খেলা মানেই কৃত্রিম দ্বন্দ্ব ও সংগ্রাম। প্রিয়-পরিজন নিয়েই খেলি আমরা। তাদেরই প্রতিপক্ষ করে সংগ্রাম করি আত্মপ্রতিষ্ঠায়। তাই হার-জিতে উপভোগ করি আনন্দ-বেদনা। খেলা অবসর বিনোদনের উপায়রূপে উদ্ভাবিত। কাজেই এ একান্তভাবে আনন্দের উপকরণ। তেমন উপকরণের স্বরূপ হচ্ছে দ্বন্দ্ব তথা প্রতিপক্ষতা, সহজ কথায় বিরোধ সৃষ্টি। মানুষের অবসর বিনোদনের আর একটি অবলম্বন হচ্ছে সাহিত্য। খেলা ও সাহিত্য একই প্রয়োজনে দু-কোটির সৃষ্টি। রূপকথার দৃষ্টান্ত নেয়া যাক। রাজপুত্তুর যদি অনায়াসে রাজকন্যে লাভ করে, তাহলে হতাশ হই আমরা। যেন রাজকুমারের যোগ্য হল না কাজটা। তাই তার পায়ে পায়ে বাধা, পথে পথে শুক্র। তাকে সাত সমুদ্দরে পাড়ি জমাতে হয়, তেরো নদী পার হতে হয়, আরো অতিক্রম করিতে হয় গিরি-মরু কান্তার। সে-পথে সাপ, বাঘ, দেও, জীন, যক্ষ-রক্ষঃ হয় বৈরী, ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী হয় সহায়। তাই তো কুমারের সাফল্যে আমাদের এত উল্লাস, এত তৃপ্তি। এজন্যেই তো সার্থক ট্র্যাজেডির নায়ক আমাদের এত প্রিয়। দ্বন্দ্ব ও সংঘাতমুখর সাহিত্যের এত কদর।
অতএব, সংগ্রামই জীবন। তাই দুর্বল মানুষ কৃত্রিম সগ্রামেই জীবনের চরিতার্থতা খোঁজে। ভীরুহৃদয়ের ভিখারী পিপাসা পর-পরাক্রমে মিটিয়ে নিয়ে সে লাভ করতে চায় আত্মপ্রসাদ। কাজেই নিশ্চয়তার প্রশ্রয়ে নিশ্চিন্ত আশ্রয়প্রীতি মানুষের স্বভাব নয়– স্বভাবের বিকৃতি।
তাই অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে সংগ্রাম অথবা জীবনযুদ্ধ কথাটি আক্ষরিক অর্থে সত্য নয়। কেননা ব্যঙ্গ্যার্থে জীবনই সংগ্রাম, অন্যকথায় সংগ্রামের মধ্যেই জীবন-রস নিহিত। এজন্যেই জীবন-রস রসিকের সগ্রামী না হয়ে উপায় নেই। আটপৌরে ব্যবহারে কথাটি বাচ্যার্থে তুচ্ছ এবং শব্দটির ব্যঙ্গ্যার্থ প্রায় লোপ পেয়েছে বটে কিন্তু এ কথাটি যতদিন আমরা স্বরূপে ও সদর্থে উপলব্ধি না করব, ততদিন জীবনের সত্যকার প্রসাদ থেকে বঞ্চিত থাকতে হবে আমাদের।
সাধারণভাবে চিন্তা করলেও দেখতে পাব, প্রতিকূল পরিবেশ ও শক্তির সঙ্গে সংগ্রামে জয়ী হয়েই জীবন-পথে এগিয়ে চলি আমরা। মাথায় চুল বাড়ে, হাতে-পায়ে গজায় নখ, মুখে জন্মায় দাড়ি–এসব অস্বস্তিকর প্রতিকূলতা যেমন জয় করি সুকৌশলে ও সুপরিকল্পিতভাবে, তেমনি রোদ বৃষ্টি-শৈত্যেও করে নিতে হয় আত্মরক্ষার সুব্যবস্থা। এসব আজ তুচ্ছ বটে; কিন্তু একদিন এসব প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা ছিল মানুষের বহু চিন্তা-ভাবনা ও চেষ্টার কারণ। এমনি করে প্রতিকূলতার সঙ্গে সগ্রাম করে আজকের স্বস্তি-স্বাচ্ছন্দ্য, যোগ্যতা ও প্রভুত্ব অর্জন করেছে মানুষ।
কাজেই সম্মুখগতি মানেই প্রতিকূল পরিবেশে চলার পথ করে নেয়া। আর এগিয়ে যাওয়া মানেই নতুনকে পাওয়া, বরণ করা, কিংবা জয় করা। তাই নতুন-ভীতি মাত্রই জীবনবিমুখতা। কোনো পুরোনোই পারে না নতুন দিনের পুরো চাহিদা মেটাতে। নতুন যদিবা অশ্চিয়তার মরু হয়, তবে পুরোনো নিশ্চিতই মরীচিৎকার মায়া। তাহলে মরীচিৎকার পিছু ধাওয়া নয়, মরু-উত্তরণের সাধনাই হওয়া উচিত কাম্য। আসলে কোনো নতুন ভাব, চিন্তা বা বস্তু মানুষের অমঙ্গলের জন্যে আসেনি। নতুনই তো চিরকাল এগিয়ে দিয়েছে মানুষের মানস-সংস্কৃতি ও ব্যবহারিক সভ্যতা। অতএব আমরা যে কেবল নতুন ভাব, চিন্তা ও আদর্শ গ্রহণ করব, তা নয়; নতুন দিনে সাহস ভরে মাথা পেতে নেব অনিশ্চিত জীবনের ঝুঁকি। নইলে জীবনের প্রসাদ থেকে, জীবনের উল্লাস-রস থেকে থাকব বঞ্চিত। এই জীবনচেতনা, এই জীবন-রস-রসিকতা, এই জীবন-জিজ্ঞাসা নিয়েই নির্ভয়ে ও নিঃসংশয়ে সাড়া দেব সর্বপ্রকার নতুনের ডাকে। সুস্থ ও স্বস্থ জীবন মাত্রই বহতা নদী।
পুরোনো দিনের অবসানে নতুন সূর্যের উদয়ে কেবল বিকৃতবুদ্ধি ও দুৰ্বলচিত্ত ব্যক্তিই মিয়মাণ হয় হারানোর বেদনায়, পাণ্ডুর হয়ে উঠে মৃত্যুর বিভীষিকায়। তারই পড়ে দীর্ঘশ্বাস; সে-ই কেবল বলে দিন গেল। আর যে প্রাণধর্মের তাগিদে চলে, সে মনে জানে দিন এল। একটার পর একটা দিন আসে, আর সে ভাবে এ বুঝি নতুন জীবনের তোরণে উত্তরণ।
জেহাদের স্বরূপ
কী করে কখন থেকে যে জেহাদ কথাটির অর্থ অমুসলমানের কাছে বিকৃত হয়ে গেছে, তার দিন ক্ষণ নির্ণয় করা সহজ নয়। জেহাদ বলতে তারা বিধর্মী-বিধ্বংসী মুসলিম বর্বরতাই বোঝে। এ বিরূপতা আজকের উন্নতমনা সংস্কৃতবান তরুণ-মনেও কিছুটা জেগেছে, বিজাতি প্রভাবে তারাও মুজাহিদ বলতে আসুরিক উত্তেজনা-সর্বস্ব ধর্মোন্মত্ত খুনীই বোঝে। এ নিশ্চিতই দুর্ভাগ্যের কথা।
কেননা জেহাদ মুসলিম জীবনের অপরিহার্য অংশ। সেজন্যে জীবনের আর আর ব্রতের মতো জেহাদও তাদের সময়োচিত ব্রত। কথাটা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
ইসলাম হচ্ছে প্রথমত এবং প্রধানত মানুষের পার্থিব জীবনের ব্যবহার বিধি। এর মধ্যে কোনো জটিলতা কিংবা অধ্যাত্ম-রহস্য নেই। দ্বৈতবাদই ইসলারে শিক্ষা : স্রষ্টা ও সৃষ্টি কেবল যে আলাদা তা-ই নয়, মানুষ ও আল্লাহর সম্পর্কও হচ্ছে বান্দা-মনিরে। বান্দার কাছে মনিবের নিজের জন্যে কিছুই কাম্য নেই। তিনি চান মানুষের পারস্পরিক ব্যবহার এমন হবে, যাতে কেউ কারো দুঃখ-বেদনা ও ক্ষতির কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি কোনো মর্ত্য-মানবের কোনো নালিশ না থাকে, তাহলে সে নিপাপ। আল্লাহর কাছে তার জবাবদিহির আর কিছুই থাকে না। ইসলামে বিশ্বাসের (ইমানের) সঙ্গে সঙ্কর্ম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। যা তোমার নিজের জন্যে কাম্য নয়, তা তোমার ভাইয়ের জন্যেও কামনা করো না। বেঁচে থাকো বাঁচতে দাও, ভালো চাও, ভাল কর–এই হচ্ছে ইসলামের শিক্ষা। কোরআনের সর্বত্র পার্থিব জীবনে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পারস্পরিক ঘরোয়া ও সামাজিক ব্যবহারের বিধিনিষেধই নির্দেশিত হয়েছে। অতএব ইসলাম মুখ্যত ব্যক্তিক ও সামাজিক জীবনবিধি (code of life)। জেহাদও এ বিধির অন্যতম অঙ্গ। পার্থিবতাই ইসলামের বৈশিষ্ট্য এবং অন্যান্য ধর্মের তুলনায় এর শ্রেষ্ঠত্বও এখানেই।