীবন ব্যাপারে তার মননে ও সিদ্ধান্তে, ধ্যানে ও ধারণায় কোনো যৌক্তিক পারম্পর্য নেই কার্যকারণ বোধের অবিচ্ছিন্ন সূত্র নেই। এ কারণেই তার মুখের বুলি আর বুকের বিশ্বাসে ঐক্য নেই। উক্তিতে ও আচরণে কোনো সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায় না। জীবনের প্রয়োজনেই সে সৃষ্টির মূলে– জগৎ ব্যাপারে দ্বৈততত্ত্ব মানে। ভালো-মন্দ (dualism-good & evil) শক্তির টানাপাড়নে যে জগদযন্ত্র বোনা, এর দ্বারা যে মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রিত, তা সে জরথুস্ত্রীয়দের মতোই বিশ্বাস করে। যদিও তার উচ্চমার্গের মননশক্তির মহিমা ক্ষুণ্ণ হবে বলে, সূক্ষ্মচিন্তার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে আশঙ্কায়, তা সে উচ্চারণ করে না। তাই মানুষ মুখে বলে আল্লাহর হুকুম ছাড়া বালিও নড়ে না, আবার অপকর্মের জন্যে ব্যক্তিবিশেষকে দায়ী করে। সে বলে–বিপদ থেকে আল্লাহ রক্ষা করেছেন। কিন্তু বিপদে ফেলেছিল কে?–সে-প্রশ্ন উচ্চারণ করতে সাহস পায় না। কেউ বলে–দুঃখ দিয়ে, যন্ত্রণা দিয়ে, রোগ-শোক দিয়ে আল্লাহ পরীক্ষা করছেন! কিন্তু সে-পরীক্ষা কেন, কিসের জন্যে, তাতে আল্লাহর লাভ ও উদ্দেশ্য কি, এ পরীক্ষার নিয়ম কি, মান কি? কশাইখানায় রোজ এত পশু অকালে প্রাণ হারায় কোনো অপরাধে? রোজ কোটি কোটি ডিম জ্বণ নিহত হয় কোনো পাপে? এ কার পরীক্ষা? এসবের উত্তর নেই। সবটা মিলে একটা মস্তবড় গোঁজামিল, এক বিরাট ফকির ফাঁদ, একটা সাজানো অপরূপ মিথ্যা, এক গোলকধাঁধা–দিশাহারা মানুষ কেবলই দিশা পাওয়ার জন্যে আলোর। কামনায় অন্ধকারে ছুটাছুটি করছে! এরই নাম অন্তর্জীবন লীলা। এ এক মায়ার খেলা। এর রূপ রস-জৌলুস মোহ জাগায়। এক আনন্দিত উন্মুখতায় জীবন কেটে যায়। এজন্যেই ধর্মবোধের মৃত্যু নেই।

বাসনা-আসক্ত মানুষের দুর্বলতায় এর জন্ম। প্রাপ্তি লোভী মানুষ এ দুর্বলতা থেকে কখনো মুক্তি পাবে না। কেননা সে বাঁচতে চায়, নিরাপত্তা চায়, চায় সুখ-স্বস্তি-আনন্দ– যা তার আয়ত্তের মধ্যে নয়, সামর্থ্যের ভেতরে নয়। তাই অলৌকিক উপায়ে সে তার বাঞ্ছসিদ্ধি কামনা করে। তার আত্মপ্রত্যয়হীন অসহায়তার মধ্যেই সৃষ্টি-পালন-সংহার কর্তার স্থিতি। অতএব পার্থিব জীবনের কল্যাণ কামনায় ধর্মবিশ্বাসের উদ্ভব, সামাজিক-রাজনৈতিক প্রয়োজনে তার বিকাশ আর দুর্বলের স্বস্তি-কামনায় তার চিরায়ু। বিপদে-আপদে রোগ-শোকে অপ্রাকৃত শক্তির অদৃশ্য হস্তের করুণা তার চাই-ই। তা যুক্তিগ্রাহ্য নাই বা হল, নাইবা হল বাস্তব। জ্ঞানের দ্বীপে দাঁড়িয়ে অসীম অজ্ঞতা সমুদ্রের কী ধারণা করা যায়!

বিকাশের পথে মানবতা

ধর্মের নামে, দেশের নামে, রাষ্ট্রের নামে বা ভাষার নিরিখে কী পরিচয় হতে পারে মানুষের? দেশ, ধর্ম, রাষ্ট্র কী মনুষ্য-যাত্রার লক্ষ্য? জীবতাত্ত্বিক দৃষ্টি দিয়ে দেখলে সাপ-ব্যাঙ, মশা-মাছি, গরু-গাধার মতো মানুষও একশ্রেণীর জীব। বহু জীব অধ্যুষিত পৃথিবীতে মানুষ হচ্ছে অন্যতম জাত। কাজেই গোটা দুনিয়ার সব মানুষ মিলে অপর জীবেতর একটি শক্তিমান জাতি মাত্র। যেহেতু স্বভাবের অর্জনশীল শক্তি রয়েছে মানুষের মধ্যে, সেহেতু মানুষ প্রাকৃত জীব না হয়ে হয়েছে সৃজনশীল জীব। তার রয়েছে স্বসৃষ্ট জীবন। যেখানে স্বসৃষ্টি সেখানেই স্বকীয়তা–সেখানেই স্বাধীনতা। তাই সেখানেই স্বাতন্ত্র্য। আর স্বাতন্ত্র কিছুকে বা কাউকে জাতিভ্রষ্ট করে না, বিচিত্র করে মাত্র।

দেশ ধর্ম রাষ্ট্র মানুষের কাম্যবস্তু নয়; কাম্যকে–প্রেয় ও শ্রেয়কে পাবার উপায় মাত্র। লক্ষ্য আমাদের মনুষ্যত্ব। একে অর্জন করবার জন্যেই আর সব উপলক্ষের প্রয়োজন। মনুষ্যত্ব কথাটি বড় গলাভরা, বড় বৃহৎ শোনায়, আপাতদৃষ্টিতে মহৎও। তাই আরো ছোট করে বলা যাক। আমাদের সাধনা হচ্ছে জীবন-সাধনা অর্থাৎ আমরা জীবনকে অনুভব করতে চাই, উপলব্ধি করতে চাই, চাই উপভোগ করতে। জীবনকে সুন্দর করতে হয় এই ভোগের গরজেই, কেননা ভোগ্য হয় সুন্দর না হলে কুৎসিতে ভোগ নেই, যন্ত্রণা আছে মাত্র। অতএব জীবনকে সুন্দর করে রচনা করতে হলে চাই উপাদান, চাই ক্ষেত্র। সর্বোপরি চাই পরিকল্পনা। জীবন রচনার জন্যে প্রথমেই দরকার পদ্ধতির–সে-পদ্ধতি হচ্ছে প্রথমত নৈতিক নিয়ম, তার প্রসার ধর্মবিধিতে, তার আনুষঙ্গিক সমাজ-শাসন বা সংস্কার, আর তার পরিণতি রাষ্ট্রের কানুনে। এ সবকিছুর মিলিত প্রচেষ্টা হচ্ছে মনুষ্যত্ব অর্জন তথা জীবনকে সুন্দর করা। সুন্দর জীবন আর মনুষ্যত্ব একই কথা। জীবন রচনায় দেশ হচ্ছে ক্ষেত্র। স্বস্তিবিহীনতায় সম্ভব নয় জীবন-স্বপ্ন। স্বাধীনদেশ, অনুকূল পরিবেশ, সুনিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রব্যবস্থা, উদার ও যুক্তিনির্ভর ধর্মবিধি এবং সংস্কারমুক্ত সৌন্দর্যবুদ্ধি মনুষ্যসাধনাকে সফল ও সার্থক করে। তাই এগুলোর প্রয়োজন। মনুষ্যত্ব বা সৌন্দর্যবোধ অর্জনে চেষ্টা এবং সৌন্দর্য সৃষ্টির প্রয়াস বা সাধনা বা সৌন্দর্যনুগত্যই হচ্ছে সংস্কৃতি বা কৃষ্টি-সাধনা। সুরুচি বল, সংস্কৃতি বল সবকিছুরই প্রেরণা আসে সৌন্দর্য-পিপাসা থেকে এবং এ সবকিছুই সৌন্দর্য-উপাসনা। এর লক্ষ্য হচ্ছে সুন্দরকে নিজের মধ্যে পাওয়া। দেহে-মনে, বুকে-মুখে সুন্দর হওয়াই হচ্ছে সংস্কৃতি সাধনার চরম ফল–পরম পরিণতি। এ ফল প্রাপ্তি ঘটলেই একজন মানুষ হয় যথার্থই ভদ্রলোক তথা সুনাগরিক, হয় ধার্মিক। কেননা মর্যাদাবোধই ভদ্রলোকের প্রধান বৃত্তি বা guiding force।

সৌন্দর্য-বুদ্ধির প্রথম ফল আত্মমর্যাদাবোধের উন্মেষ বা জাগরণ। যার মর্যাদাবোধ আছে, কোনো অন্যায়-অপকর্ম করতে পারে না সে। অন্যায়-অপকর্ম হচ্ছে সৌন্দর্যবোধের প্রতিদ্বন্দ্বী ও সংহারক। এটিই সমাজে নিন্দনীয়, ধর্মে পাপ আর রাষ্ট্রে অপরাধ। এ-ই হচ্ছে একশব্দে দোষ–যা জ্ঞানের বৈরী, যা মনুষ্যত্ব তথা সৌন্দর্য-সাধনার পথে প্রবলতর বাধা। অন্যায়-অপকর্ম কি? যা একের আপাত সুখে ও স্বার্থে অপর মানুষের ধনে, জনে বা প্রাণে ক্ষতি আনে, তা-ই অন্যায় অপকর্ম। অতএব সংস্কৃতি-সাধনা মানে সৌন্দর্য সাধনা তথা মনুষ্যত্ব অর্জন প্রয়াস। এ একাধারে ও যুগপৎ ভদ্রলোক, সুনাগরিক ও ধার্মিক হওয়ার সাধনা। কাজেই দেশ, ধর্ম ও রাষ্ট্র মানুষের জীবন সাধনায় উপায় বা উপলক্ষ মাত্র–আদর্শ উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য নয়।

কাজেই যখন আমি বলি আমি হিন্দু, আমি খ্রীস্টান, আমি মুসলমান; তখন লক্ষ্যভ্রষ্টতার পরিচয় দিই আমি। কেননা হিন্দু, মুসলমান বা খ্রীস্টান হওয়া তো লক্ষ্য নয় আমার জীবনের। হিন্দুয়ানী, মুসলমানী বা খ্রীস্টানী নীতির (এগুলো প্রাত্যহিক জীবনযাপন পদ্ধতির এক-একটি System বা code) মাধ্যমে মানুষ হওয়া সুন্দর হওয়াই আমার লক্ষ্য। শুধু এটুকু বলা যায় যে, জীবনযাত্রায় আমার পাথেয় ইসলামী বা হিন্দুয়ানী বা খ্রীস্টানী মতাদর্শ ও পদ্ধতি। কোনো পদ্ধতিই পরিণতির পরিচিতি হতে পারে না, বড়জোর পরিণামের ইঙ্গিত দিতে পারে মাত্র। তার মধ্যে গুণগত তারতম্য সম্ভব এবং স্বাভাবিক। সুতরাং উৎকর্ষ-অপকর্ষের বিচারও চলতে পারে হয়তো। অতএব মানুষে মানুষে, নীতি ও পদ্ধতিতে, পথ ও পাথেয়তে, মতে ও মননে পার্থক্য থাকলেও লক্ষ্য সেই এক–জীবনকে সুন্দর করে রচনা করা; জীবনে সৌন্দর্যকে উপলব্ধি ও উপভোগ করা। পথ ভিন্ন, পদ্ধতি নানা কিন্তু কাম্য এক, তীর্থ অভিন্ন। প্রাপ্তির স্বাদও অভিন্ন।

এজন্যেই আমাদের দেশ ভিন্ন, দুনিয়া এক; আমাদের জাত নানা কিন্তু জাতি এক। আমাদের রাষ্ট্র বহু কিন্তু শাসন-লক্ষ্য একটিই। আমাদের ভাষা বিচিত্র, ভঙ্গি একই। ভাব বহুধা কিন্তু বক্তব্য মূল অভিন্ন। আমরা সব জাত মিলে একমর্ত্যভূমিতে একজাতি। আমরা অপর জীবেতর মনুষ্যজাতি। আমাদের টিকে থাকার সংগ্রাম হবে জড় ও জীব জগতের বিরুদ্ধে; প্রকৃতি ও গ্রহলোকের বিরুদ্ধে। এজন্যে আমাদের হতে হবে সংহত ও সংঘবদ্ধ। এরূপে আমরা হব বিশ্বমানব। আমাদের সাধ্য-বিশ্বমানবতাবোধ ও উদ্বর্তন; কাম্য বিশ্বমানবতার স্বস্তি, শান্তি ও সুখ–যা সুন্দর হওয়ার ও সৌন্দর্য-সাধনার বাচ্যার্থে ও ব্যঙ্গ্যার্থে ফল ও কারণ দুই-ই। গত হয়েছে মণ্ডুকতা ও স্বাতন্ত্রের যুগ। আমাদের বুকে বিশ্বমানবতার স্বপ্ন ও সাধনা না জাগলে, মুখে বিশ্বমানবতার বুলি না ফুটলে, মনুষ্যজাতির দুর্দিনে-দুর্যোগ শুধু বাড়বেই। জাতীয়তাবোধকে আন্তরিকভাবে প্রসারিত করতে হবে আন্তর্জাতীয়তায়। নইলে নিষ্কৃতি নেই দেহ-মনের,–উদ্ধার নেই সঙ্কট থেকে। ইদানীং দেখা যাচ্ছে এ বোধের উন্মেষ। এই বৃহত্তর মানবরচতনায় একদিন সারা দুনিয়া সাড়া দেবে। সেদিন দূরে নয়; টিকে থাকার গরজে, স্বচ্ছন্দে বেঁচে থাকার অভিলাষে যেদিন আঞ্চলিক শাসন সংস্থার ব্যবস্থাভিত্তিক গোটা দুনিয়া পরিণত হবে এক রাষ্ট্রে। সেদিন দেশ, ধর্ম, জাত, বর্ণ নির্বিশেষে সব শুধু মানুষ নামে হবে পরিচিত। প্রাত্যহিক জীবনে যেমন একই সমাজে সাধারণ পরিচয়ে বর্ণ-বয়সের প্রশ্ন ওঠে না, তেমনি পরিচয়ে মা-বাপের দেওয়া নামটিই শুধু থাকবে অবলম্বন। লোপ পাবে আর সব ভেদ। সেই আভাসই পাওয়া যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের অসবর্ণ বিবাহে ও নিগ্রোদের আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে–তবু এ অলীক স্বপ্ন নয় কি?

বিশ্বের নাগরিক

মানুষের রুচি-প্রবৃত্তির বৈচিত্র্যে এবং বিবর্তনবাদে বিশ্বাস না করলে আজকের দিনে মানবসমাজের কোনো সমস্যারই সমাধান সম্ভব নয়। এমন একদিন ছিল যখন মানুষ ছিল সর্বব্যাপারে অজ্ঞ। অভিজ্ঞতা ও বৈজ্ঞানিক বুদ্ধির অভাব ছিল একান্ত। ফলে মনুষ্য- সাধারণের সর্বাত্মক জাগতিক ব্যাপারের বিধাতা ও নিয়ন্তা ছিল গোত্ৰাধিপতি নামের বিজ্ঞতর ব্যক্তি। সেকালে সে-অবস্থায় সর্বপ্রকার বিশ্বাসের এবং বিধান ও সমাধানের মূলে ছিল অপটু বুদ্ধি, অস্পষ্ট চিন্তা ও অন্ধ কল্পনা। সুতরাং সেকালে জনসাধারণের আচার-আচরণ ও বিশ্বাস-সংস্কারের উৎস ছিল বহিরারোপিত বিধি নির্দেশ–অন্তরাহৃত আস্থা নয়, বুদ্ধিলভ্য বোধিজাত উপলব্ধিও নয়। অতএব সেকালে মানুষ চালিত হত বহির্নির্দেশ জাত সংস্কারগত বিশ্বাসে– বিবেক লব্ধ বা নিরীক্ষিত প্রত্যয়ে নয়।

কালের অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষের বিবেকের বিকাশ হয়েছে, অভিজ্ঞতার পরিসর হয়েছে বিস্তৃততর, প্রত্যয় ক্রমে ক্রমে মন্থরগতিতে আঘাত হেনেছে সংস্কারলব্ধ বিশ্বাসের মূলে। কল্পনার অপরিসীম রাজ্য বাস্তববোধের প্রসারের সাথে সাথে সংকীর্ণতর হয়ে এসেছে। কিন্তু যেমনি করে বলছি, ঠিক তেমনি কিছু ঘটেনি। নতুন-পুরাতনের সংঘাত লেগেছে বারবার, বিপর্যেয় ঘটেছে মানুষের মনে, জীবনে ও আদর্শে। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বিস্তর, তবু লাভ হয়েছে প্রচুর, অগ্রগতি রয়েছে অব্যাহত–যদিও তা কখনো মন্থর, কখনো দ্রুত, কোথাও চরমে, আবার কোথাও বা পরমে, অর্থাৎ বিভিন্ন স্থানে বিচিত্র ধারায় তা গতি নিয়েছে।

কিন্তু অশিক্ষার প্রতিকূলতায় অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রবিশেষ প্রশস্ত হতে পারেনি আধুনিক-পূর্ব যুগে। কল্পনা-ঘুড়ির রঙিন সূতো তখনো আমাদের মনের মুঠোয়। বহিরারোপিত বিশ্বাস-সংস্কারের চশমার মাধ্যমে জগৎ ও জীবন তখনো পোশাকিরূপে আমাদের কাছে প্রতিভাত হয়েছে। সত্য ও মায়া, বুদ্ধি ও কল্পনা, কায়া ও ছায়া, বাস্তবতা ও আদর্শবাদ, প্রবৃত্তি ও নীতিবোধ প্রভৃতির চিত্তবিভ্রান্তকারী সংমিশ্রণে মানুষের জীবন স্বপ্ন ও রহস্যময় হয়েছিল। জাগর ও স্বপ্নের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা–আচ্ছন্ন মনের পক্ষে ছিল একান্ত দুঃসাধ্য। বাস্তবেতর বাস্তব, জগতের জগৎ, জীবনের জীবন, সুখ-দুঃখের সুখ-দুখ ধুলিমাটির দুনিয়াকে আর ভোগ-তৃষ্ণার দেহকে যথাযথভাবে স্বীকৃতি দিতে দেয়নি মানুষকে। তাই এতকাল, মানুষ শুধু ধর্মনির্ভর ছিল অর্থাৎ বহিরারোপিত বিধিনিষেধের পরিসরে বিচরণশীল ছিল। বিবেকের আহ্বানে, জীবনের সহজ চাহিদায় দ্বিধাহীনচিত্তে অকুণ্ঠ ও নিঃসংকোচ সাড়া দিতে সাহস পায় নি। ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা রয়েছে সে-কাহিনী। বঞ্চনা, ছল-চাতুরী, নরহত্যা, যুদ্ধ, নিপীড়ন, শাসন-শোষণ, আচার-বিচার-বিতর্ক, দান-সাহায্য, সত্য-মিথ্যা, হিংসা-দ্বন্দ্ব, ন্যায়-নীতি, লাভ-ক্ষতি সবকিছুই ব্যাখ্যাত, প্রচারিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়েছে ধর্মের নামে! এখানে আল্লাহ দণ্ডধারী মহাশাসক—-মানুষ ধর্মকলের প্রত্যঙ্গ (parts) বিশেষ। যা ঘটে আল্লাহই ঘটান, যা হয় এমনিতেই হয়। যুক্তি নেই, কার্যকারণ সম্পর্ক নেই। তবে নিয়মও আছে, নিয়তিও আছে। কিন্তু নিয়মের চেয়ে নিয়তির শক্তিই প্রবল।–এই বিশ্বাস-সংস্কারের আওতায় গড়ে উঠেছে আমাদের ধর্ম, সমাজ ও রাজ্য! এই ভিত্তিতেই পেয়েছি শিক্ষা, আদর্শবোধ এবং ন}য়-নীতি, পাপ-পুণ্য ও লাভ-ক্ষতির সংজ্ঞা। এখানে আছেন প্রভু আল্লাহ আর মানুষ বান্দা-~~ চালক আর চালিত, যন্ত্র আর যন্ত্রী। এখানে মানুষের আর কোনো পরিচয় নেই। আর একটুর আভাস আছে, তা হচ্ছে কলুর বলদের অবাধ্যতা–মানে প্রভুর নির্দেশে বাধা-চক্রে ঘুরপাক খেতে খেতে থেমে যাওয়া।

শিক্ষার প্রসারে অনুশীলনের প্রাচুর্যে মানুষের অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে নানাদিকে। বহির্জীবনে এবং মননে নব নব আবিক্রিয়া মানুষের মন ও মননকে একান্তভাবে বিজ্ঞানমুখী, যুক্তিনির্ভর ও বিবেকানুগত করে তুলেছে। বর্বর যুগে যে রঙিন চশমা মানুষ ও জগৎ জীবনের মধ্যে ব্যবধান বাঁচিয়ে রেখেছিল, তা হঠাৎ ঘুচে গেছে। জগৎ ও জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষ উপলব্ধি করছে আপন সত্তা, প্রত্যক্ষ করেছে ধূলামাটির দুনিয়াকে, চিনে নিয়েছে প্রবৃত্তি সমন্বিত জীবনের যথার্থরূপ। কল্পনা-ঘুড়ির সূতা ছিঁড়ে গেছে, ধসে গেছে সংস্কারের অন্ধকার গৃহের প্রাচীর। বহিরারোপিত বিশ্বাসকে বিতাড়িত করে তার জায়গা দখল করেছে যুক্তি ও যাচাই-নির্ভর প্রত্যয়। মানুষের মনুষ্যত্ব স্বীকৃতি পেল। আল্লাহ মানুষকে শক্তিও দিয়েছেন, সামর্থ্যও দিয়েছেন। ধর্ম-কলের প্রত্যঙ্গ নয়, মানুষ একটি সত্তা–আল্লাহ্র প্রতিনিধি-আল্লাহর প্রতিভূ স্রষ্টা! নিয়তি নেই, শুধু নিয়ম আছে। আর কারণ, নিরপেক্ষ কার্য অসম্ভব।

আল্লাহ শুধু দুনিয়ার অন্য যাবতীয় বস্তুর মালিক নয়, মানুষেরও মালিক। গোটা দুনিয়া সৃষ্টিরই (জড়-জীব) বিহার, বিলাস ও ভোগ ক্ষেত্র–শুধু মানুষের একার নয় এবং জড়-জীব পরস্পর নির্ভরশীল। অতএব, আদর্শ হোক–Live and let live (বেঁচে থাক এবং বাঁচতে দাও)। ধর্ম হোক–বিবেকের নির্দেশ ও যুক্তিবোধ।–আজকের মানুষের প্রাণের কথা এ-ই। অর্থাৎ এতদিন আমরা বহিরারোপিত ধর্মে চালিত হয়েছি। কিন্তু সমাজে সম্পদে আদর্শে বিশ্বাসে সংঘাত এড়াতে পারিনি। শান্তি দিইওনি, পাইওনি। এবার অন্তরাহৃত ধর্মের নির্দেশে চলা যাক! এবার সিদ্ধি সুনিশ্চিত, কেননা বিবেক প্রতারিত করে না। সুতরাং বহিরারোপিত ধর্মচালিত পূর্বযুগের মানুষের আচার-সংস্কার-আদর্শ-ঐতিহ্য প্রভৃতির প্রতি মোহ শুধু মানুষের মনের তমিস্রাকে গাঢ়তরই করবে। সেই অন্ধকারে মানুষের সহজ মনুষ্যত্ব শুধু পথ হাতড়িয়ে ব্যর্থ হবে, মুক্তি পাবে না। পূর্বযুগের গোত্রীয়, ধর্মীয় ও জাতীয় কারার বন্ধন থেকে মানুষকে আজাদ করে নীল আকাশের নিচে নরম মাটির উপর মহামিলনের মহায়োজন করাই হচ্ছে আজকের মানুষের একমাত্র উদ্যাপনযোগ্য ব্রত। মানুষের সংস্কৃতির, সাহিত্যের, সঙ্গীতের ও আদর্শের রূপ হবে একটি–তা মানবতা। সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। আজো যারা সাহিত্যে-সংস্কৃতিতে, ধর্মে-আদর্শে, সমাজে-সম্পদে স্বাতন্ত্রের কামনা-সাধনা করে তারা মানবতার শত্রু! কারণ– ধর্ম, সমাজ আর সংস্কৃতি মানুষের মনুষ্যত্ব সাধনার উপায় ও পন্থাস্বরূপ। এগুলো উপলক্ষ মাত্র–সিদ্ধি নয়, সুতরাং ব্যক্তির পরম ও চরম পরিচয় সে মানুষ। তার অবশ্য দেশ আছে, কাল আছে কিন্তু সে-সব তার পরিচয়বাহী নয়। যারা লক্ষ্য হারিয়ে উপলক্ষ নিয়ে লাঠালাঠি, মারামারি করে তারা শুধু হিন্দু, শুধু মুসলমান অথবা শুধু খ্রীস্টান- কিন্তু মানুষ নয়। মনুষ্যত্বের সাধনা তাদের নয় মানুষ হবার আকাঙ্ক্ষা তাদের নেই।

মানববিদ্যা

দূর অতীতে মানুষের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বিব্রত হয়ে পড়েছিলেন দুজন দার্শনিক। অবশেষে অনেক ভেবেচিন্তে একজন বলেন–মানুষ হাস্যময় জীব। অপরজন সংজ্ঞা দিলেন–মানুষ মননবৃত্তিসম্পন্ন জীব। এতকাল পরে আজ উপলব্ধি করছি, কেন এত শব্দ থাকতে তাঁরা হাস্যকর উক্ত শব্দদ্বয় বেছে নিয়েছিলেন মানুষকে চিহ্নিত করবার জন্যে! আমাদের মনে হয়, উক্ত দু-সংজ্ঞার সমন্বয় ঘটালে সম্ভব হয় মানুষ সম্বন্ধে পূর্ণাঙ্গ ও যথার্থ ধারণা করা। যেমন, মানুষ হাস্য ও মননবৃত্তিসম্পন্ন জীব। বোধ করি, এর থেকে মানুষের যথার্থ পরিচয় আর কিছু হতে পারে না। আরো একজন নৈয়ায়িক মানুষকে আখ্যাত করেছেন পালকবিহীন পাখি বলে। সে-কথা এখন থাক।

আমরা জানি–মানুষ কান্না এড়িয়ে বুকে-মুখে-নয়নে হাস্য ফুটিয়ে রাখবার জন্যেই চিন্তা করে আসছে চিরকাল। মানব-প্রচেষ্টার চিরন্তন ইতিহাসের সারমর্ম বা সংক্ষিপ্ত সার এই-ই। মানুষের মনে নির্ঘ নিঃশঙ্ক হাসি ফোঁটাবার জন্যে কালে কালে কত ধর্ম, কত ব্যবস্থা ও জ্ঞান-প্রজ্ঞা নীতিকথার প্রচার হয়েছে, ইয়ত্তা নেই তার। মানুষ যতই হাসবার চেষ্টা করেছে, ততই বেড়ে চলেছে মনন-চিন্তনের ক্ষেত্র, কিন্তু ফল স্থায়ী হয়নি কোথাও। মহামানবের মহৎ সাধনা যুগে যুগে বুদ্ধিমান ও স্বার্থলোভীদের ষড়যন্ত্রে হয়েছে পণ্ড।

হজরত মুসা এলেন আল্লাহর সুসমাচার নিয়ে; কিন্তু মানুষের মুখে হাসি ফুটতে-না- ফুটতে জগৎ-সংসার আচ্ছন্ন হয়ে গেল কান্নায়। হজরত ঈসা এলেন চোখের পানি মুছিয়ে মানুষকে আশ্বস্ত করবার জন্যে! কিন্তু মানুষ আশ্বস্ত হতে-না-হতেই চারদিকে আচ্ছন্ন করে দিল নৈরাশ্যের অন্ধকার। হজরত মুহম্মদ এলেন আল্লাহর শেষ বাণী নিয়ে। সে-বাণীর লাঞ্ছনা তো প্রত্যক্ষ করছি রোজ। তত্ত্ব ও তথ্যবিকৃত বলে নিন্দিত বাইবেলের অনুসারীদের মধ্যে যত মত-পথের সৃষ্টি হয়নি, অবিকৃত কোরআনের ধারকদের মধ্যে উদ্ভব হয়েছে তার শতগুণ বেশি ফেরকার।

শ্রীকৃষ্ণ চলার পথের নির্দেশ দিয়ে গেলেন গীতায়! চিন্তাশীলেরা পথ হারালেন বেঘোরে। বুদ্ধদেব এলেন, আশ্বস্ত হল মানুষ; কিন্তু কয়দিন? আচার্য শঙ্কর এসে আবার দিশা দিলেন শ্রেয়সের। কিন্তু কিছুতেই হবার নয় কিছু। এই হাসির জন্যে জগৎ জুড়ে কান্নার সে কি রোল! সুখের জন্যে দুঃখের দাহনে কী বীভৎস আত্মাহুতি। দুনিয়াব্যাপী সে কী নৃশংস হানাহানি, মারামারি আর গালাগালি। হাসি ফোঁটাবার অবকাশ এল না আর। সুদূর অতীতের ইতিহাস ঘেঁটে লাভ নেই। আরো আধুনিক নজিরও গ্লানিকর। সাম্য-ভ্রাতৃত্ব স্বাধীনতার-সন্তান নেপোলিয়ন সেদিন রক্তের বন্যা ডেকে এনেছিলেন য়ুরোপে। মানবতার পূজারী আব্রাহাম লিঙ্কন সেদিন নিহত হয়েছিলেন মনুষ্যত্বের ধ্বজাবাহীদের হাতেই। মানবাধিকারের এজেন্ট–সভ্যতাভিমানী আমেরিকায় নিগ্রো-নিগ্রহের অবসান হয়নি আজো। চোখের সামনে যা দেখছি আজ, তার খতিয়ানও যুগযুগান্তরের মনুষ্যসাধনার সকরুণ ব্যর্থতার মর্মান্তিক চিত্র বই তো নয়? Fraternity-র উদগাতা ফরাসিরা ইন্দোচীন ও আলজিরিয়ায় দেখিয়েছে অমানুষকিতার তাণ্ডবলীলা। তীব্র মানবতাবোধের অভিমানী ব্রিটিশের জ্ঞাতিগোত্র বর্বরতার প্রদর্শনী খুলেছে রোডেশিয়ায়, দক্ষিণ-আফ্রিকায়। ব্যক্তিসত্তায় বিশ্বাসী, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতার প্রচারক যে য়ুরোপ, সেখানে ফ্রয়েড, আইনস্টাইন আর রোমা রোলা হয়েছেন নির্যাতিত। বিশ্বশান্তির অছিলায় আমেরিকার কোরিয়া যুদ্ধ পরিচালনা, কোজে দ্বীপের কেলেঙ্কারি, ভিয়েতনামে বর্বর অভিযান প্রভৃতি হাজারো ব্যাপারে প্রমাণিত হচ্ছে মানুষ। চিন্তাবৃত্তিসম্পন্ন জীব, কিন্তু হৃদয়বান মানুষ নয়। এই মননশক্তি মানুষকে যুক্তির আশ্রয়ে শুধু হিংস্র লোভাতুর জীবে পরিণত করে রাখছে, দরদ ও বিবেক-নির্ভর মানুষে উন্নীত করছে না।

আরো দেখা যাক, মানবতার উপাসক ইংরেজের নৃশংসতা কী হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করিনি আমরা? সর্বপ্রকার শোষণ-অত্যাচার থেকে জনসাধারণকে মুক্ত করবার জন্যে এতকাল সাহিত্যে, সমাজে ও রাষ্ট্রে আন্দোলন করে আসছে যে প্রবুদ্ধ বাঙালি হিন্দু, আযাদী লাভের পর সে বাঙালি শাইকরাই গুলি চালায় ভুখ-মিছিলে। বহুনিন্দিত জমিদারি প্রথা কায়েম রাখার জন্যে তারাই। খুঁজছে আজ নানা ছলচাতুরীর আশ্রয়। পুঁজিবাদকে গালাগাল দেয় আর নিজেরাই পুঁজিপতি হবার সাধনায় করেছে আত্মনিয়োগ। উদার জাতীয়তাবাদের উদগাতা গান্ধী আর চিত্তরঞ্জনের স্বজাতি আজ ভিন্নধর্মাবলম্বীদের রক্তপাগল। মহাত্মা বলে পরিকীর্তিত ও পূজিত গান্ধী বেঁচে থাকবার অধিকার পেলেন না এই স্বজাতি ভক্তের দেশেই। মানবতা ও সাম্যবাদের ধ্বজাধারী রাশিয়া ও চীন অস্ত্রাঘাতে ধরাশায়ী করে মানুষের সাম্য প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী! কোরআনের অনুসারীরা আজ আচরণ, বিবর্জিত ইসলামি ধ্বজার বাহক হতেই উৎসুক। সুনীতির প্রবক্তারা চিরকালই কী এমন দুর্নীতির আশ্রয়েই পুষ্ট হতে থাকবে? তবু মানুষের প্রতি আস্থা হারাইনি আমরা। কেননা আমরা জানি, জনসাধারণের আসলের প্রতি আসক্তি আছে বলেই চিন্তাবিদ-বুদ্ধিমান প্রতারকেরা তাদের নাজেহাল করে নকল দিয়ে। ঠকে ঠকেও কী আসলে-নকলে পরখ করতে শিখবে না মানুষ? হাসির আশায়। আশায় শুধু কী কান্না নিয়েই থাকবে? চিন্তাশীল মানুষ কী সত্যিই পালকহীন পাখি? পাখির মতো বড় বড় বুলি মানুষ শুধু চিরকাল আওড়িয়েই চলবে হৃদয়ে তাদের মর্মার্থ ধারণ করবে না? তাদের স্বরূপ কী চেনা যাবে না? মানুষ কী চিরকাল হাস্য-সক্ষম ও মনন-সম্পন্ন জীবই থাকবে-হৃদয়বান। সহানুভূতিশীল মানুষ হয়ে উঠবে না? হাস্য-কাতর মানুষ কী হাসতে পারবে না? হাসির মরীচিকা দেখিয়ে দেখিয়ে সরল মানুষকে প্রতারিত করা হবে আর কতকাল? মানুষ হাসির অভিলাষী, তাই বলেই কী তাদের প্রতারণা ও মিথ্যা দিয়ে অশ্রুর লোনা দরিয়ায় ডুবিয়ে মারতে হবে? মানুষের সুখের সাধনা, শান্তির কামনা, সুন্দরের বাসনা কী সফল হবার নয়!

মানুষ! হায়রে হৃদয়হীন মননশীল মানুষ! মানুষের দুনিয়াকে বিষবাষ্পে আচ্ছন্ন করে রাখবে কতকাল, আর কতকাল! হায়–

এমন মানব-জমিন রইল পতিত,
আবাদ করলে ফলত সোনা!

সংস্কৃতি

এক কথায় Culture-এর কোনো সংজ্ঞা দেয়া চলে না। বলতে গেলে সবার গ্রহণযোগ্য কোনো সংজ্ঞাই দেওয়া সম্ভব হয়নি আজ অবধি। Culture-এর পরিভাষারূপে সংস্কৃতি কথাটা চালু হয়ে গেছে আমাদের ভাষায় এবং আমাদের আটপৌরে ব্যবহারে তা ঘরোয়া ও সহজবোধ্য হয়ে উঠেছে। আমরা মনে করি সংস্কৃতির স্বরূপ ও তাৎপর্য সম্বন্ধে আমাদের ধারণায় কোনো গলদ কিংবা অস্পষ্টতা নেই। তার কারণ সংস্কৃতি সম্বন্ধে আমাদের ধারণা স্বচ্ছ নয় বটে, কিন্তু লোকের সংস্কৃতিবানতা অনুভব করতে পারি। এ অনেকটা গঁড় দেখে হাতির ধারণা করার মতো। এজন্যে ব্যক্তিভেদে সংস্কৃতির সংজ্ঞা ও স্বরূপ বিভিন্ন।

আমাদের ভাষায় কৃষ্টি, সংস্কৃতি, তমদুন, তাহজীব, তমিজ, তরবিয়ৎ, সুরুচি, সৌজন্য, ভদ্রতা প্রভৃতি culture-এর পরিভাষা কিংবা স্বরূপ-লক্ষণ প্রকাশক প্রতিশব্দ প্রযুক্ত হতে দেখা যায়। কিন্তু এদের কোনোটিই পূর্ণাঙ্গ culture-এর প্রতিরূপ নয়, culture-এর খণ্ডাংশ মাত্র। অর্থাৎ এগুলোর প্রত্যেকটিই culture-এর অঙ্গীভূত, কিন্তু প্রতীক নয়, যেমন চোখ-কান-শুড়-লেজ-পা হাতির প্রত্যঙ্গ বটে, হাতি নয়। কেননা কোনো প্রত্যঙ্গেরই পূর্ণাবয়বের তথা হাতির স্বরূপের প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা নেই। কাজেই সংস্কৃতি সম্বন্ধে আমাদের ধারণা অন্ধ-হস্তী-ন্যায়-এর মতো সত্য বটে, কিন্তু সঠিক নয়। ফলে খণ্ডকে পূর্ণের মর্যাদা দানের বিড়ম্বনা ও বিভ্রান্তি ঘোচে না। এতেই আমরা সবাই নিজ নিজ ধারণায় অটল-অবিচল থাকবার যুক্তি ও সুযোগ পাই।

Culture বা সংস্কৃতি একটি পরিষ্ক্রত জীবন-চেতনা। ব্যক্তিচিত্তেই এর উদ্ভব ও বিকাশ। এ কখনো সামগ্রিক বা সমবায় সৃষ্টি হতে পারে না। এজন্যে দেশে কালে জাতে এর প্রসার আছে, কিন্তু বিকাশ নেই। অর্থাৎ এ জাতীয় কিংবা দেশীয় সম্পদ হতে পারে, কিন্তু ফসল হবে ব্যক্তিমনের। কেননা সংস্কৃতিও কাব্য, চিত্র ও বৈজ্ঞানিক আবিক্রিয়ার মতো স্রষ্টার সৃষ্টি। কৃতিত্ব স্রষ্টার বা উদ্ভাবকের। তা অনুকৃত বা অনুশীলিত হয়ে দেশে পরিব্যাপ্ত ও জাতে সংক্রমিত হতে পারে এবং হয়ও। তখন culture হয় সাধারণের সম্পদ ও ঐতিহ্য এবং পরিচিত হয় দেশীয় বা জাতীয় সংস্কৃতি নামে। যেমন হযরত মুহম্মদের জীবনে ও বাণীতে যে-সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটেছে, তা ই ইসলামী বা মুসলিম সংস্কৃতি নামে পরিচিত।

কাজেই একের পক্ষে যা real, অন্যদের কাছে তা ideal; একের পক্ষে যা স্বাভাবিক, অনুকারীদের কাছে তা-ই অনুশীলন-সাপেক্ষ ও কৃত্রিম। যেমন আনুগত্য, নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবোধ সৈন্যদের স্বােপলব্ধ নয়, তারা চাকরির শর্ত হিসেবে যান্ত্রিক পদ্ধতির অনুসারী মাত্র। কিন্তু যিনি বা যারা উপযোগ ও প্রয়োজন অনুভব করে নিয়ম-নিগড় উদ্ভাবন করেছেন, কৃতিত্ব তাঁদেরই। গাঁয়ের নিরন্ন, অজ্ঞ, অশিক্ষিত মজুরের তেমন লক্ষণীয় কোনো রুচিবোধ নেই। কিন্তু রুচিবান ধনীগৃহে বয়-বাবুর্চির কাজ নিয়ে মনিবের প্রয়োজনে তারা যে আদব-কায়দা, রান্না ও পরিবেশন পদ্ধতি শেখে তা তাদের মনিবের সংস্কৃতিরই অনুকৃতি। তেমনি দরজি, ওস্তাগার, সুতার, তাঁতি প্রভৃতি দেশের রুচিবান ধনী-বিলাসীদের পরিকল্পনা ও প্রয়োজনই রূপায়িত করে তাদের কাজে। তাজমহলের গৌরব তাই শাহজাহানের শ্রমিক ও শিল্পীদের নয়।

তাই যার মনে চেতনার উদ্ভব, কৃতিত্ব ও মৌলিকতার গৌরব তারই–অনুকারকদের নয়। নতুনতর কিছু কোনো ব্যক্তিমনে উদ্ভূত না-হওয়া পর্যন্ত অনুকারকদের মধ্যে পুরোনোটাই অনুবর্তিত হতে থাকে এবং সে-কারণেই তা জাতীয় বা দেশীয় সংস্কৃতি- রূপে পরিচিত হয়, কাজেই যে কোনো সৃষ্টিমূলে রয়েছে ব্যক্তিগত চেতনা। নতুন ভাব, চিন্তা কিংবা বন্ধুমাত্রই ব্যক্তিমনের দান। এককথায়, যে-কোনো উদ্ভাবন ও আবিষ্কার ব্যক্তিগত চিন্তা, অনুভূতি ও প্রয়াসের প্রসূন।

জীবনযাপনটাকে যদি শিল্পকর্মের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে জীবন রচনা ও চালিত করার জন্যে শিল্পীর মতো চেতনা, সৃজনশীলতা ও নৈপুণ্য প্রয়োজন। তেমন লোকের সামাজিক ভূমিকা বিদ্রোহীর ও বিপ্লবীর। কেননা পুরাতনে আকর্ষণ না হারালে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রেরণা মেলে না। সমাজে, ধর্মে ও রাষ্ট্রে, আচারে, আচরণে ও কর্মে রীতি-নীতি ও আদর্শে যারা কিছু নতুন করেছেন, তারা সবাই পিতৃপুরুষের সমাজ ও ধর্মদ্রোহী।

সাংস্কৃতিক প্রেরণার মূলে রয়েছে সৌন্দর্য-অন্বেষা। কেউ কেউ বলেন পশু-প্রায় মানুষ যেদিন ফুলের সৌন্দর্যে ও সুরের মাধুর্যে আকৃষ্ট হল–মুগ্ধ হল, সেদিনই হল মনুষ্যত্বের উন্মেষ। সে থেকেই মানুষ্যত্বের ও সংস্কৃতি-সভ্যতার শুরু, কেননা সেদিনই মানুষ অনুভব করে তার মন বলে একটা আশ্চর্য বৃত্তি রয়েছে যার শক্তির ও সম্ভাবনার সীমা নেই।

অতএব মনুষ্যত্বের পরিচয় সৌন্দর্য-চেতনায় ও পিপাসায়। সংস্কৃতিরও অন্য নাম সৌন্দর্য চেতনা ও সৌন্দর্য-অন্বেষা। যা দেখতে শুনতে বলতে কুৎসিত, যা ঘৃণ্য, যা অকল্যাণকর তা-ই অসুন্দর–কাজেই পরিহার্য। যা-কিছু কাম্য, আকর্ষণীয়, চিত্তবিনোদক, তা-ই সুন্দর ও কল্যাণকর। সংস্কৃতিবান এই সুন্দর ও কল্যাণের সাধক। সংস্কৃতিবান জীবনের রূপদক্ষ শিল্পী। উপযোগের চেয়েও প্রয়োজনীয় এ সৌন্দর্য মানুষের জীবনে। তাই মানুষ কেবল উপযোগ সৃষ্টিতেই তুষ্ট থাকে না, সৌন্দর্য সৃষ্টিতেও তৎপর হয়। যেখানে প্রয়োজনের শেষ, সৌন্দর্যের শুরু সেখান থেকেই। তার কাজে ও কথায় এই সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্যেই ভাষায় সে উদ্ভাবন করেছে সুরের, ছন্দের, নানা ভঙ্গির ও অলঙ্কারের; আর কাজে এনেছে শৃঙ্খলা, সুষমা ও সামঞ্জস্য। .

স্থূল প্রয়োজন সহজেই মেটে। কিন্তু সৌন্দর্য-পিপাসার শেষ নেই। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে ও সমাজে ধর্মে-রাষ্ট্রে মানুষের এই বিচিত্র বিকাশের মূলে রয়েছে এ সৌন্দর্যবুদ্ধি। এই পিপাসাই মানুষকে এগিয়ে নিচ্ছে নব নব বিকাশের পথে–শ্রেয়সের সন্ধানে। পুরাতনে অস্বস্তি ও অবজ্ঞা না জাগলে নতুনের আকাক্ষা ও প্রয়াস জাগে না। মানুষের সংস্কৃতি ও সভ্যতা এই পিপাসা, অন্বেষা ও প্রয়াসের ফল।

সচেতনভাবে না হোক, অবচেতন প্রেরণায় কিংবা সহজাত বৃত্তিবশে সব মানুষই এই সৌন্দর্য সাধনায় নিরত। কেননা সমাজবদ্ধ প্রাণী হিসেবে এতে তার বিশেষ প্রয়োজন। কারণ সমাজে তার Personal life আছে, কিন্তু Private life নেই। তার গায়ে যদি সুগন্ধ থাকে তা অপরের চিত্ত প্রসন্নতার কারণ হয়, তার দেহে রূপ থাকলে তা অন্যের আকর্ষণ জাগায়। তেমনি তার শরীরে ঘা কিংবা দুর্গন্ধ থাকলে তা অপরের অস্বস্তি জন্মায়। এমনি করে তার হাসি-কাশি সবকিছুরই প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া রয়েছে অপরের জীবনে। অতএব চিন্তায়, কর্মে ও ব্যবহারে লাবণ্য সৃষ্টি করে অপরের কাছে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলা মানুষের জীবনের সামাজিক দায়িত্ব ও প্রয়োজন। অবচেতনভাবে তাই আমরা সবাই নিজেদের সুন্দর ও শোভন করে অপরের কাছে তুলে ধরবার প্রয়াসে নিরত। তা আমাদের দৈহিক লাবণ্য সাধন চেষ্টায়, পরিচ্ছদের পরিচ্ছন্নতায় ও সুবিন্যাসে এবং অপকর্ম ও মিথ্যা গোপনের প্রয়াসে প্রকট। তফাৎ এই–যাঁরা সূক্ষ্ম চেতনা ও মনীষাসম্পন্ন এবং সৃজনশীল, তারা নতুন নতুন উদ্ভাবনে নিজেদের ঋদ্ধ করেন। তারা যুগোত্তর মনীষী ও যুগস্রষ্টা। আর সাধারণেরা থাকে গতানুগতিক, অনুকারক ও অনুসারক।

অতএব মৌলিক সংস্কৃতি মাত্রই সৃজনধর্মী ও গতিশীল। এজন্যে সংস্কৃতি কখনো পুরোনো হতে পারে না। অনুকারক অনুসারকের গতানুগতিক ধারার সংস্কৃতি আসলে সংস্কৃতি নয়,– আচার। কেননা স্থিতিশীল সংস্কৃতি প্রাণের প্রেরণাহীন ও তাৎপর্য-বর্জিত আচারে কিংবা সংস্কারে অবসিত হয়। যেমন জাকাত দানের মূলে দুঃস্থ মানবপ্রীতি, প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যবুদ্ধি এবং সংবেদনশীল ব্যাকুল হৃদয়ের যে মানবিক প্রেরণা ছিল, তা আজ অবলুপ্ত। ফলে তা আজ একটি অনভিপ্রেত ধর্মীয় কর্তব্য–একটি যান্ত্রিক আচার মাত্র।

চিন্তায়, কর্মে ও আচরণে জীবনের সুন্দর ও শোভন অভিব্যক্তিই সংস্কৃতি। মৌলিক চেতনা ও চিন্তা যার আছে, সে প্রতিমুহূর্তে নিজেকে রচনা করে চলে। সে ক্ষণে ক্ষণে নিজেকে নতুনভাবে অনুভব করে– সে-অনুভবে সে তিলে তিলে নতুন হয়ে ওঠে এবং সৃষ্টি করে নিত্যনব পরিবেশ। তার কাছের মানুষকে চমক লাগানোর ও আকৃষ্ট করার মতো ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে তার। সংস্কৃতিবান কখনো অসুন্দরের সঙ্গে আপোস করতে জানে না। তার চিন্তা, কর্ম ও আচরণ অন্যায় ও অকল্যাণপ্রসূ নয়। আত্মসম্মানবোধ, সহিষ্ণুতা, যুক্তিনিষ্ঠা, উদারতা ও কল্যাণবুদ্ধি তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

সংস্কৃতিবান জীবনযাত্রী তার চলার পথ দীপ্ত করে, পথের দু-ধারে দ্যুতি ছড়িয়ে, অপরকে দি গা দিয়ে, অন্তরের মাধুরী বিলিয়ে ও জীবনের প্রসাদ পেয়ে ধন্য হয়– ধন্য করে অন্যদের।

তাই সংস্কৃতিই জীবনযাত্রীর পাথেয়। তার কথায় কাজে চলায় স্কুল প্রয়োজনাতিরিক্ত যে লাবণ্য থাকবে, তা-ই হবে সমাজের অন্য মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্কের সূত্র। হৃদয়ের প্রীতিকামী আবেগই বিভিন্ন আত্মার মিলন-ডোের। তার বোধে ও দৃষ্টিতে বসুধৈব কুটুম্বকম। তাই সংস্কৃতিবান মানুষ সমাজে বিশিষ্ট কিন্তু স্বতন্ত্র নয়।

সাধারণ মানুষ সৃজনশীল নয়, তাদের উদ্ভাবনী শক্তি নেই। তারা গ্রহণশীল হয়েই হয় সংস্কৃতিবান। তাছাড়া কোনো দেশে বা জাতে মানুষের ব্যবহারিক ও মানসজীবনের সব চাহিদা মেটাতে পারে, সর্বপ্রকার অভাব ঘুচাতে সমর্থ তেমন প্রতিভাবান বা ততগুলো প্রতিভাধরের আবির্ভাব হয় না, অন্তত আজো হয়নি। কাজেই সৃজনশীলতার সাথে গ্রহণশীলতাও থাকা চাই, নইলে সংস্কৃতি চালু রাখা যায় না। এজন্যে কোনো দেশের বা জাতির সংস্কৃতি কখনো অমিশ্র বা মৌলিক থাকে না। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে স্বাঙ্গীকরণ বা আত্মস্থ করাই হচ্ছে সাধ্য। যারা সৃজনে সমর্থ নয়, অথচ গ্রহণবিমুখ–যেমন পার্বত্য ও আরণ্যক মানুষেরা তাদের মন-মনন ও সমাজ স্থাণু।

কেননা সংস্কৃতিপরায়ণতার অন্য নাম গতিশীলতা। ক্রমোকর্ষ ও উন্নয়নই এর ধর্ম। আমরা বাঙালিরা সংস্কৃতিবান হয়েছি, এগিয়ে চলেছিসৃজন করে নয়, গ্রহণ করেই। আমাদের ধর্ম এসেছে- উত্তরভারত ও আরব থেকে, ভাষাটাও উত্তরভারতের। প্রশাসনিক ঐতিহ্যও উত্তর ভারত, উত্তর এশিয়া ও য়ুরোপ থেকে পাওয়া। আজকের ব্যবহারিক জীবনের সব উপকরণ এবং মানসজীবনের সব প্রেরণা আসছে য়ুরোপ থেকেই। অতএব সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা গ্রহণশীল ও অনুকারক।

স্বদেশ, স্বভাষা ও স্বাজাত্য

আমরা প্রায় সবাই বাঙালি-মুসলমান অর্থাৎ দেশজ মুসলমান– এ-কথা অস্বীকার করবার জো নেই। আমাদের স্বভাবে, সামাজিক সংস্কারে, জীবনবোধে সর্বোপরি আমাদের নৃতাত্ত্বিক নিদর্শনে আমাদের এই বাঙালিয়ানার ছাপ রয়েছে পুরোপুরি। আবার আমরা ধর্মাদর্শে আরবের অনুসারী। কৃষ্টি-সংস্কৃতির চর্চায় এককালে আমরা ছিলাম ইরানের অনুকারী, এখন হয়েছি য়ুরোপীয় সভ্যতার সাধক!

বিগত হাজার বছর ধরে চলেছে আমাদের সমন্বয় সাধনা–তিনটে দেশ থেকে পাওয়া তিন ধারার স্বভাব, আদর্শ ও সংস্কৃতির সমন্বয়-সাধনা।

আদর্শ যত মহই হোক, জাতীয় জীবনে তা স্বভাবধর্মকে ছাপিয়ে উঠতে পারে না কখনো। স্বভাবের সঙ্গে রয়েছে আবহাওয়া-প্রতিবেশের সম্পর্ক, আর আদর্শবাদ হচ্ছে একান্তভাবে বুদ্ধিপ্রসূত। বৃত্তি-প্রবৃত্তির অভিব্যক্তিই স্বভাব; আর মন-মননজাত কল্যাণ বুদ্ধিই হচ্ছে আদর্শবাদ। স্বভাবের স্বপ্রকাশ প্রায় অপ্রতিরোধ্য আর জীবনে আদর্শের রূপায়ণ ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও সাধনাসাপেক্ষ। তাই হাজার বছরেও সার্থক বা সফল হয়ে ওঠেনি আমাদের সমন্বয়-সাধনা। গড়ার পরিমাণ হয়তো তবু বেশি, কিন্তু নগণ্য নয় ভাঙার পরিমাণও। কোরআন-হাদিস আমাদের নিত্যসঙ্গী, তবু লৌকিক সংস্কার থেকে আমরা মুক্ত ছিলাম না কখনো। আজ লৌকিক সংস্কার ছেড়েছি আমরা, আমাদের কৃতিত্ব নেই এতে–নেই কোনো সিদ্ধির আত্মপ্রসাদ। কেননা তার বদলে ধর্মাদর্শকে দৃঢ় করে ধরিনি আমরা। আসলে ভোগেচ্ছা ছাড়া এ-যুগে সবকিছুই ছাড়ছি আমরা, তাই ত্যাগ করেছি। কুসংস্কারও।

হয়তো আমাদের আরো বহু কল্যাণবুদ্ধি লোপ পাবে যুগ-প্রভাবে। কিন্তু স্বদেশ, স্বভাষা ও স্বজাতির প্রতি মমতা ছাড়তে পারব না কখনো। স্বদেশ তথা আবাস হচ্ছে নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত নিবাস। একে বলা চলে জীবনবৃন্ত। আর ভাষা হচ্ছে জীবন-রস। যে-ভাষার মাধ্যমে বোল ফোটে শিশুর, যে-ভাষায় অনুভূতি পায় অপরূপ অভিব্যক্তি, সে ভাষা বলতে গেলে–জুড়ে থাকে জীবনের সবখানিই। এ তথ্যটি ভালোভাবেই জানতেন আগের যুগের বাঙালি মুসলমান। তাই তারা স্বধর্ম ত্যাগ করলেও আঁকড়ে ধরে ছিলেন স্বভাষা। তাঁরা জানতেন ভাষা ও সাহিত্য শুধু মহৎ প্রেরণার সহায়কই নয়, জীবনানুভূতির ভিত্তি বা জীবনরসের উৎসও। তারা বুঝতেন শব্দের নিজস্ব কোনো স্বরূপ নেই। মানুষের রস-কল্পনাই শব্দকে দেয় মূর্তি ও দান করে প্রাণ। শব্দের ব্যঞ্জনা, ভাব বা চিত্র-প্রতীকতা আর সামগ্রিক অভিধা বক্তার রস-চেতনা, বুদ্ধি, বোধি ও অভিপ্রায় নির্ভর। বক্তার ভাবকল্পের দ্বারাই শব্দার্থ হয় নিয়ন্ত্রিত, শব্দার্থের দ্বারা পরিচালিত হয় না ভাব। তাই যেখানেই অনুভূতির কথা, যেখানেই বোধির প্রকাশ, সেখানেই বক্তার অভিপ্রায় শব্দকে–

অর্থের বন্ধন হতে নিয়ে তারে যায় কিছু দূর।
ভাবের স্বাধীন লোকে পক্ষবান অশ্বরাজ সম।

এজন্যেই ঈশ্বর, খোদা, নিরঞ্জন বা ভগবান মুসলমানের মুখে এক অপরূপ আল্লাই নির্দেশ করে। তাদের কাছে নামাজ নমস্কার নয়– সালাতই। রোজাও দৈনিক উপবাস মাত্র নয়–সিয়াম। অতএব প্রতিশব্দ ভাবের প্রতিরূপ যে বদলায় না, এ বোধ ছিল সেকালের স্থিতধী বাঙালি মুসলমানের। তাই ইসলাম বরণ করে তারা ছেড়েছিল হিন্দুয়ানী, অবজ্ঞা করেছিল–ভুলতে চেষ্টা করেছিল হিন্দু-ঐতিহ্যকে, কিন্তু ছাড়েনি স্বভাষা ও সাহিত্যের চর্চা। তাই আমরা আদিকাল থেকেই। পাচ্ছি হিন্দুর রচনার পাশে মুসলমানের রচনার সাক্ষাৎ। শাহ্ মুহম্মদ সগীর চণ্ডীদাসেরই। সমসাময়িক। মালাধর বসুর সাথে পাচ্ছি জায়নুদ্দিনকে। বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপলাই, কৃত্তিবাস, কবীন্দ্র পরমেশ্বর, শ্ৰীকরনন্দী, দ্বিজ শ্রীধর, মাধবাচার্য, মুকুন্দরাম প্রভৃতির পাশে পাচ্ছি সৈয়দ সুলতান, চাঁদকাজী, শেখ কবির, শা বারিদখা, শেখ ফয়জুল্লাহ, দৌলত উজির বাহরাম খা, মুহম্মদ কবীর, দোনাগাজী প্রভৃতিকে। শুধু কী তাই? মুসলমান কবিরাই বিষয় ও রস-বৈচিত্র্যে মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন বিচিত্র ধারায়। আর বিদেশাগত আমীর-ওমরাই শুধু বাঙলা ভাষা-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেননি, বহিরাগত অভিজাত মুসলমান-সন্ততিগণও করেছেন স্বকীয় অবদানে বাঙলা সাহিত্যের বিকাশে প্রচুর সহায়তা। বাহরাম খাঁ, শা বারিদ খা, সৈয়দ সুলতান, সৈয়দ মুর্তজা, সৈয়দ আইনুদ্দিন, কোরেশী মাগন ঠাকুর, মুহম্মদ খাঁ প্রভৃতির নাম ও আত্মপরিচয়ে রয়েছে আমাদের উক্তির সমর্থন। এঁদের কেউ কেউ আবার আমীর-ওমরাহর বংশধর বা স্বয়ং আমীর।

ধর্মান্তরে জাত্যন্তর হয়, কিন্তু দেশান্তর বা ভাষান্তর হয় না। য়ুরোপ খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করেছে, কিন্তু হিব্রু ভাষা ঠাঁই পায়নি সেখানে। বৌদ্ধধর্ম দেশদেশান্তরে গেছে, কিন্তু কারো জাতীয় ভাষা হয়নি পালি। কাফিরের ভাষা বলে আরবি ত্যাগ করেনি মুসলমান আরব। কোরআন তো নাযেল হল সে ভাষাতেই! বাঙালি মুসলমানের চিরকালের মুখের বুলি, প্রাণের ভাষা, স্বপ্নের বোল কী করে হয় হিন্দুয়ানী ভাষা? বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্যের ছাপ কম হবে না হিন্দুয়ানীর চেয়ে। আমাদের মধ্যযুগীয় অবদানের সম্যক উদ্ধার ও আলোচনা হয়নি আজো। আমাদের রিথের দলিল নেই আমাদের হাতে, মুছে গেছে স্মৃতি থেকেও, তাই নিজের সম্পদের দাবী জানাতে সঙ্কোচ বোধ করি আমরা। হীনমন্যতায় আমাদের রুচি-বুদ্ধি বিকৃত। আমরা বিভ্রান্ত, বিমূঢ়! ইতিহাসও আজ আমাদের কাছে যোবা। অথবা আমরা কালা ইতিহাসের বাণী আমাদের মর্মে দূরে থাক–কানেও পৌঁছে না। আরবি একদিন জবর-দখল বসাতে চেয়েছিল ইরানি ভাষায়; আত্মসচেতন ফেরদৌসীর নেতৃত্বে তা হয়েছে অস্বীকৃত ও বিচ্যুত। তবু মুসলিম ধর্ম-দর্শনে ইরানের দানই সবচেয়ে বেশি। আমরাও থাকব মুসলমান; আমাদের ভাষাও থাকবে বাঙলা। এ ভাষাই আমাদের মন-মননের অভিপ্রায় অনুসারে ইসলামি ভাবের জারকরসে অভিষিক্ত হতে বাধা নেই। এটুকুই আমাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।

স্বাজাত্যবোধ হচ্ছে মানুষের ব্যক্তিজীবনে বল-ভরসার আকর। আত্মকল্যাণই এর লক্ষ্য। কিন্তু কল্যাণ আপেক্ষিক শব্দ। অপরের অকল্যাণ করে নিজের হিত সাধন হয় না। ব্যক্তিস্বার্থ নিৰ্ধন্দু ও নির্বিঘ্ন করতে হলে পরিবার-পরিজনেরও বৃহত্তর স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়, তেমনি পরিবারের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যেই সামাজিক স্বার্থ সম্বন্ধে সচেতন থাকা চাই। সামাজিক-কল্যাণ সাধনের খাতিরেই স্বাদেশিক ও স্বাজাতিক কল্যাণের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়ে ওঠে অপরিহার্য। আর স্বাজাতিক কল্যাণের গরজে জেগে উঠে আন্তর্জাতিক শুভেচ্ছার কামনা। লোভের থেকেই দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের উৎপত্তি। তাই সবার আগে উচ্চারিত হয়েছে এ সম্বন্ধে সাবধান বাণী–মা গৃধঃ। বেঁচে থাকো বাঁচতে দাওLive and let others live-এ যুগের চরম দাবী এ-ই। এ পথেই পরম স্বস্তি তথা শান্তি। এ যুগদাবী জেগে উঠুক আমাদের হৃদয়ে। এ-ই কামনা করি।

স্বাতন্ত্র

সাপে-মানুষে যে পার্থক্য, তাকেও পারস্পরিক স্বাতন্ত্র্য বলা চলে। কিন্তু তাতে কারো গৌরব নেই, কেননা তা প্রাকৃতিক কিংবা সৃষ্টির নিয়মেই পাওয়া। জন্মসূত্রে যা মেলে, তা-ই স্বভাব। স্বভাবের বিভিন্নতা সৃষ্টি-বৈচিত্র্যেরই নির্দেশক। আর রূপগত ও গুণজাত অনৈক্য স্বাতন্ত্র-জ্ঞাপক নয়, বিধাতার বিচিত্র বিলাস-বিধানের পরিচায়ক।

মানুষের সম্পর্কে স্বাতন্ত্র-এর রয়েছে বিশিষ্ট্য অভিধা। স্বাতন্ত্র্য উৎকর্ষসূচক, বিশেষ ব্যঞ্জনা ঋদ্ধ শব্দ। মানুষের স্বাতন্ত্র্য অর্জিত গুণ। তা একান্তভাবে ব্যক্তিক চর্যায় ও চর্চায় লভ্য। এটি ব্যক্তিবিশেষের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বোধি ও মনন-সঞ্জাত। অতএব স্বাতন্ত্র্য কখনো সমাজ কিংবা জাতিগত হতে পারে না। একের উপলব্ধ সত্য অপরের অনুকৃতিজাত আচরণের তথ্যে পরিণত হলে তা প্রাণহীন মারাত্মক আধির রূপ নেয়। কেননা তখন তা অশিক্ষিত, অপরিশ্রুত এবং অনুপলব্ধ যান্ত্রিক অনুশীলন ছাড়া কিছুই নয়। যন্ত্র হচ্ছে একটি অবয়ব যা সুপ্ত শক্তির আধার। যন্ত্রীর অভিপ্রায়ই যন্ত্রকে চালিত করে। ফল হয় অভিপ্রায়-অনুগ। অভিপ্রায় যেখানে অস্পষ্ট; অস্থির, ফল সেখানে লক্ষ্য-নির্দিষ্ট হতে পারে না; আগুনের যেমন নিরবলম্ব কোনো রূপ নেই, তেমনি অভিপ্রায়-নিরপেক্ষ কোনো যন্ত্র নেই।

সচেতন মনের স্বতস্ফূর্ত অভিপ্রায়ে আর বন্ধ্যামনে আরোপিত অভিপ্রায়ে তফাৎ দুস্তর। ঘরে সংসারে লোকে সুনিশ্চিত অভিপ্রায়ে ব্যবহার করে আগুন। সে আগুন অবোধ শিশুর কর্তৃত্বে গেলে ঘটায় অনর্থ।

সমাজ-ধর্ম-জাতি-রাষ্ট্র প্রভৃতি যা-কিছু মনুষ্যকল্যাণে রচিত, তা হচ্ছে পরিচর্যা-পুষ্ট, পরিত রুচি, প্রজ্ঞা-ঋদ্ধ শ্রেষ্ঠ মানুষের মনন-মনীষার প্রসূন। নির্ঘ নির্বিঘ্ন নিশ্চিন্ত জীবন-প্রতিবেশ রচনার জন্যে যা পরিকল্পিত, বন্ধ্যা মনের অনুকৃত অভিপ্রায় সংযোগে তা-ই হয়েছে সঙ্কট-শঙ্কার আধার। সমাজ-ধর্ম-জাতি-রাষ্ট্রের নামে যত পীড়ন, যত রক্তপাত ও জীবন নাশ হয়েছে, তেমনটি মহামারী ভূমিকম্প-অগ্ন্যুৎপাত কিংবা ঝড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও হয়তো হয়নি।

প্রকৃতি আজ আর মানুষের শত্রু নয়–অনুগত। জীবজগৎ মানুষের কৃপাজীবী। মানুষ আজ অকুতোভয়। জগৎ প্রতিবেশে সে আজ যথার্থই স্বস্থ ও সুস্থ। তাহলে তাকে অমৃতের পুত্ররূপে, আনন্দের সন্তান স্বরূপ পাইনে কেন! তার কারণ, বাইরে যে স্বপ্রতিষ্ঠ বটে, কিন্তু তার মর্মমূলে জন্মেছে কীট। সে-কীটের দংশনে সে পীড়িত। বহির্জীবনের ঐশ্বর্যের মধ্যেও সে দুঃস্থ আর্ত। অপরিশ্রুত মনের আত্মরতি, বিদ্বেষ, অবজ্ঞা সংকীর্ণতা বদ্ধচিত্ততা ও স্বার্থবুদ্ধি জন্ম দিয়েছে এ কীটের। এ চিত্তে পরশ্রীকাতরতা ও পরপীড়নের উল্লাস ছাড়া কিছুই ঠাই পায় না। তাই মুসার পাপবোধ, ঈসার প্রীতিবাঞ্ছ, গৌতমের সহ-অবস্থান তত্ত্ব, মুহম্মদের যুক্তিনিষ্ঠা প্রভৃতি জনচিত্তাধারে ব্যঞ্জনাহীন বুলিরূপে বিধৃত। তার প্রয়োগও স্কুল এবং মারাত্মক।

অবশেষে মতানৈক্য আর আচার পার্থক্যই স্বাতন্ত্র্য সংজ্ঞায় পরিগৃহীত হয়েছে। তাও আবার কুড়িয়ে পাওয়া তথা বহিরারোপিত মত-আচার, স্বতঃউপলব্ধ কিংবা স্বসৃষ্ট নয় এবং সে কারণেই অকৃত্রিম নয়–আপাত-অপরিহার্য সংস্কার মাত্র। সমাজে ধর্মে জাতে কিংবা রাষ্ট্রে এই বুনো বদ্ধ নিষ্ঠা মানুষকে করেছে অমানুষ ও যান্ত্রিক। উপায়কে তারা ঠাওরিয়েছে লক্ষ্যরূপে, উদ্দেশ্যের ঘটেছে বিস্মৃতি। তাই দিশাহারা মানুষের মতাদর্শ হয়েছে মারণাস্ত্র। খ্যাপা মানুষকে মায়েতেও ভয় পায়। কেননা উন্মত্ত বা ক্রোধান্ধ লোকের সুমুখে মায়ের ধনপ্রাণও নিরাপদ নয়। বিশ্বমানবের উন্মত্তরূপ তাই পারস্পরিক শঙ্কার ও সঙ্কটের কারণ হয়ে রয়েছে। এই মত, আদর্শ ও আচারে যে নিষ্ঠা, তাতে রয়েছে কেবল অন্ধ আবেগ যুক্তি-বুদ্ধি নেই। ও আমার মতে আস্থা রাখে না, অতএব আমার দলের নয়; ও আমার আচার মানে না, কাজেই ও আমার পর। সে আমার দেশে বাস করে না, তাই সে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। সে আমার রাষ্ট্রবাসী নয়, অতএব সে বিজাতি। ও তো আমার ধর্মে বিশ্বাস রাখে না, কাজেই ও আমার শত্রু। ওর দেহাকৃতি আমার মতো নয়, অতএব ও অমানুষ। সমাজে ধর্মে জাতে রাষ্ট্রে অভিন্ন না হলেই সন্দেহ করতে হবে, শত্রু ভাবতে হবে–এই হচ্ছে মানুষের কয়েক হাজার বছরের উদ্যোগ-আয়োজন-আড়ম্বরের ফল। মনুষ্যসাধনার কী মর্মান্তিক ব্যর্থতা, মানব মনীষার কী বিস্ময়কর অপচয়! এই হিংস্র বিদ্বেষভাব জিইয়ে রাখার নাম স্বাতন্ত্র্য। গর্বোদ্ধত উচ্চারণের পৌনপুনিকতায় স্বাতন্ত্র্য তার মৌল অভিধা হারিয়ে অনুদার, অসহিষ্ণু, আত্মরতি সুখাভিলাষীর কুপমণ্ডুকতার প্রতিশব্দ রূপেই টিকে আছে।

তাই পরধর্মে ঘৃণাই ধার্মিকতা, বিজাতি বিদ্বেষই জাতীয়তা, পরমত অসহিষ্ণুতাই আদর্শনিষ্ঠা, সংস্কারাচ্ছন্নতাই সমাজানুগত্য, বিদেশী বিমুখতাই স্বদেশপ্রীতি আর পরশ্রীকাতরতাই রাষ্ট্রচেতনা নামে প্রশংসিত।

সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জীবনচেতনার নামে আদিম জৈববৃত্তির লালনে উৎসাহবোধ যেন বেড়েই চলেছে। আদিম মানুষের জৈব-বাসনা ও নির্বোধের সংস্কার জীবন-সত্য রূপে আজো নামান্তরে মানুষের জীবনের আদর্শ-উদ্দেশ্যের নিয়ামক–এ ভাবলে হতাশ হতে হয়।

যন্ত্র কোনো সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। সংস্কার-যন্ত্র চালিত মানুষও যান্ত্রিকতামুক্ত হতে চায় না। তাই দ্বন্দ্ব-সংঘাত, শঙ্কা-সংশয়ই মানুষের জীবনে বিধিলিপি রূপে স্বীকৃত। প্রাকৃত ও জৈবজগতে মানুষ আজ শত্রুজিৎ। মানব-মহিমার এ যে কত বড় দলিল, তা বলে শেষ করা যায় না। কেননা যখন ভাবি যে মানুষই একমাত্র জীব, যাকে নিজের জীবন নিজে রচনা করতে হয় বিরুদ্ধ পরিবেশের সাথে সংগ্রাম করে, যার নিজের দেহও ছিল না নিজের অনুগত তখন বিস্ময়ের সীমা পাইনে। কল্পনার সামান্য আশ্রয় নিলেই বুঝতে পারি, মানুষ কী অসামান্য উদ্ভাবন-শক্তির পরিচয় দিয়েছে, কী জগজ্জয়ী প্রতিভা রয়েছে তার! এমন একদিন ছিল যখন মাথায় চুল বাড়ছে, জটা হচ্ছে, উকুনে উত্ত্যক্ত করছে, দাড়ি-গোঁফ অসহ্য অস্বস্তির কারণ হয়েছে, হাত-পায়ের নখ অচল-অকর্মণ্য করে তুলেছে, অথচ অসহায় মানুষ কাটবার-ছিড়বার উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। তাছাড়া রোদ-বৃষ্টি-শীত তো রয়েইছে! জীবনারিকে মানুষ ক্রমে জীবন-মিত্রে পরিণত করছে! মানুষের এ মনীষা, এ নৈপুণ্য স্মরণে অভিভূত হতে হয়।

কিন্তু মানুষের সম্পর্কে মানুষ আজো পাশববৃত্তি মুক্ত হতে পারল না। আজ মানুষের একমাত্র শত্ৰু মানুষ। মানুষকেই মানুষের সবচেয়ে বড় ভয়। গৃহাশ্রিত বিশেষ জীবের মতো ঈর্ষ ও লোভী মানুষই মানুষের সুখে বাদ সাধে। বাইরে সে যেমন অসাধ্য সাধন করেছে, মনের অনুশীলনেও যদি তেমনি যত্নবান হত, তাহলে জীবনবৃক্ষে ফুল ফুটত, ফল, ফলত। সুন্দর হত জীবন, মধুময় হত তার দিন ক্ষণ। কিন্তু সম্ভাবনার এমন মানব জমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা–এ আফসোসই শুধু জেগে রইল। অথচ স্বাতন্ত্র-বুদ্ধি স্বরূপে জাগলে কেউ কারো সুখের প্রতিবাদী হতে পারে না, হওয়া সম্ভব নয়। কেননা উচ্চমানের সংস্কৃতিই স্বাতন্ত্রবোধের ভিত্তি। আর সংস্কৃতিচর্চার পূর্বশর্ত হচ্ছে আত্মমর্যাদাবোধের উদ্বোধন। যার মর্যাদাবোধ আছে, সে দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে উদাসীন থাকতে পারে না। সংস্কৃতির প্রথম পাঠ সহিষ্ণুতা ও উদারতা। রুচিবান মানুষ হিংসা-বিদ্বেষ-ঘৃণার শিকার হতে চায় না। তার মধ্যে থাকবে স্বাতন্ত্র-চেতনা, সে-স্বাতন্ত্র অর্জিত ও রক্ষিত হবে আত্মোকর্ষের ভিত্তিতে। অপরের তুলনায় নিজের উৎকর্ষ অনুভব করে সে আত্মপ্রসাদ লাভ করবে, আস্ফালন করবে না কখনো। আবার অপরের উৎকর্ষ-উন্নতি দেখে আত্মোন্নয়নে যত্নবান হবে, পিছুটান দিয়ে সমান করবার চেষ্টা করবে না, আর অসূয়ানলেও দগ্ধ হবে অকারণ। তার পথ প্রতিযোগিতার প্রতিদ্বন্দ্বিতার নয়। অপরের ক্ষতি করে নিজের প্রতিষ্ঠা বাঞ্ছ তার নয়। ঋণাত্মক নিবর্তনে তার উল্লাস নেই, ধনাত্মক উদ্বর্তনেই তার তৃপ্তি।

স্বাতন্ত্র্য হবে অসামান্যতার প্রতীক। তার মনোভূমি হবে সৃজনশীল–নিত্য বাসন্তী হাওয়া বইবে তাতে। ভাঙনে থাকবে তার বেদনাবোধ, গড়নে জাগবে উল্লাস। To know all is to pardon all হবে তার উপলব্ধ সত্যসার। সেক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র হবে অনন্যতার নামান্তর। Live and let live শ্রেণীর সহ-অবস্থানতত্ত্ব হবে তার জীবনের নিয়ামক। নিজে ভালো হও, আর অপরের ভালো চাও, ভালো করো–আদর্শ হবে তার জীবনের দিশারী।

কিন্তু এ যে বিশেষ সাধনা-সাপেক্ষ, তাও মনে হয় না। কেননা ঘরে-সংসারে আমরা মায়ের সন্তান, স্ত্রীর স্বামী আর কন্যার পিতা; বাইরে কারো মজুর, কারো মনিব, কোনো প্রতিষ্ঠানে। সদস্য–কিন্তু তাতে তো দ্বন্দ্ব দেখিনে। তেমনি নিজের সমাজ-ধর্ম-জাতি-রাষ্ট্রের প্রতি অনুরক্ত অনুগত থেকেই মানুষ নির্বিশেষের প্রতি অসূয়া-অবিশ্বাস-অপ্রীতিমুক্ত মনোভাব পোষণ করতে বাধা কি! মনের তেমন অবস্থাতেই কেবল নিজের স্বাতন্ত্র্য দাবী করা চলে। এই স্বাতন্ত্র উত্তম্মন্যতার ধারক, সমকক্ষের অসূয়া-দ্বন্দ্বের বাহক নয়।

স্বাতন্ত্রবোধ ও জাতিবৈর

০১.

ঘৃণা, হিংসা ও ঈর্ষা–এই তিনটে পরিবেশ ও পাত্রভেদে মানুষের একই বৃত্তির বিচিত্র অভিব্যক্তি মাত্র। আমরা ছোটকে ঘৃণা করি, সমকক্ষকে হিংসা করি, আর বড়র প্রতি হই ঈর্ষ। ঘৃণার স্বাভাবিক প্রকাশ অবজ্ঞায় ও অবহেলায়, হিংসার শূর্তি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ও পরশ্রীকাতরতায় আর ঈর্ষার প্রকাশ ধনে-মানে প্রতিষ্ঠিত জীবনের দোষ-সন্ধানে ও অসূয়ায়। দুর্বলের বিপর্যয়ে আমাদের অনুকম্পা জাগে, সমকক্ষের দুর্যোগে সুপ্ত জিগীষাপ্রসূত আহ্লাদ বোধ করি আর বড়র দুর্দিনে আত্মপ্রসাদ পাই। অবশ্য এদের সঙ্গে প্রীতির কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকলে এদের দুঃখ-বিপদে বিচলিত ও দরদে বিগলিত হওয়াই স্বাভাবিক।

আমরা ছোটর সঙ্গে মিশতে চাইনে প্রাণের আরাম নেই বলে, সমকক্ষকে এড়িয়ে চলি প্রীতির অভাবে ও আত্মপ্রতিষ্ঠার গরজে আর বড়কে ধরা দিইনে তার সামনে বিব্রত বোধ করি বলে এবং নিজের ব্যক্তিত্ব স্ফুর্তি পায় না ভেবে। এসব অবশ্য আত্মপ্রত্যয়হীন সাধারণের আচরণ, যারা নিজেদের ব্যক্তিত্ব ম্লান হল ভেবে সর্বক্ষণ আতঙ্কগ্রস্ত। এরা বাইরে ভীরু আর অন্তরে প্রতিদ্বন্দ্বী। এ নিষ্ক্রিয় দ্বন্দ্বভাব তাদের মনের বিকৃতি ঘটায়। মনুষ্যত্বের সহজ বিকাশ এর ফলেই রুদ্ধ হয়। এরা সঙ্কীর্ণমনা, ছিদ্রান্বেষী ও অপচিকীর্ষ। কিন্তু যারা প্রাণধর্মের তাগিদে চলে, যাদের জীবন-জিজ্ঞাসা আছে, তাদেরকে এ বৃত্তি ভিন্নপথে চালিত করে। যে উচ্চতায় থেকে তারা দুর্বলকে ঘৃণা করবার মৌরসী অধিকার পায়, সে উচ্চতা বজায় রাখবার–পতন রোধ করবার সতর্কতাও তারা এ পথে লাভ করে এবং সমকক্ষের প্রতি হিংসার উত্তেজনা তাদের মনে জিগীষা জাগায় এবং শক্তি ও যোগ্যতা অর্জনে তাদের প্রবুদ্ধ করে। আর বড়র সমকক্ষ হবার প্রেরণাও খুঁজে পায় তারা। এই প্রতিক্রিয়াকে ইংরেজিতে incentive বলে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়–প্রতিযোগিতাই (competative spirit) হচ্ছে এদের স্বভাব। জীবনে এগিয়ে যাওয়ার পথ ও পাথেয় এরা সহজেই খুঁজে পায়।

.

০২.

আগের যুগে মানুষের শিক্ষাদীক্ষার সুযোগ ছিল না। চিন্তা বলতে অন্নচিন্তা আর তত্ত্ব বলতে অধ্যাত্মতত্ত্বই তাদের পরিচিত ছিল। জীবনকে–জীবন-সমস্যাকে তলিয়ে দেখবার, মানুষের বৃত্তি প্রবৃত্তিকে যাচাই করে খুঁটিয়ে বুঝবার গরজ বোধ করত না সাধারণে, সে সাধ্য তাদের ছিল না। তারা ছিল মোটা কথা আর স্কুল প্রয়োজনের মানুষ। ভবলীলা বলত বটে, কিন্তু জীবনলীলা জানত না, বুঝত কেবল জীবনে নিয়তির লীলা। পাপ-পুণ্য চেতনা তীব্রতর ছিল সত্য, কিন্তু পাপ-পুণ্যের সূক্ষ্ম সীমারেখা চিনত না।

তাই তাদের জীবনে সারল্য ছিল, স্থূলতা ছিল, আদর্শবাদও ছিল–ছিল না কেবল সূক্ষ্ম জীবনচেতনা যা দিয়ে ভালো, মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, লাভ-ক্ষতি যাচাইয়ের নতুনতর মাপকাঠি তৈরি করা যায়। তাদের জীবন ছিল অনুভূতি ও অনুসৃতি নির্ভর। তারা ছিল বাধা-পথের যাত্রী, নিয়মের পূজারী এবং পীর ছিল তাদের দিশারী। ডানে-বাঁয়ে পা ফসকে গেলেই মানুষ হারিয়ে যেত, নৈতিকমানে তলিয়েও যেত। আমরা সাধারণ মানুষের কথা বলছি; অসামান্য ব্যক্তি চিরকালই স্বতন্ত্র, কাজেই তাদের কথা আলাদা।

.

০৩.

সেকালে মানুষের চলনে-মননে-কথনে মত বলতে একটিই ছিল–ধর্মমত। মানুষের প্রাত্যহিক, ব্যবহারিক ও আচারিক জীবনের খুঁটিনাটি সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হত ধর্মমতের দ্বারা। কাজেই সে-যুগে মতান্তর ছিল মারাত্মক ব্যাপার। মতান্তর মাত্রই মনান্তর, ফলে তা ছিল দ্বন্দ্ব-সংঘাত সঙ্কুল। মত প্রীতি এ-যুগেও কম নয়, কিন্তু শিক্ষা-দীক্ষার ফলে পরমতসহিষ্ণুতা এসেছে অন্তত প্রচুর বেড়েছে। সে-যুগে এটিই ছিল প্রায় অজ্ঞাত। ফলে মতান্তর দ্বন্দ্বপ্রবণতায় ইন্ধন যোগাত। আর তাতেই স্বমতের হলে মেহেরবান আর ভিন্নমতের হলে দুশমন ঠাওরানো হত। এ যুগে এর কিছুটা উন্নতি হয়েছে, স্বমতের হলে মিত্র ভাবি বটে, কিন্তু ভিন্নমতের হলেই শত্রু মনে করিনে।

Animism-এর আমলের গোত্রীয় দ্বন্দ্ব ও বিচ্ছিন্নতা এড়ানোর জন্যেই ঐক্যবদ্ধ সমাজসৃষ্টির প্রয়াসে অভিন্ন স্রষ্টা ও উপাস্যের নামে মতাদর্শের অভিন্নতার ভিত্তিতে মানবিক ঐক্য, সহযোগিতা ও প্রীতি স্থাপনের পন্থা হিসেবে চিন্তাশীল মানুষ উদ্ভাবন করলেন ধর্মের। কাজেই–ধর্ম এল মানুষের স্বস্তি-শান্তির জন্যে, সমাজবদ্ধ মানুষের পারস্পরিক বোঝাঁপড়ার গরজে। সব মানুষ একমত হতে পারল না। তাই সৃষ্টি করে চলল তাদের পছন্দমতো নানা ধর্ম। বাধল সংঘাত। কারণ পরমতসহিষ্ণুতা ছিল না। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ধর্মের নামে কত রক্তনদী বয়ে গেছে তার হিসেব নেই। বর স্বরূপ যা কামনা করা হয়েছিল, এভাবে তা শাপে পরিণত হল। এ যুগের আগে ধর্মমতই ছিল মানুষের শঙ্কা ও ত্রাসের কারণ। চোর-ডাকাতের ভয়ে ধনী যেমন সদা-শঙ্কিত, সংখ্যালঘু দুর্বলও তেমনি থাকত সতত সন্ত্রস্ত। ধর্মমতই ছিল জাতি নির্ণয়ের নিরিখ। এ কারণে শুধু-যে জাতীয় জীবনই বিপন্ন হত, তা নয়; ব্যক্তিজীবনও নিরঙ্কুশ ছিল না। কেবল কী তা-ই, একই ধর্মাবলম্বীর বিভিন্ন শাখায়ও লেগে থাকত হানাহানি। মানুষের চরম কাম্য হচ্ছে নির্ঘ-নির্বিঘ্ন জীবন অর্থাৎ শান্তি। তারই উপায়স্বরূপ সৃষ্টি হয়েছে সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্র। আশ্চর্য, এ সবই হয়ে উঠল মানুষের কাল। এদের পেষণে মানুষ হারিয়েছে দিশা–জীবনের সহজ ও স্বাভাবিক স্ফূর্তির পথ।

স্থূলবুদ্ধির স্বধর্মের প্রতি আত্যন্তিক প্রীতি পরমত-অসহিষ্ণুতা তীব্র করে ও অর্থহীন অভিমান বাড়ায়। স্বাতন্ত্রবোধ তারই সন্তান। অন্ধ-অনুকৃতিকে সে স্বকীয়তা মনে করে, আর সে-স্বকীয়তার মহিমায় নিজেকে গরীয়ান ভাবতে তার ভালো লাগে। রক্ষণশীলতার জন্ম এখানেই। আর স্বাতন্ত্রকামী রক্ষণশীলের জাতিবৈর না থেকেই পারে না; কেননা আত্মরতি মাত্রই পরপ্রীতির পরিপন্থী। অতএব স্বাতন্ত্র্যবোধ জাতিবৈর জাগায়, আর জাতিবৈর স্বাতন্ত্র্যবোধ তীক্ষ্ণ ও তীব্র করে। এর আর একটি আত্মধ্বংসী দোষ-এ মন গ্রহণ করতে পারে না; সত্য, শিব ও সুন্দরকে বরণ করতে জানে না। এ অবস্থায় দৃষ্টি আচ্ছন্ন ও মন মোহগ্রস্ত থাকে। তাই পরমতের প্রতি সুবিচার করা সম্ভব হয় না। ভালো-মন্দ যাচাই করা চলে না, ফলে আত্মপ্রসার হয় না, আত্মক্ষয়ই তার পরিণতি। কল্যাণ-বুদ্ধিই তার জাগে না। আত্মসংকোচনে নিজেকে দুর্বল করে করে একসময়ে সে অপমৃত্যুই ডেকে আনে। ভয় আছে অথচ হিতবুদ্ধি নেই, তাই বর্জনই তার আদর্শ। নতুনকে– কল্যাণকে এভাবে বর্জন করেই সে হয় দেউলিয়া, জীবন-রসের ঘটে অভাব, ফলে সমাজ-দেহ যায়। ধসে, জাতীয় জীবন হয় বানচাল।

.

০৪.

অবস্থান্তরে এর আর একটি প্রতিক্রিয়া বা রূপও দেখা যায়। আপাতদৃষ্টিতে একে উদার ও মহিমময় বলে মনে হয়। একই গোত্রের বা গোষ্ঠীর একটা অংশ যখন ভিন্ন ধর্ম গ্রহণ করে, তখন তারা পরস্পর বিজাতি হয়। ফলে মন-মননের যোগসূত্র হয় ছিন্ন। পৈত্রিক-ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা, জ্ঞাতিত্ব অস্বীকার এবং জাতীয় ঐক্য বিনষ্টি ধর্মান্তরের অনিবার্য ফল।

স্বধর্মনিষ্ঠার সঙ্গে মৌরসী ঐতিহ্য অস্বীকারের গরজ বোধ করে সে। সনাতনীর আভিজাত্যবোধ আর নতুনের উত্তম্মন্যতা পারস্পরিক অশ্রদ্ধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অসহিষ্ণুতা ও দ্বন্দ্বপ্রবণতার ফলে সংঘাতও অনিবার্য হয়ে উঠে। এর আভাস পাই আর্য ইতিকথায়। পণ্ডিতের মুখে শোনা যায়, প্রাচীন ইরানে একসময়ে আর্যরা বাস করতে থাকে। ধর্ম ব্যাপারে একদা তাদের দ্বিমত দেখা দেয়। একদলের ইষ্ট দেব অপর দলের দুশমন দেও হয়ে উঠে। এ দলের শত্রু অসুর ও দলের দেবতা অহোররূপে পূজা পায়। তাই হয়তো শুরু হল লড়াই। পরাজিত দলই বাস উঠিয়ে দিয়ে নতুন বাস্তুর খোঁজে ভারতে আসে। এভাবে কিংবা ধর্মান্তরের ফলে যখন দেশ একধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত হয়, তখন নয়া ধর্মমতবাদীরা বিধর্মী পূর্বপুরুষের জ্ঞাতিত্ব কিংবা মৌরসী ঐতিহ্য অস্বীকার করে না, বরং সাদরে ও সাগ্রহে বরণ করে নেয়। এ কারণেই মুসলিম আরব হাতেমতাই, নৌফেল, ইমরুল কায়েস প্রভৃতির ঐতিহ্যগবী। ইরান শাহনামায় নিজেকে খুঁজে পায়। পারস্যের বাদশাহ আজ ইরানের শাহ, আরীয় মেহের ও পহলবী। আর ভারতের সনাতনীরা যে নয়াধর্মকে (বৌদ্ধধর্মকে) একদা গ্রাস করে, সেই ধর্মের দেব-দ্বিজ ও বেদ্বেষী অশোক ও তাঁর বৌদ্ধধর্মচক্রকে তারা জাতীয় মহিমা ও ঐতিহ্যের প্রতীক বলে সগর্বে বরণ করে নিয়েছে। অথচ আমরা জানি অশোক ব্রাহ্মণ্যবাদীদের প্রতি সদয় ছিলেন না; তিনি বলিদান রহিত করে ধর্মাচরণে বাধা সৃষ্টি করেছিলেন। বৌদ্ধ-রাজত্বে জীবহত্যা নিষিদ্ধ ছিল বলে ভারতবাসীরা আমিষ ভোজন প্রায় ভুলে গিয়েছিল। বাঙলার বাইরে বর্ণহিন্দুর নিরামিষপ্রীতি বৌদ্ধযুগের সেই ধকলের সাক্ষ্য বহন করছে। আর সে-যুগে বৌদ্ধে-ব্রাহ্মণ্যবাদীতে মারামারিও কিছু মাত্র কম ছিল না।

প্রতিপক্ষতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকেই হানাহানির উৎপত্তি। আর হানাহানি থাকলে স্বাতন্ত্র্যবোধ জাগবেই। (পাকিস্তান-পূর্ব যুগে হিন্দুদের বিলেতী পোশাক ও সংস্কৃতি বর্জন আর মুসলমানদের ধুতি বর্জন এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়)। এক্ষেত্রে যে-কোনো এক প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষের বিলুপ্তিতে বিদ্বেষ ও বিক্ষোভজাত চিত্ত-বিকৃতির উপশম হয়। সহজ কথায় বলা যায়, এ হচ্ছে প্রতিবেশী সুলভ হিংসা ও হানাহানি। প্রতীচ্য দেশীয়রা আমাদের প্রতিবেশী নয়, তাই তাদের সংস্কৃতি গ্রহণে আমাদের গ্লানিবোধ নেই। হিন্দু-মুসলমান পরস্পর প্রতিবেশী, তাই এখানে গ্রহণ-বরণ চলে না, বর্জনাদর্শই বজায় রাখতে হয়। কল্পনা করা যাক পাক-ভারতের সবাই মুসলমান হয়ে গেছে, তখন রামায়ণ মহাভারত মুসলমানদের জাতীয় মহিমার প্রতীক হবে, প্রতাপ-শিবাজী হবেন জাতীয় বীর।

আমি একবার ইসলামে দীক্ষিত এক ব্যক্তির মুসলিম পৌত্রকে জিজ্ঞাসা করেছিলোম– মুঘলেরা হলেন বিদেশী, আর প্রতাপ-শিবাজী হলেন দেশী লোক; এঁরা যদি আজকের আমাদের ইংরেজ তাড়ানোর মতো মুঘলকে তাড়াবার সাধনা করে থাকেন, তবে আমাদের সহানুভূতি তাঁদের প্রতি থাকা উচিত নয় কি? সে এ-কথার দুটো উত্তর দিয়েছিল। প্রথমটা দিয়েছিল তর্কের খাতিরে, আর দ্বিতীয়টা ছিল তার মনের কথা। সে বলেছিল–প্রতাপ-শিবাজীও তো এককালের বিদেশীর বংশধর। আর প্রতিবেশী বা জ্ঞাতির চেয়ে বিদেশী আত্মীয় প্রিয়তর। মুঘলেরা ধর্মসূত্রে আমাদের আত্মীয়-আমাদের ভাই। এ-কথার উপর তর্ক চলতে পারে, কিন্তু এটি হচ্ছে জীবনে অনুভূত ও পরীক্ষিত সত্য। কাজেই হৃদয়ের স্পর্শহীন মগজপ্রসূত যুক্তিপ্রয়োগ নিরর্থক। সত্যেন দত্তের আমরা বাঙালি কবিতায় বাঙলার কোনো মুসলিম-ঐতিহ্যের উল্লেখ নেই দেখে, এক হিন্দুবন্ধুকে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলাম-ঈসা খান তো হিন্দুর বংশধর, চাঁদ-প্রতাপের সঙ্গে তাঁর নামটি অন্তত উল্লেখ করা যেত। তিনি উত্তরে বলেছিলেন–মুসলমান হয়ে গেল যখন, তখন তো আর আপন ভাবা যায় না। আমরা জানি এর উপর আর কথা চলে না।

অতএব দেখা গেল, এই প্রীতিহীন অনাত্মীয়ভাব বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর প্রতিবেশিকতারই ফল। তেমনি প্রতিপক্ষের অনুপস্থিতিতে তথা বিলুপ্তিতে বিধর্মী পূর্ব-পুরুষের মহিমামুগ্ধতা এবং ঐতিহ্যগর্বও অপর একধরনের সংকীর্ণচিত্ততা ও বিকৃতি প্রসূত। বাহ্যত একে শুভ ও শোভন মনে হলেও এও চিত্ত-প্রসারের অভাবজাত। কেননা এ ইতিহাস ও ঐতিহ্যচেতনার পশ্চাতে রয়েছে আদিম গোত্র-প্রীতি। মধ্যযুগে এ মনোভাব উদার-হৃদয় ও উন্নত মননের পরিচায়ক বলে অভিনন্দিত হতে পারত। কিন্তু এ-যুগে নয়। কারণ এ মনোভাবই এ-যুগের কাল–স্বস্তি-শান্তির শত্রু ও মানবতার দুশমন।

.

০৫.

এক হিসেবে বলতে গেলে আধুনিক যুগের সঙ্গে আগের কালের কোনো পারম্পর্য বা জ্ঞাতিত্ব নেই। এ যুগ শিক্ষিতের, যুক্তির ও বিজ্ঞানের। এ-যুগের জীবনের ভিত্তি বিচিত্র বিষয়ে জ্ঞান–যুক্তি (Rationality) এর অস্ত্র, আর বিজ্ঞান এর বাহন। এ-যুগ গণতন্ত্রের। কাজেই আমাদের ভুললে চলবে না যে আমরা যৌক্তিক জীবনের (Rational life) অধিকারী–এই মৌলিক স্বীকৃতির ভিত্তিতেই গণতন্ত্র চলতে পারে। এর আনুষঙ্গিক অঙ্গীকার রইল–আমাদের জীবনের ভিত্তি জ্ঞান, সম্বল যুক্তি আর বাহন বিজ্ঞান। নানা ধর্ম ও জাতি অধ্যুষিত এবং মতবাদ আকীর্ণ আজকের রাষ্ট্রে স্বাতন্ত্রবোধ ও জাতিবৈর গুরুতর অপরাধ। আজকের জাতীয়তা রাষ্ট্রভিত্তিক হতেই হবে। নইলে কল্যাণ নেই। নিজেদের এ বোধের অভাবেই জার্মানিতে ইহুদীরা নির্যাতিত হয়েছিল। আমরা জানি ক্ষতিস্বীকারের শক্তিতে মনুষ্যত্বের প্রকাশ এবং বরণ করার ক্ষমতাতেই সংস্কৃতির পরিমাপ। আমাদের জীবনচেতনা অনায়াসলব্ধ নয়, সাধনা-সাধ্য। পরিচর্যা করেই জীবনবৃক্ষে ফুল ফোঁটাতে, ফল ফলাতে আর রূপ চড়াতে হয়। জীবনে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সহিষ্ণুতার ও উদারতার, প্রীতির ও কল্যাণ বুদ্ধির।To know all is to pardon all. এই বোধ না জাগলে এ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বা ব্যক্তি-স্বাধীনতার যুগে সমাজে স্বস্তিতে বাস করা যাবে না। এ-যুগ মতবাদ পেশ করবার বা placing-এর যুগ–চাপানোর বা প্রচারের (preaching) কাল নয়। আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন প্রত্যেক ভদ্রলোকেরই তা বোঝা উচিত। শুধু কী তাই! এ যুগ মিলনের আর মিলানোর এবং দেওয়ার আর নেওয়ার যুগ। তাই স্বরাষ্ট্র ও স্বাজাত্যে সন্তুষ্ট থাকা যায় না– আন্তর্জাতিক শুভেচ্ছাও জাগিয়ে তুলতে হয়। কেননা রাষ্ট্রিক স্বাজাত্যবোধই হচ্ছে আজকের মানুষের ব্যক্তিজীবনে বল ভরসার আকর। আত্মকল্যাণই এর লক্ষ্য। কিন্তু কল্যাণ আপেক্ষিক শব্দ। অপরের অকল্যাণ করে নিজের হিত সাধন হয় না। ব্যক্তিস্বার্থ নির্ঘ ও নির্বিঘ্ন করতে হলে পরিবার-পরিজনের বৃহত্তর স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। তেমনি পরিবারের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যেই সামাজিক কল্যাণ সাধন করা প্রয়োজন হয়। সামাজিক কল্যাণ সাধনের খাতিরেই স্বাদেশিক মঙ্গলের দিকে সতর্কদৃষ্টি রাখা অপরিহার্য হয়ে উঠে। আর রাষ্ট্রিক কল্যাণের গরজেই আন্তঃরাষ্ট্রিক শুভেচ্ছার কামনা জেগে উঠে। লোভের থেকেই দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের উৎপত্তি। তাই সবার আগে উচ্চারিত হয়েছে এ সম্বন্ধে সতর্কবাণী-মা গৃধঃ। বেঁচে থাকো, বাঁচতে দাও; ভালো হও, ভালো চাও–এ যুগের চরম দাবী এ-ই। কেননা এ-পথেই পরম স্বস্তি ও শান্তি। আমরা আশাবাদী। মানুষের স্বাভাবিক ও পরিশীলিত মহত্ত্বে আমরা আস্থাবান। সেদিন হয়তো দূরে নয়, যখন বিশ্বমানবিকতা-বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ এক বিশ্বে এক রাষ্ট্রের অর্থাৎ বিশ্ব-রাষ্ট্রের ধ্বনি তুলবে।

Exit mobile version