মুসলিম সমাজে ব্যক্তিক জীবনের ও জীবিকার নিরাপত্তাব্যবস্থা সুনিশ্চিত হয়েছে রসুলের নির্দেশে এক মুসলমানের ধনপ্রাণ অপর মুসলমানের পক্ষে পবিত্র। এবং মুসলমানরা পরস্পর ভাই ও বন্ধু। স্ত্রীর প্রতি সদ্ব্যবহার করো আর দাসের প্রতি সদয় হও এবং নিজের মতো করে তার খোর-পোষ দাও। তাই মুসলমান বিধর্মী শাসনের আশঙ্কায় বিচলিত হত। কেননা সে জানত এর ফলে তার নিশ্চিন্ত নির্বিঘ্ন জীবনে নিশ্চিতই বিপর্যয় আসবে! কাজেই যে-ইসলাম একান্তভাবে সমাজ-কাঠামো ভিত্তিক, তা এভাবে লোপ পেতে পারে। এই সমাজ-গুরুত্ব ও কর্তৃত্ব রক্ষার জন্যেই মুসলমানের পক্ষে মুসলিম শাসক আবশ্যিক। তাই জেহাদ মাত্রই আত্মরক্ষা বা প্রতিরোধমূলক (Defensive & Resistive)। জেহাদ আক্রমণাত্মক (Offensive or Aggressive) হতেই পারে না। এ অর্থেই জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের হয়ে সংগ্রামই শ্রেষ্ঠ জেহাদ।
জেহাদ মুসলমানের সামাজিক কর্তব্য ও ব্যক্তিগত দায়িত্ব। জেহাদের জন্য প্রস্তুত থাকা মুজাহিদের ভাব জিইয়ে রাখা মুসলমানের ঈমানের অঙ্গ। এ অর্থে মুমিন মাত্রই মুজাহিদ। যে জেহাদ করে সেই মুজাহিদ, বেঁচে থাকলে হয় গাজী আর মরলে হয় শহীদ। Ism আবর্তিত আজকের দুনিয়ায় আদর্শবাদী তথা মতবাদ-ধারী মানুষ মাত্রই মুজাহিদ। কেননা আদর্শের জন্যে ও ন্যায়ের পক্ষে যে-কোনো প্রকারের সংগ্রামের নামই জেহাদ। তবু জেহাদ শব্দটি ঘৃণ্য হয়ে আছে। এর মূল্য-মাহাত্ম্য এ-যুগে মনে হয় মুসলমানদের কাছেও নেই। অবশ্য এজন্যে মুসলমানেরা নিজেরাই দায়ী। কেননা মুসলিম শাসনেও ইসলামী বিধান অনুসৃত হয়েছে কৃচিৎ আর রাজ্য-লোলুপ মুসলমান বাদশা-সুলতানেরা আত্মস্বার্থে আক্রমণাত্মক কাজে অর্থাৎ চড়াও হয়ে অপরের উপর হামলা ও জুলুম চালাবার জন্যেও অজ্ঞ-জনসাধারণকে জেহাদের ভাঁওতা দিয়ে উত্তেজিত করেছেন ও অনেক অনর্থ ঘটিয়েছেন। তাই জেহাদের নামে এমন ত্রাস ও অবজ্ঞা। যা অভিনন্দিত ও মহিমান্বিত মহৎ ব্রত হতে পারত, তা-ই হল অবাঞ্ছিত ও ঘৃণিত। তবু সমাজ-স্বার্থে নিত্য জেহাদ চাই। মুজাহিদ ছাড়া কে মানুষকে প্রাত্যহিক শাসন-শোসন-পীড়ন-পেষণ থেকে মুক্ত করবে, মুক্ত রাখবে।
দুর্দিন
০১.
আযাদী লাভের পর বিশ বছর কেটে গেল। কিন্তু আমাদের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঘুচল না ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিক্ষেত্রে। আজো চলছে দলাদলি ও কোন্দল। অবশ্য মতাদর্শের বিতর্ক ও সংগ্রাম মন্দ কিছু নয়, অভিনব তো নয়ই। কিন্তু একই সমস্যা নিয়ে বিশ বছর ধরে মাথা ঘামানো, আর তার সমাধান খুঁজে না-পাওয়া এ-যুগের পক্ষে অদ্ভুত, অযৌক্তিক ও অকল্যাণকর।
দল মোটামুটি দুটোই। একদল ধর্মীয় জাতীয়তায়, ঐতিহ্যে ও সংস্কৃতিতে আস্থাবান। অন্যদল দেশীয় ও ইউরোপীয় ভাব-চিন্তার অনুগত। প্রথম দল Nationalist, দ্বিতীয় দল Rationalist। আদর্শ হিসেবে কোনোটাই নিন্দার নয়। প্রথম দল ধর্মভাবে নয়–ধর্মীয় পরিচয়ে স্বাতন্ত্রকামী। তাঁদের আত্মপ্রীতি ও মর্যাদাবোধ তীক্ষ্ণ ও তীব্র। তাঁরা ঋণের কিংবা অপরের অনুসৃতির লজ্জা থেকে জাতিকে বাঁচাতে চান। তাঁদের যুক্তিতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একাকার। কেননা ইসলাম হচ্ছে সর্বকালীন সর্বমানবিক সমস্যার সমাধান আর মানব-কাম্য কল্যাণের দিশারী। কাজেই ইসলামের অনুগত হও, কোরান-হাদিস অনুসরণ কর আর সুখে নিদ্রা যাও।
মুশকিল হল এই তাঁরা মুখে বলছেন বটে, কিন্তু অন্তরে তাঁদের দ্বিধা ঘোচেনি, আর তাই হয়তো আচরণে তাদের কোনো সঙ্গতি দেখা যায় না। কেননা য়ুরোপীয় আদলে জীবন রচনায় তাঁরাও প্রয়াসী। য়ুরোপীয় মানস-সংস্কৃতির ফসল গ্রহণে কিংবা ব্যবহারিক জীবনের প্রাত্যহিকতায় য়ুরোপীয় জীবনধারার অনুকরণে তাদের সংকোচ দেখিনে। তা হলে তাদের স্বাতন্ত্র্যবাদ কী নিলক্ষ্য ফাঁকা বুলি মাত্র? তাও নয়। আসলে ব্রিটিশ ভারতে রাজনৈতিক স্বার্থে যে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রচেতনা জাগে, তাকে স্থায়ী ও জোরালো করবার জন্যে স্বতন্ত্র জাতীয়তায় বিশ্বাস ও তার ভিত্তি দৃঢ়মূল করবার প্রয়োজন হয়। আর এ লক্ষ্যে সিদ্ধির অনুষঙ্গ হিসেবে আসে ধর্মীয় ঐতিহ্যের ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের যুক্তি। আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছিল, জয়ী হয়েছিলাম আমরা। কাজেই আমাদের সে প্রয়োজন ফুরিয়েছে, বিশ বছর আগে। ওরা এখন আমাদের পাতের ভাতের ভাগী নয়, প্রতিবেশী মাত্র। তবু আমাদের দেশ ও জাতির হিতকামী অতি-সচেতন একদল বুদ্ধিজীবী অহেতুক শঙ্কা থেকে মুক্ত হতে পারছেন না। একটা অসুস্থ চিন্তা, একটা বিকৃত বুদ্ধি, একটা বিদ্বিষ্ট মন ও একটা অহেতুক শঙ্কা নিয়ে দেশের স্বার্থ ও জাতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্যে অতন্দ্র প্রহরীর ও গণ-অভিভাবকের ভূমিকা গ্রহণ করেছেন তারা।
যা তারা প্রচ্ছন্ন রাখতে চান, খোলাখুলিভাবে তার নাম দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গীয় হিন্দু ও হিন্দুয়ানী ভীতি। এ কারণেই তারা বলছেন– হরফ বদলাও, বানান বদলাও, শব্দ বদলাও, ভাষা বদলাও, ভঙ্গি বদলাও; বদলাও বিষয়বস্তু, বদলাও নাম, বদলাও ভাব, বদলাও চিন্তা। কেবলই বদলাও যাতে বাঙলা ও বাঙালিত্বের নাম-নিশানা ঘুচে যায়, বিলীন হয় সাদৃশ্য, প্রতিষ্ঠা পায় পূর্ণ স্বাতন্ত্র। এর আগে নিশ্চিন্ত হওয়া চলে না। কেননা শত্রুকে ছোট ভাবতে নেই।