অতএব দেখা গেল, এই প্রীতিহীন অনাত্মীয়ভাব বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর প্রতিবেশিকতারই ফল। তেমনি প্রতিপক্ষের অনুপস্থিতিতে তথা বিলুপ্তিতে বিধর্মী পূর্ব-পুরুষের মহিমামুগ্ধতা এবং ঐতিহ্যগর্বও অপর একধরনের সংকীর্ণচিত্ততা ও বিকৃতি প্রসূত। বাহ্যত একে শুভ ও শোভন মনে হলেও এও চিত্ত-প্রসারের অভাবজাত। কেননা এ ইতিহাস ও ঐতিহ্যচেতনার পশ্চাতে রয়েছে আদিম গোত্র-প্রীতি। মধ্যযুগে এ মনোভাব উদার-হৃদয় ও উন্নত মননের পরিচায়ক বলে অভিনন্দিত হতে পারত। কিন্তু এ-যুগে নয়। কারণ এ মনোভাবই এ-যুগের কাল–স্বস্তি-শান্তির শত্রু ও মানবতার দুশমন।
.
০৫.
এক হিসেবে বলতে গেলে আধুনিক যুগের সঙ্গে আগের কালের কোনো পারম্পর্য বা জ্ঞাতিত্ব নেই। এ যুগ শিক্ষিতের, যুক্তির ও বিজ্ঞানের। এ-যুগের জীবনের ভিত্তি বিচিত্র বিষয়ে জ্ঞান–যুক্তি (Rationality) এর অস্ত্র, আর বিজ্ঞান এর বাহন। এ-যুগ গণতন্ত্রের। কাজেই আমাদের ভুললে চলবে না যে আমরা যৌক্তিক জীবনের (Rational life) অধিকারী–এই মৌলিক স্বীকৃতির ভিত্তিতেই গণতন্ত্র চলতে পারে। এর আনুষঙ্গিক অঙ্গীকার রইল–আমাদের জীবনের ভিত্তি জ্ঞান, সম্বল যুক্তি আর বাহন বিজ্ঞান। নানা ধর্ম ও জাতি অধ্যুষিত এবং মতবাদ আকীর্ণ আজকের রাষ্ট্রে স্বাতন্ত্রবোধ ও জাতিবৈর গুরুতর অপরাধ। আজকের জাতীয়তা রাষ্ট্রভিত্তিক হতেই হবে। নইলে কল্যাণ নেই। নিজেদের এ বোধের অভাবেই জার্মানিতে ইহুদীরা নির্যাতিত হয়েছিল। আমরা জানি ক্ষতিস্বীকারের শক্তিতে মনুষ্যত্বের প্রকাশ এবং বরণ করার ক্ষমতাতেই সংস্কৃতির পরিমাপ। আমাদের জীবনচেতনা অনায়াসলব্ধ নয়, সাধনা-সাধ্য। পরিচর্যা করেই জীবনবৃক্ষে ফুল ফোঁটাতে, ফল ফলাতে আর রূপ চড়াতে হয়। জীবনে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সহিষ্ণুতার ও উদারতার, প্রীতির ও কল্যাণ বুদ্ধির।To know all is to pardon all. এই বোধ না জাগলে এ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বা ব্যক্তি-স্বাধীনতার যুগে সমাজে স্বস্তিতে বাস করা যাবে না। এ-যুগ মতবাদ পেশ করবার বা placing-এর যুগ–চাপানোর বা প্রচারের (preaching) কাল নয়। আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন প্রত্যেক ভদ্রলোকেরই তা বোঝা উচিত। শুধু কী তাই! এ যুগ মিলনের আর মিলানোর এবং দেওয়ার আর নেওয়ার যুগ। তাই স্বরাষ্ট্র ও স্বাজাত্যে সন্তুষ্ট থাকা যায় না– আন্তর্জাতিক শুভেচ্ছাও জাগিয়ে তুলতে হয়। কেননা রাষ্ট্রিক স্বাজাত্যবোধই হচ্ছে আজকের মানুষের ব্যক্তিজীবনে বল ভরসার আকর। আত্মকল্যাণই এর লক্ষ্য। কিন্তু কল্যাণ আপেক্ষিক শব্দ। অপরের অকল্যাণ করে নিজের হিত সাধন হয় না। ব্যক্তিস্বার্থ নির্ঘ ও নির্বিঘ্ন করতে হলে পরিবার-পরিজনের বৃহত্তর স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। তেমনি পরিবারের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যেই সামাজিক কল্যাণ সাধন করা প্রয়োজন হয়। সামাজিক কল্যাণ সাধনের খাতিরেই স্বাদেশিক মঙ্গলের দিকে সতর্কদৃষ্টি রাখা অপরিহার্য হয়ে উঠে। আর রাষ্ট্রিক কল্যাণের গরজেই আন্তঃরাষ্ট্রিক শুভেচ্ছার কামনা জেগে উঠে। লোভের থেকেই দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের উৎপত্তি। তাই সবার আগে উচ্চারিত হয়েছে এ সম্বন্ধে সতর্কবাণী-মা গৃধঃ। বেঁচে থাকো, বাঁচতে দাও; ভালো হও, ভালো চাও–এ যুগের চরম দাবী এ-ই। কেননা এ-পথেই পরম স্বস্তি ও শান্তি। আমরা আশাবাদী। মানুষের স্বাভাবিক ও পরিশীলিত মহত্ত্বে আমরা আস্থাবান। সেদিন হয়তো দূরে নয়, যখন বিশ্বমানবিকতা-বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ এক বিশ্বে এক রাষ্ট্রের অর্থাৎ বিশ্ব-রাষ্ট্রের ধ্বনি তুলবে।