বিশ বছর ধরে ক্রমবর্ধমান অসাফল্যের মুখ্য কারণ হচ্ছে, তাঁদের অভিপ্রায় প্রচ্ছন্ন করে তারা কেবলই ধর্মীয় ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের গর্ব আর জাতীয় স্বাতন্ত্রের গুরুত্ব উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন। অথচ দেহ-মনে তারা বরণ করেছেন য়ুরোপকে। কথায়-কাজে এ অনৈক্য, বুকে-মুখে এ বিরোধ অন্যের অশ্রদ্ধা জাগায়। অবচেতন ভাবেই শ্রোতার মন হয়ে ওঠে বিরূপ। তারা যদি সোজাসুজি বলতেন এড়িয়ে চলো হিন্দুর সাহচর্য, পরিহার কর হিন্দুয়ানী প্রীতি, বর্জন কর হিন্দুর সাদৃশ্যজ্ঞাপক সবকিছু, তা হলে হয়তো রাষ্ট্রিক অসদ্ভাবের সুযোগে সমর্থন পেতেন অনেক। কিন্তু তা তাঁরা বলেননি–বলেন না। হেঁয়ালি ছাড়তে চান না তাঁরা।
এর ফলে বেড়ে যায় সাধারণের তাচ্ছিল্য আর বিরুদ্ধবাদীদের উত্তেজনা। বিরুদ্ধবাদীরা তখন যুক্তির আশ্রয় নেন। তাদের যুক্তি কতকটা এরূপ–যুগের সঙ্গে তাল রেখে চলার অন্য নাম সংস্কৃতি। সংস্কৃতি কখনো পুরোনো হতে পারে না, তা হবে নিত্য নতুন। প্রতিদিনকার সূর্যের মতোই নতুন। বহতা নদীর স্রোতের মতোই নতুন। কেননা সংস্কৃতি পুরোনো হলে তা আর সংস্কৃতি থাকে না, হয় আচার। তখনকার ইসলামী সংস্কৃতির তথা এখনকার ইসলামী আচারের অনেক ভালো রীতি-পদ্ধতিই যুডাইজম থেকে নেয়া, যার নাম সুন্নত-ই-ইব্রাহীম। অতএব ইসলামী সংস্কৃতিও অবিমিশ্র ছিল না। সংস্কৃতি চালু থাকে সৃজনশীলতায় ও গ্রহণশীলতায়। যারা সৃষ্টি করতে পারে না, অন্যের সৃষ্টি বরণ করেই তারা হয় সংস্কৃতিবান। যারা সৃষ্টিও করতে পারে না, গ্রহণও করতে চায়, তারা আদিম স্তর পার হতে পারেনি, যেমন আফ্রো-এশিয়ার পার্বত্য ও আরণ্যক গোত্রগুলো। অতএব সংস্কৃতি কখনো অবিমিশ্র হয় না হতে পারে না। আমরা বাঙালিরা সৃজন করে নয়– গ্রহণ করেই হয়েছি সংস্কৃতিবান। আমাদের ধর্ম আরবের ও উত্তর-ভারতের। আমাদের ভাষা উত্তরভারতের বা আরো দূরের। আমাদের প্রশাসনিক সংস্কৃতি মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন, তুর্কী, মুঘল ও ইংরেজ থেকে পাওয়া। আমাদের সমাজ সংস্থা এই ধর্ম আর প্রশাসনিক আদর্শভিত্তিক। আমরা নিজেরা হলাম অস্টো-মঙ্গোল-নিগ্রো-আর্য-সামীয়ের বর্ণসঙ্কর বা রক্ত-সঙ্কর জাতি। অতএব, পাঁচ রকমের মানুষ নিয়ে গড়ে উঠেছে আমাদের জাতি। পাঁচমিশেললি হয়েছে আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। তাহলে কোনো অর্থে আমরা সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের কথা বলি? আমরা গ্রহণ করি, আর নিজের মতো করে নিই, যার নাম স্বাঙ্গীকরণ। এই হচ্ছে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের রূপ আর জাতীয় স্বরূপ। আমাদের পূর্বপুরুষ বিদেশী বিজাতি আরবের ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বলে কী আমরা লজ্জায় মরি, না স্বস্তিবোধ করি!
গ্রহণে-বরণেই যদি আমরা আজ অবধি টিকে থাকি, তাহলে আজকে হঠাৎ জাত গেল, ধর্ম গেল, ঐতিহ্য গেল, গেল ভাষা, গেল সাহিত্য, গেল সংস্কৃতি, বলে আর্তচিৎকারের বা আর্তনাদের কী কারণ ঘটল? বিশেষ করে আমরা যখন জানি যে সংস্কৃতির কোনো স্থায়ী রূপ বা স্বাতন্ত্র থাকতেই পারে না। এমনকি জীবন-চেতনা, নীতিবুদ্ধি, ধর্মবোধ, ঐতিহ্যের মূল্য, ভাষার রূপ বা সাহিত্যের আঙ্গিক ও বক্তব্যই কী অবিচল অবিকৃত থাকে? এক কোরআন কেন্দ্র করেই হাদিস অবলম্বন করেই কী আমাদের বাহাত্তর ফেরকা হয়নি? জীবনে কী প্রয়োজন-বুদ্ধি ও উপযোগ-চেতনা বদলাচ্ছে না? জীবনযাত্রী কী চলার পথে এগোয় না? মানুষের মন-বুদ্ধি-আত্মার কী বিকাশ নেই? সমাজ কী স্থাবর? তার কী কেবল অতীতই আছে, ভবিষ্যৎ নেই? তার কী কেবল অতীতের মোহ থাকাই বাঞ্ছনীয়, ভবিষ্যতের আকর্ষণ থাকা কাম্য নয়? নিজেকে নতুন করে রচনা করা কী অপরাধ না অমানবিক?
যাঁরা সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের প্রবক্তা, তারাই আবার য়ুরোপীয় গণতন্ত্রের ভক্ত, গণতন্ত্রী সংবিধানের দাবীদার, রোমান-আইনের অনুরাগী, বিজ্ঞান ও প্রকৌশলবিদ্যায় উৎসুক, রেডক্রসের মহিমায় মুগ্ধ, য়ুরোপীয় বৈজ্ঞানিক আবিস্ক্রিয়ার প্রসাদ গ্রহণে উন্মুখ। য়ুরোপীয় মনীষার ফসল ইতিহাস, দর্শন, অর্থনীতি, বাণিজ্যবিদ্যা, প্রাচ্য-শাস্ত্র বিশ্লেষণ বিদ্যা, বিভিন্ন বিজ্ঞান, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা আর সাহিত্যশাস্ত্র শিক্ষায় এবং অনুকরণেও তারা লজ্জাবোধ করেন না, কিংবা সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের কথা ভাবেন না। য়ুরোপীয় আদলে প্রশাসনিক সংস্থা গড়ে তুলতে, স্কুল-কলেজ রাখতে, সৈন্যবাহিনী বিন্যাস করতে, কিংবা কলকারখানা স্থাপনে, পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধানে, গৃহনির্মাণে ও আসবাবপত্র ব্যবহারে তাঁদের আত্মসম্মানে বাধে না। এঁরা গরুর গাড়ি-ঘোড়ার গাড়ি ছেড়ে মোটরে বিমানে-জাহাজে চড়তে, কিংবা হেকিম বাদ দিয়ে ডাক্তার ডাকতে, রেড়ির তেল ছেড়ে কেরোসিনের ব্যবহারে কিংবা বৈদ্যুতিক শক্তির প্রয়োগে আত্মধিক্কারে মাথা নত করেন না।
আজ আমাদের চুল কাটার ধরন থেকে জুতোর অবয়ব অবধি সবকিছুই য়ুরোপীয়। এভাবে অন্তরে-বাইরে মনে ও মেজাজে য়ুরোপীয় মানুষেরই প্রতিকৃতি আমরা। এমনকি য়ুরোপীয় জীবন চিন্তার প্রভাবে কোরআনের কানুন–আল্লাহর নির্দেশ সংশোধনেও তারা দ্বিধান্বিত নন জন্মনিয়ন্ত্রণ, উত্তরাধিকার বিধানের সংশোধন ও পত্নীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি স্মর্তব্য। তাহলে তাঁদের সংস্কৃতিটা কী বস্তু আর তার স্থিতি কোথায়, বোঝা ভার। তাঁরা পেন্টালুন ও পেন্টালুনের আদলে তৈরি পাজামা পরেন, আসকান-পাঞ্জাবির নিচে গেঞ্জি রাখেন, বুফে খান এবং পাওরুটি ও সুপে আসক্ত; তবু সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের বড়াই করেন।