অপ্রেম
তুর্কী-আফগান-মুঘলেরা এদেশে আসে পরাক্রান্ত বিজয়ী শাসকরূপে। বিদেশী বিজাতি, বিধর্মী ও বিভাষী বিজেতার কবলে পড়ার অভিজ্ঞতা এদেশের জনগোষ্ঠীর নতুন ছিল না। দ্রাবিড়, অস্ট্রিক, আর্য, নিগ্রো, শক, হুন, ইউচি, গ্রীক প্রভৃতিও উড়ে এসে জুড়ে বসে এখানে। কিন্তু এদের কারো সুসংবদ্ধ ধর্মদর্শন ছিল না। কেউ ছিল সর্বপ্রাণবাদী, কেউ ছিল জাদুবিশ্বাসী, কেউ ছিল টোটেম-টেবু স্তরে, আবার কেউবা ছিল উঁচুস্তরের প্যাগান-পৌত্তলিক। তাই তারা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় যত্ন করেনি। সে প্রয়োজনই ছিল না তাদের। এদেশে যা সুন্দর, যা কল্যাণকর ও যা উপযোগসিদ্ধ, তা ই তারা গ্রহণ করেছে অকাতরে। মানুষ তখনই হয় গ্রহণবিমুখ, রক্ষণশীল ও স্বাতন্ত্রকামী, যখন সে নিজের যা-কিছু আছে তাকেই জীবন-জীবিকার পক্ষে যথেষ্ট বলে মনে করে, কোনো প্রয়োজনবোধ কিংবা অভাব অনুভব করে না, বরং প্রাচুর্যের ও শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকায় সে থাকে গর্বিত ও তৃপ্তমন্য। জাতি হিসেবে এরা ছিল গড়ার মুখে এবং তাদের সভ্যতা ছিল কেবল বিকাশোনুখ। এমন মানুষ হয় কৌতূহলী, জিজ্ঞাসু ও গ্রহণে আগ্রহী। তাই এই নবাগতরা এদেশের ধর্ম-সংস্কৃতির উপাদান উপকরণে নিজেদের গড়ে তুলতে ছিল উৎসুক। ব্যবহারিক আচরণে কিংবা মানস-অভিব্যক্তিতে দেয়া-নেয়ার ভিত্তিতে অভিন্ন হয়ে বাস করতে চেয়েছে তারা। অথবা পরিবেষ্টনীর প্রভাবে তা-ই করতে হয়েছে তাদের।
একদা যারা ছিল প্যাগান ও বৌদ্ধ, সেই শক-হুঁন-উইচি-মোঙ্গলের জ্ঞাতি-গোষ্ঠী-প্রতিবেশী তুর্কী আফগান-মুঘলেরা এল এবার নতুন বৃত ধর্ম, নতুন ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে। এরা একসময়ে ছিল কিরাত, এখন ক্ষত্রিয়। দুটোই বাহুবল সাপেক্ষ। জিগীষাই ছিল তাদের প্রাণের প্রেরণা। বাহুবল আর ধনবল যার আছে, তার মর্যাদাবোধও থাকে। অহঙ্কার, গর্ব কিংবা আত্মসম্মানবোধ লালন ও অভিব্যক্তি পায় স্বাতন্ত্রে। তাই এদের স্বাতন্ত্র্য-চেতনা ছিল তীক্ষ্ণ, স্বধর্ম ও সংস্কৃতিপ্রীতি ছিল তীব্র। তাছাড়া স্বধর্মের শ্রেষ্ঠত্ববোধ, লোকান্তরে প্রসারিত জীবনের সুনির্দিষ্টতা, জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে প্রত্যয়-দৃঢ় ধারণা, ব্যবহারিক জীবনে তার প্রয়োগ-সাফল্য প্রভৃতি তাদেরকে স্বাতন্ত্র্যরক্ষায়ও দেয় প্রবর্তনা। আবার দেশীলোকেরাও ইসলাম বরণ করে শাসকদের ভ তত্বলোভে ও স্বধর্মের স্বাতন্ত্র চেতনায় পূর্বপুরুষের দেশী ঐতিহ্য ও আচার পরিহারে হল উৎসাহী। এসব কারণে আগের মতো এবার শাসক শাসিত অভিন্ন হয়ে উঠল না।
কাজেই হিন্দুর মনে পরাধীনতার গ্লানি ছিলই। আর শাসকের স্বাতন্ত্র্যচেতনা ও উত্তম্মন্যতা সে গ্লানি স্থায়ী ক্ষতে পরিণত করে। ফলে বেদনা, ক্ষোভ ও গ্লানি শাসিত-মনকে অসুস্থ করে রাখে। আর সাতশ বছরের মধ্যে এমন কোনো আবহ তৈরি হয়নি যাতে সুস্থ মনের প্রবর্তনায় সুস্থ হয়ে পরিবেশ ও পরিস্থিতি সম্পর্কে নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ সম্ভব হত। অবশ্য চেষ্টা হয়েছে অনেক। এ সূত্রে রামানন্দ, কবির, নানক, দাদু প্রভৃতি সন্তদের প্রয়াস স্মর্তব্য। তবে এতেও কেবল বিচ্ছেদ ও ব্যবধানের প্রাচীরই উঠেছে। এসব মিলন-প্রয়াস বিচ্ছেদের বেদনায় হয়েছে ম্লান, বিভেদের ও স্বাতন্ত্রের অহমিকায় হয়েছে তিক্ত।
এ ব্যর্থতার কারণ আছে। এতকাল মানুষ সে-কারণ জেনে-বুঝেও এড়িয়ে গেছে, উচ্চারণ করতে চায়নি। মনের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানোর বিড়ম্বনাকেই সে শ্রেয় মনে করেছে। কেননা এ কারণ অপসারণের সাহস ও শক্তি ছিল না তার। তাই বৃথা জেনেও সে মিথ্যা উপায়ে প্রেম-প্রীতি প্রতিষ্ঠায় হয়েছে প্রয়াসী। অপ্রেম দূর করার ছলনায় সে আত্মপ্রতারণাই করেছে চিরকাল। সত্যকে দেখেও সে চোখ বুজে ছিল, তাই ফুটো পাত্রে পানি ঢালার বিড়ম্বনাই পেয়েছে সে। সে-যুগে সে ছিল নিরুপায়। কেননা বিশ্বাসের অঙ্গীকারেই ধর্মের উদ্ভব ও স্থিতি। ধর্ম মানুষের আচার-আচরণ, বিশ্বাস-সংস্কার ও আদর্শের বন্ধনে মানুষের দেহ-মন-আত্মাও নিয়ন্ত্রিত করে। এতে নিয়ম-নীতির ডিকদড়িবদ্ধ মানুষের বিচরণক্ষেত্রের পরিসর হয় সীমিত। ধর্মীয় বিধিনিষেধের বাইরে কিছু করা অঙ্গীকারবদ্ধ মানুষের পক্ষে পাপ। ধর্মবোধ ও ধর্মাচারের ক্ষেত্রে যুক্তি-বুদ্ধির প্রশ্রয় মারাত্মক বলেই সে জানে। কাজেই চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতা সেখানে কার্যত অস্বীকৃত। বিধর্ম ও বিধর্মীর ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলাই হচ্ছে সাধারণের পক্ষে নির্দ্বন্দ্ব ও নির্বিঘ্ন জীবনযাত্রার উত্তম নীতি। এই ঋজুবোধের রাজপথ ত্যাগ করা জ্ঞানী-গুণীর পক্ষেও সম্ভব ছিল না। অন্তরের দিকে এইরূপ বাধা ছিল বলেই বাইরে ব্যবহারিক জীবনেও প্রীতির বন্ধন স্বীকার করা সম্ভব হয়নি। হাটে-ঘাটে-মাঠে তারা মিলিত হয়েছে বৈষয়িক কাজে, কিন্তু মনে মেলেনি। তাদের চাঁদ-সূর্য-আকাশ ছিল একক, তাদের নদী নৌকা-হাট-বাট ছিল অভিন্ন, ফসল-পণ্যও তারা দেয়া নেয়া করেছে, কেবল মন ও মত রেখেছিল ভিন্ন। রুদ্ধ রেখেছিল তারা হৃদয়ের প্রীতিপ্রবাহ। এজন্যেই পৃথিবীর সর্বত্রই বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মিলন-প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে চিরকাল।