আরো মারাত্মক ব্যাপার এই যে, তারা মুসলিম সংস্কৃতির কথা বলেন না–বলেন ইসলামী সংস্কৃতির কথা। এবং ইসলামী সংস্কৃতি নামটা তাঁদের যথেচ্ছ প্রয়োগে হাস্যকর হয়ে উঠেছে। নাচ-গান-নাটক-চিত্রকলা প্রভৃতি ইসলামে অবিধেয় বিষয়গুলোও তারা ইসলামী সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। যেমন বুলবুল চৌধুরীর নাচ, নজরুলের গান, মুসলিম চরিত্র নিয়ে রচিত নাটক, আবদুর রহমান চুঘতাইর চিত্র প্রভৃতি এবং যা-কিছু মুঘলাই ও ইরানি–তাঁদের কাছে ইসলামী। এভাবে যা-কিছু মুসলমান করে তা-ই ইসলামী হয়ে উঠেছে; যেমন ইসলামিয়া হোটেল, ইসলামিয়া কলেজ, ইসলামিয়া লাইব্রেরী, ইসলামিয়া ব্যাঙ্ক, ইসলামিয়া ইস্যুর্যান্স প্রভৃতি।
আমাদের না হোক, আরব-ইরানির কিংবা মুঘলের একটা সৃষ্টিশীল ও গ্রহণশীল মুসলিম সংস্কৃতি ছিল। য়ুরেশিয়ার সর্বত্র তা যথাকালে অনুকৃতও হয়েছিল। কিন্তু সে তো দূর অতীতের ইতিহাস। আজকের দিনে তার Revival-এর চিন্তা দিবাস্বপ্ন মাত্র। এরূপ চিন্তা দুর্বলতার ও অসামর্থ্যের সাক্ষ্য। এ সংস্কৃতির গৌরব-গর্বে নিষ্ক্রিয় থাকাও বিকৃত বুদ্ধির পরিচায়ক। গৌড় সুলতানের যে-বংশধর আজ অজপাড়াগাঁয়ের অশিক্ষিত দিনমজুর, সে যদি তার খান্দানের গর্ব করে, যথার্থ হওয়া সত্ত্বেও তা মূল্যহীন ও অশ্রদ্ধেয়। কেননা ঐ পরিচয়ের যোগ্যতা হারিয়েছে সে। আমাদেরও যখন আজ বিশ্বকে দেবার মতো কিছুই নেই, আমাদের যখন আজ কেবল গ্রহণ করা ও গড়ে তোলার পালা চলছে, তখন পূর্বপুরুষের মহান সংস্কৃতির কথা বলে নিজেদের হাস্যাস্পদ করা অসমীচীন। কথায় বলে : স্বনামা পুরুষ ধন্য পিতৃনামা চ মধ্যমা। আমরা স্বনামে ধন্য নই, পিতৃনামেও নই পরিচিত। বিশ্বের বিভিন্ন জাতি যখন জ্ঞানে, কর্মে ও চিন্তায় বিস্ময়করভাবে নিজেদের বিকাশ সাধন করছে, তখন আমরা পূর্বপুরুষেরও নয়–ধর্মীয় ঐক্যের সুবাদে আরব ইরানির অতীত কৃতির আস্ফালনে নিজেদের নিঃস্বতা, নিজেদের অযোগ্যতার লজ্জা ঢাকা দেবার প্রয়াসী। আত্মধ্বংসী এ আত্মপ্রবঞ্চনা কোনো শ্রেয়সের সন্ধান দেবে আমাদের?
তাই সংস্কৃতির নামে এঁদের রক্ষণশীলতা, গ্রহণবিমুখতা, অসহিষ্ণুতা আর প্রতিক্রিয়াশীলতা আমাদের অগ্রগতি ব্যাহত করছে মাত্র। আমাদের প্রগতি ঠেকিয়ে রাখার সামর্থ্য এঁদের ছিল না, কিন্তু ইসলামের নামে জনপ্রিয়তাকামী সরকারের সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েই এঁরা প্রবল। এভাবে সরকারি প্রশ্রয়ে ও উৎসাহে সংস্কৃতির ও মননের ক্ষেত্রে জনগণের স্বাভাবিক আত্মবিকাশের পথ করেছেন তারা বন্ধুর এবং দেশের rational বুদ্ধিজীবীদের স্বাধীন আত্মপ্রকাশের সুযোগ করেছেন হরণ।
যে-দল Rationalist, তাঁরা জ্ঞান, কর্ম ও চিন্তার বিস্ময়কর য়ুরোপীয় বিকাশে মুগ্ধ। এতে তারা পেয়েছেন মানব-মহিমার সন্ধান। জীবন-সম্ভাবনার অনন্ত বিস্তার দর্শনে তাঁদের চিত্তলোক আন্দোলিত। জগৎ-রহস্যের নিঃসীম গগনে পাখা মেলতে চায় তাদের মনোবিহঙ্গ। তারা দেহ-মন আত্মার অবগাহন কামনা করেন এই নব-উপলব্ধ চেতনা-সমুদ্রে। চিত্তের এ চেতনালোকে ভূগোল নেই, ধর্ম নেই, জাত নেই; আছে কেবল মানুষ আর আছে মানবিকতা ও মানবতার বিচিত্র বিকাশের আভাস ও আশ্বাস। অখণ্ডের সন্ধান যে পেয়েছে, খণ্ডে তার মন ভরে না। সমুদ্র-পর্বত যে দেখেছে, নদী আর টিলা তার অবহেলা পাবেই! Rationalist-রাও তাই জীবনকে রাষ্ট্রিক ও ধর্মীয় গণ্ডীর মধ্যে প্রত্যক্ষ করে না, দেখতে চায় নিখিল জগতের পটে। বিচিত্র ও বর্ণালি, বিমূর্ত ও বিমুক্ত অনুভবের সূক্ষ্ম শিকড় চালিয়ে দিয়ে জগৎ-রহস্য ও জীবন-ভাবনার স্বরূপ-চেতনার গভীরে উপলব্ধি করার প্রবণতা এ-যুগে অত্যন্ত প্রবল। সূর্য আজ প্রতীচ্য গগনে। তার আলো ও আলোর প্রসাদ পেয়ে জগদ্বাসী আজ ধন্য ও কৃতার্থ। পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার, সেথা হতে সবে আনে উপহার। যে আনে না–আনতে জানে না, সে হতভাগ্য। মানস-ঐশ্বর্যের দ্বার অবারিত দেখেও যে অবহেলা করে সে কৃপার পাত্র। সমুদ্র সামনে পেয়েও যে তাকিয়ে দেখে না, সে হৃদয়হীন।
প্রতীচ্যের জ্ঞানে-বিজ্ঞানে ও জীবন-চেতনায় মুগ্ধ আমাদের Rationalist-রা তাই চরম তাচ্ছিল্যে শুচিবাইগ্রস্ত রক্ষণশীলদের বলতে চান : যে-সংস্কৃতি জীবনের প্রয়োজন মিটায় না, আত্মরক্ষার অস্ত্র যোগায় না, রোগের প্রতিষেধক জানে না, সিনেমা-রেডিয়ো-টেলিভিশন-টেলিফোন টেলিগ্রাফ কিংবা জাহাজ-বিমান দিতে পারেনি, যে-সংস্কৃতি বিজ্ঞানে-দর্শনে-সমাজতত্ত্বে-রাষ্ট্রতত্ত্বে, অর্থনীতি কিংবা বাণিজ্য বিজ্ঞানে কোনো নতুন চিন্তায় সমর্থ নয়; অন্য কথায় যে-সংস্কৃতি আধুনিক জীবন-ভাবনার সহায়ক নয়, জীবনের মানস-সমস্যার সমাধান দেয় না, মনের খোরাক যোগায় না, ব্যবহারিক জীবনের কোনো অভাব মিটানোর যোগ্যতা যাতে অনুপস্থিত; যে-সংস্কৃতি কেবল নরকের ভয় ও স্বর্গের লোভ দেখিয়ে মানুষের জীবন ও জীবিকা নিয়ন্ত্রণে তৎপর; ভাব, চিন্তা, জ্ঞান ও কর্মের উদ্যোগে ও প্রসারে রক্তচক্ষু কিংবা কাতর; যে-সংস্কৃতি সৃষ্টির প্রেরণা যোগায় না, যে সংস্কৃতি কল্যাণকে গ্রহণেও উৎসাহিত করে না, যে-সংস্কৃতি কেবল ধরে রাখে, কেবলই পিছুটান দেয়, অথচ যা দিয়ে মনও ভরে না, প্রয়োজনও মেটে না, এগিয়ে যাবার দিশাও দেয় না, বেঁচে থাকার উপায়ও বাতলায় না–সে-সংস্কৃতি দিয়ে আমরা কী করব?