স্থূলবুদ্ধির স্বধর্মের প্রতি আত্যন্তিক প্রীতি পরমত-অসহিষ্ণুতা তীব্র করে ও অর্থহীন অভিমান বাড়ায়। স্বাতন্ত্রবোধ তারই সন্তান। অন্ধ-অনুকৃতিকে সে স্বকীয়তা মনে করে, আর সে-স্বকীয়তার মহিমায় নিজেকে গরীয়ান ভাবতে তার ভালো লাগে। রক্ষণশীলতার জন্ম এখানেই। আর স্বাতন্ত্রকামী রক্ষণশীলের জাতিবৈর না থেকেই পারে না; কেননা আত্মরতি মাত্রই পরপ্রীতির পরিপন্থী। অতএব স্বাতন্ত্র্যবোধ জাতিবৈর জাগায়, আর জাতিবৈর স্বাতন্ত্র্যবোধ তীক্ষ্ণ ও তীব্র করে। এর আর একটি আত্মধ্বংসী দোষ-এ মন গ্রহণ করতে পারে না; সত্য, শিব ও সুন্দরকে বরণ করতে জানে না। এ অবস্থায় দৃষ্টি আচ্ছন্ন ও মন মোহগ্রস্ত থাকে। তাই পরমতের প্রতি সুবিচার করা সম্ভব হয় না। ভালো-মন্দ যাচাই করা চলে না, ফলে আত্মপ্রসার হয় না, আত্মক্ষয়ই তার পরিণতি। কল্যাণ-বুদ্ধিই তার জাগে না। আত্মসংকোচনে নিজেকে দুর্বল করে করে একসময়ে সে অপমৃত্যুই ডেকে আনে। ভয় আছে অথচ হিতবুদ্ধি নেই, তাই বর্জনই তার আদর্শ। নতুনকে– কল্যাণকে এভাবে বর্জন করেই সে হয় দেউলিয়া, জীবন-রসের ঘটে অভাব, ফলে সমাজ-দেহ যায়। ধসে, জাতীয় জীবন হয় বানচাল।
.
০৪.
অবস্থান্তরে এর আর একটি প্রতিক্রিয়া বা রূপও দেখা যায়। আপাতদৃষ্টিতে একে উদার ও মহিমময় বলে মনে হয়। একই গোত্রের বা গোষ্ঠীর একটা অংশ যখন ভিন্ন ধর্ম গ্রহণ করে, তখন তারা পরস্পর বিজাতি হয়। ফলে মন-মননের যোগসূত্র হয় ছিন্ন। পৈত্রিক-ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা, জ্ঞাতিত্ব অস্বীকার এবং জাতীয় ঐক্য বিনষ্টি ধর্মান্তরের অনিবার্য ফল।
স্বধর্মনিষ্ঠার সঙ্গে মৌরসী ঐতিহ্য অস্বীকারের গরজ বোধ করে সে। সনাতনীর আভিজাত্যবোধ আর নতুনের উত্তম্মন্যতা পারস্পরিক অশ্রদ্ধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অসহিষ্ণুতা ও দ্বন্দ্বপ্রবণতার ফলে সংঘাতও অনিবার্য হয়ে উঠে। এর আভাস পাই আর্য ইতিকথায়। পণ্ডিতের মুখে শোনা যায়, প্রাচীন ইরানে একসময়ে আর্যরা বাস করতে থাকে। ধর্ম ব্যাপারে একদা তাদের দ্বিমত দেখা দেয়। একদলের ইষ্ট দেব অপর দলের দুশমন দেও হয়ে উঠে। এ দলের শত্রু অসুর ও দলের দেবতা অহোররূপে পূজা পায়। তাই হয়তো শুরু হল লড়াই। পরাজিত দলই বাস উঠিয়ে দিয়ে নতুন বাস্তুর খোঁজে ভারতে আসে। এভাবে কিংবা ধর্মান্তরের ফলে যখন দেশ একধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত হয়, তখন নয়া ধর্মমতবাদীরা বিধর্মী পূর্বপুরুষের জ্ঞাতিত্ব কিংবা মৌরসী ঐতিহ্য অস্বীকার করে না, বরং সাদরে ও সাগ্রহে বরণ করে নেয়। এ কারণেই মুসলিম আরব হাতেমতাই, নৌফেল, ইমরুল কায়েস প্রভৃতির ঐতিহ্যগবী। ইরান শাহনামায় নিজেকে খুঁজে পায়। পারস্যের বাদশাহ আজ ইরানের শাহ, আরীয় মেহের ও পহলবী। আর ভারতের সনাতনীরা যে নয়াধর্মকে (বৌদ্ধধর্মকে) একদা গ্রাস করে, সেই ধর্মের দেব-দ্বিজ ও বেদ্বেষী অশোক ও তাঁর বৌদ্ধধর্মচক্রকে তারা জাতীয় মহিমা ও ঐতিহ্যের প্রতীক বলে সগর্বে বরণ করে নিয়েছে। অথচ আমরা জানি অশোক ব্রাহ্মণ্যবাদীদের প্রতি সদয় ছিলেন না; তিনি বলিদান রহিত করে ধর্মাচরণে বাধা সৃষ্টি করেছিলেন। বৌদ্ধ-রাজত্বে জীবহত্যা নিষিদ্ধ ছিল বলে ভারতবাসীরা আমিষ ভোজন প্রায় ভুলে গিয়েছিল। বাঙলার বাইরে বর্ণহিন্দুর নিরামিষপ্রীতি বৌদ্ধযুগের সেই ধকলের সাক্ষ্য বহন করছে। আর সে-যুগে বৌদ্ধে-ব্রাহ্মণ্যবাদীতে মারামারিও কিছু মাত্র কম ছিল না।
প্রতিপক্ষতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকেই হানাহানির উৎপত্তি। আর হানাহানি থাকলে স্বাতন্ত্র্যবোধ জাগবেই। (পাকিস্তান-পূর্ব যুগে হিন্দুদের বিলেতী পোশাক ও সংস্কৃতি বর্জন আর মুসলমানদের ধুতি বর্জন এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়)। এক্ষেত্রে যে-কোনো এক প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষের বিলুপ্তিতে বিদ্বেষ ও বিক্ষোভজাত চিত্ত-বিকৃতির উপশম হয়। সহজ কথায় বলা যায়, এ হচ্ছে প্রতিবেশী সুলভ হিংসা ও হানাহানি। প্রতীচ্য দেশীয়রা আমাদের প্রতিবেশী নয়, তাই তাদের সংস্কৃতি গ্রহণে আমাদের গ্লানিবোধ নেই। হিন্দু-মুসলমান পরস্পর প্রতিবেশী, তাই এখানে গ্রহণ-বরণ চলে না, বর্জনাদর্শই বজায় রাখতে হয়। কল্পনা করা যাক পাক-ভারতের সবাই মুসলমান হয়ে গেছে, তখন রামায়ণ মহাভারত মুসলমানদের জাতীয় মহিমার প্রতীক হবে, প্রতাপ-শিবাজী হবেন জাতীয় বীর।
আমি একবার ইসলামে দীক্ষিত এক ব্যক্তির মুসলিম পৌত্রকে জিজ্ঞাসা করেছিলোম– মুঘলেরা হলেন বিদেশী, আর প্রতাপ-শিবাজী হলেন দেশী লোক; এঁরা যদি আজকের আমাদের ইংরেজ তাড়ানোর মতো মুঘলকে তাড়াবার সাধনা করে থাকেন, তবে আমাদের সহানুভূতি তাঁদের প্রতি থাকা উচিত নয় কি? সে এ-কথার দুটো উত্তর দিয়েছিল। প্রথমটা দিয়েছিল তর্কের খাতিরে, আর দ্বিতীয়টা ছিল তার মনের কথা। সে বলেছিল–প্রতাপ-শিবাজীও তো এককালের বিদেশীর বংশধর। আর প্রতিবেশী বা জ্ঞাতির চেয়ে বিদেশী আত্মীয় প্রিয়তর। মুঘলেরা ধর্মসূত্রে আমাদের আত্মীয়-আমাদের ভাই। এ-কথার উপর তর্ক চলতে পারে, কিন্তু এটি হচ্ছে জীবনে অনুভূত ও পরীক্ষিত সত্য। কাজেই হৃদয়ের স্পর্শহীন মগজপ্রসূত যুক্তিপ্রয়োগ নিরর্থক। সত্যেন দত্তের আমরা বাঙালি কবিতায় বাঙলার কোনো মুসলিম-ঐতিহ্যের উল্লেখ নেই দেখে, এক হিন্দুবন্ধুকে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলাম-ঈসা খান তো হিন্দুর বংশধর, চাঁদ-প্রতাপের সঙ্গে তাঁর নামটি অন্তত উল্লেখ করা যেত। তিনি উত্তরে বলেছিলেন–মুসলমান হয়ে গেল যখন, তখন তো আর আপন ভাবা যায় না। আমরা জানি এর উপর আর কথা চলে না।