.
০২.
Rationalist-দের কেউ কেউ পড়াশোনা ও দেখার মাধ্যমে য়ুরোপীয় চিত্তের–প্রতীচ্য মনীষার ও জীবন-ভাবনার স্বরূপটি জেনেবুঝে নিয়েছেন। তাদের চেতনায় জগৎ-ভাবনা উদ্দীপ্ত আর মানবিক আকাক্ষার ও জীবন-সমস্যার আঞ্চলিক পার্থক্য অবলুপ্ত। এঁরা শান্তিকামী, স্বস্তিপ্রয়াসী ও বিশ্বমানবতায় বিশ্বাসী। বর্ণ, ধর্ম ও রাষ্ট্রিক স্বাতন্ত্রের স্বীকৃতিতে এঁরা সম অধিকার ও সম। সুযোগের ভিত্তিতে সহ-অবস্থান নীতিতে আস্থাবান। এ হল দক্ষিণপন্থীদের কথা। এঁদের মধ্যে যারা বামপন্থী তাঁরা নিজেদের পরিকল্পনামতো বিশ্ব-সংসারকে ঢালাই করতে চান। মানুষের বর্ণ, ধর্ম, মনন ও প্রয়োজনের পার্থক্য স্বীকৃতি পায় না তাঁদের কাছে।
এ দুই পন্থের অন্যান্যরা কিছু জেনে এবং কিছু শুনে প্রাগ্রসর প্রগতিবাদী আধুনিক মানুষ বলে আত্মপরিচয় দেন। কতগুলো বুলি কপচিয়ে তাঁরা সমাজ, রাষ্ট্র ও মানবসমস্যা সচেতনতার আভাস দিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। এরাই যন্ত্রযুগের যন্ত্রণার কথা, অবক্ষয়ের কথা, সমাজের বিবর্তনধারার কথা বলে শ্রোতার মনে চমক লাগিয়ে দেন।
মানুষের জীবনপ্রবাহে যে অবক্ষয় নেই, যান্ত্রিকতা যে যন্ত্রণার নয়, সমাজ বিবর্তন যে মানুষেরই অগ্রগতির ফল–এসব কথা তাদের বোঝানো যায় না। মানুষের অগ্রগতির তথা চলমানতার লক্ষণই এই যে, তার জীবনবোধ হবে বিচিত্রতর, সূক্ষ্মতর ও তীব্রতর। আর এর ফলে বাড়বে প্রয়োজনবোধ, দেখা দেবে অভাব, উদ্ভব হবে সমস্যার, খুঁজবে সমাধান। ফলে উপায় হবে বিচিত্র, উদ্দেশ্য হবে বিভিন্ন, মত হবে বিবিধ, পথ হবে বহুধা আর ঋজু থাকবে না জীবনচর্যা, সহজ হবে না বেঁচে থাকা। স্বাতন্ত্রে কিংবা আত্মনির্ভরশীল হয়ে চলা হবে অসম্ভব। পৃথিবীর মানুষ কেবল পারস্পরিক সহযোগিতায় বাঁচবে। মানুষ ফেরেস্তা নয়, অতএব জীবনযাত্রা হবে জটিল ও দুঃসাধ্য। দেখা দেবে দ্বন্দ্ব, লাগবে লড়াই, বাধবে সংঘর্ষ, এড়ানো যাবে না সংঘাত। তা হবে ব্যক্তিক, পারিবারিক, দৈশিক ও রাষ্ট্রিক। অতএব দোষ যন্ত্রের নয়, কারণও অবক্ষয় নয়, সমাজ কাঠামোও দায়ী নয় এর জন্যে। মানুষের লোভ ও কল্যাণবুদ্ধির অভাবই এর জন্যে দায়ী। তাই জীবন সংগ্রামের শেষ নেই। মানুষ যতই এগুবে, যতই দিন যাবে, সংগ্রামও হবে বিচিত্রতর, কঠিনতর আর জটিলতর। সে সংগ্রাম করবে প্রবৃত্তির ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে, অভাবের ও অকল্যাণের বিরুদ্ধে, রোগ ও মৃত্যুর বিরুদ্ধে।
আর দেশ ও ধর্মের প্রতি অনুরাগ স্বাভাবিক মানুষের আজন্মের সংস্কার। স্বদেশ প্রেমিক ও সুনাগরিক মাত্রই স্বভাবত নিজের রাষ্ট্রের স্বার্থসচেতন। রাষ্ট্রের প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সে নিজের স্বার্থেই বিস্মৃত হতে পারে না, পারে না অবহেলা করতে। আর কোনো আস্তিক মানুষই তার ধর্মীয় চর্যায় আকর্ষণ হারায় না। কাজেই এ ব্যাপারে কারো উদ্বিগ্ন-উৎকণ্ঠ হওয়ার কারণ দেখিনে।
আমাদের দুর্দিন বলছি এজন্যে যে আমাদের একদল এগুতে চান না, তাঁরা সংগ্রাম-বিমুখ। স্থিতির মধ্যেই তাঁরা স্বস্তি খোঁজেন, পূর্বপুরুষের রিকথ সম্বল করে নিশ্চিন্ত হতে চান। তাঁরা আকাভ ক্ষাহীন, অনিশ্চয়তায় পা বাড়াতে অনিচ্ছুক তারা। আত্মরক্ষণই তাঁদের কাম্য, আত্মপ্রসারে আগ্রহ নেই।
আর এক দলের সাধ আকাশ-ছোঁয়া। কিন্তু সাধ্য সামান্য। তাদের আকাঙ্ক্ষা প্রবল কিন্তু যোগ্যতা অর্জনে আগ্রহ ক্ষীণ, সাধনায় উৎসাহ দুর্লক্ষ্য। তাই সৃষ্টিশীল তো নয়ই, গ্রাহিকাশক্তিও তাঁদের সুষ্ঠু নয়। তাই আজো আমরা অনুকারক মাত্র। মনের দিক দিয়ে সুস্থ ও স্বস্থ কেউই নন। একদলের দৃষ্টি দূর অতীতের আরব-ইরান পানে। আর এক দল তাকিয়ে আছেন সুদূর পিকিং, মস্কো কিংবা লন্ডন-প্যারিস-নিউইয়র্কের দিকে। এসব কারণে আমাদের অগ্রগতি আশানুরূপ হয়নি।
দেশ, জাত ও ধর্ম
মানুষের জীবনের প্রয়োজনেই ধর্মমতের সৃষ্টি। ধর্মের যূপকাষ্ঠে আত্মবলিদানের জন্যে জীবন নয়। কাজেই জীবনই মুখ্য। আর সব গৌণ। জীবন গড়ে ওঠে দেশে ও কালে। মানুষের জীবন স্বাতন্ত্রে উপভোগ সম্ভব নয়, তাই পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক সংস্থা ও দেশকাল ভিত্তিক জাতীয়তা তার প্রয়োজন। মানুষের পক্ষে এ এমনি স্বাভাবিক যে এ নিয়ে বিচার-বিতর্কের অবকাশই নেই।
মুসলমানেরা যে-ধর্ম মানে তা আরবোদ্ভূত। সেখানকার লোক ইসলাম মানে, কিন্তু দেশের অমুসলিম ও মুসলিম কোনো ঐতিহ্যকেই অবহেলা করে না। ইরানেও ধর্মমত দৈশিক ঐতিহ্যবোধের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়নি। তুরস্ক-ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রেও দেখি লোকের ধর্মমতে ও ঐতিহ্যবোধে কোনো বিরোধ নেই। আমাদের দেশেই কেবল শাসন-শোষণের প্রয়োজনে কৃত্রিমতত্ত্বের অবতারণা করে দেশ, জাত ও ধর্মের দ্বান্দ্বিক ধারণা দানের অপচেষ্টা হচ্ছে।
আমরা একাধারে বাঙালি ও মুসলমান। আমাদের ধর্মীয় জীবন যেমন আছে, তেমনি রয়েছে ব্যবহারিক জীবন। আমরা নামাজ পড়ব, মসজিদ গড়ব, আল্লাহকে ডাকব, যথাবিধি ধর্মীয় আচরণে নিষ্ঠ থাকব। আবার আমাদের ব্যবহারিক প্রয়োজনে আমরা বিদেশী পণ্য নেব, বিজাতির জ্ঞান নেব, যা-কিছু ভালো লাগে তা-ই বরণ করব, পরের বলে বর্জন করব না। জীবনকে উপভোগের ও কল্যাণের অনুগত করব। সুন্দরের ও কল্যাণের প্রসাদকে বিদেশী ও বিজাতির বলে এড়িয়ে চলব না–বঞ্চিত করব না নিজেদের।