কিন্তু এ যে বিশেষ সাধনা-সাপেক্ষ, তাও মনে হয় না। কেননা ঘরে-সংসারে আমরা মায়ের সন্তান, স্ত্রীর স্বামী আর কন্যার পিতা; বাইরে কারো মজুর, কারো মনিব, কোনো প্রতিষ্ঠানে। সদস্য–কিন্তু তাতে তো দ্বন্দ্ব দেখিনে। তেমনি নিজের সমাজ-ধর্ম-জাতি-রাষ্ট্রের প্রতি অনুরক্ত অনুগত থেকেই মানুষ নির্বিশেষের প্রতি অসূয়া-অবিশ্বাস-অপ্রীতিমুক্ত মনোভাব পোষণ করতে বাধা কি! মনের তেমন অবস্থাতেই কেবল নিজের স্বাতন্ত্র্য দাবী করা চলে। এই স্বাতন্ত্র উত্তম্মন্যতার ধারক, সমকক্ষের অসূয়া-দ্বন্দ্বের বাহক নয়।
স্বাতন্ত্রবোধ ও জাতিবৈর
০১.
ঘৃণা, হিংসা ও ঈর্ষা–এই তিনটে পরিবেশ ও পাত্রভেদে মানুষের একই বৃত্তির বিচিত্র অভিব্যক্তি মাত্র। আমরা ছোটকে ঘৃণা করি, সমকক্ষকে হিংসা করি, আর বড়র প্রতি হই ঈর্ষ। ঘৃণার স্বাভাবিক প্রকাশ অবজ্ঞায় ও অবহেলায়, হিংসার শূর্তি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ও পরশ্রীকাতরতায় আর ঈর্ষার প্রকাশ ধনে-মানে প্রতিষ্ঠিত জীবনের দোষ-সন্ধানে ও অসূয়ায়। দুর্বলের বিপর্যয়ে আমাদের অনুকম্পা জাগে, সমকক্ষের দুর্যোগে সুপ্ত জিগীষাপ্রসূত আহ্লাদ বোধ করি আর বড়র দুর্দিনে আত্মপ্রসাদ পাই। অবশ্য এদের সঙ্গে প্রীতির কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকলে এদের দুঃখ-বিপদে বিচলিত ও দরদে বিগলিত হওয়াই স্বাভাবিক।
আমরা ছোটর সঙ্গে মিশতে চাইনে প্রাণের আরাম নেই বলে, সমকক্ষকে এড়িয়ে চলি প্রীতির অভাবে ও আত্মপ্রতিষ্ঠার গরজে আর বড়কে ধরা দিইনে তার সামনে বিব্রত বোধ করি বলে এবং নিজের ব্যক্তিত্ব স্ফুর্তি পায় না ভেবে। এসব অবশ্য আত্মপ্রত্যয়হীন সাধারণের আচরণ, যারা নিজেদের ব্যক্তিত্ব ম্লান হল ভেবে সর্বক্ষণ আতঙ্কগ্রস্ত। এরা বাইরে ভীরু আর অন্তরে প্রতিদ্বন্দ্বী। এ নিষ্ক্রিয় দ্বন্দ্বভাব তাদের মনের বিকৃতি ঘটায়। মনুষ্যত্বের সহজ বিকাশ এর ফলেই রুদ্ধ হয়। এরা সঙ্কীর্ণমনা, ছিদ্রান্বেষী ও অপচিকীর্ষ। কিন্তু যারা প্রাণধর্মের তাগিদে চলে, যাদের জীবন-জিজ্ঞাসা আছে, তাদেরকে এ বৃত্তি ভিন্নপথে চালিত করে। যে উচ্চতায় থেকে তারা দুর্বলকে ঘৃণা করবার মৌরসী অধিকার পায়, সে উচ্চতা বজায় রাখবার–পতন রোধ করবার সতর্কতাও তারা এ পথে লাভ করে এবং সমকক্ষের প্রতি হিংসার উত্তেজনা তাদের মনে জিগীষা জাগায় এবং শক্তি ও যোগ্যতা অর্জনে তাদের প্রবুদ্ধ করে। আর বড়র সমকক্ষ হবার প্রেরণাও খুঁজে পায় তারা। এই প্রতিক্রিয়াকে ইংরেজিতে incentive বলে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়–প্রতিযোগিতাই (competative spirit) হচ্ছে এদের স্বভাব। জীবনে এগিয়ে যাওয়ার পথ ও পাথেয় এরা সহজেই খুঁজে পায়।
.
০২.
আগের যুগে মানুষের শিক্ষাদীক্ষার সুযোগ ছিল না। চিন্তা বলতে অন্নচিন্তা আর তত্ত্ব বলতে অধ্যাত্মতত্ত্বই তাদের পরিচিত ছিল। জীবনকে–জীবন-সমস্যাকে তলিয়ে দেখবার, মানুষের বৃত্তি প্রবৃত্তিকে যাচাই করে খুঁটিয়ে বুঝবার গরজ বোধ করত না সাধারণে, সে সাধ্য তাদের ছিল না। তারা ছিল মোটা কথা আর স্কুল প্রয়োজনের মানুষ। ভবলীলা বলত বটে, কিন্তু জীবনলীলা জানত না, বুঝত কেবল জীবনে নিয়তির লীলা। পাপ-পুণ্য চেতনা তীব্রতর ছিল সত্য, কিন্তু পাপ-পুণ্যের সূক্ষ্ম সীমারেখা চিনত না।
তাই তাদের জীবনে সারল্য ছিল, স্থূলতা ছিল, আদর্শবাদও ছিল–ছিল না কেবল সূক্ষ্ম জীবনচেতনা যা দিয়ে ভালো, মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, লাভ-ক্ষতি যাচাইয়ের নতুনতর মাপকাঠি তৈরি করা যায়। তাদের জীবন ছিল অনুভূতি ও অনুসৃতি নির্ভর। তারা ছিল বাধা-পথের যাত্রী, নিয়মের পূজারী এবং পীর ছিল তাদের দিশারী। ডানে-বাঁয়ে পা ফসকে গেলেই মানুষ হারিয়ে যেত, নৈতিকমানে তলিয়েও যেত। আমরা সাধারণ মানুষের কথা বলছি; অসামান্য ব্যক্তি চিরকালই স্বতন্ত্র, কাজেই তাদের কথা আলাদা।
.
০৩.
সেকালে মানুষের চলনে-মননে-কথনে মত বলতে একটিই ছিল–ধর্মমত। মানুষের প্রাত্যহিক, ব্যবহারিক ও আচারিক জীবনের খুঁটিনাটি সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হত ধর্মমতের দ্বারা। কাজেই সে-যুগে মতান্তর ছিল মারাত্মক ব্যাপার। মতান্তর মাত্রই মনান্তর, ফলে তা ছিল দ্বন্দ্ব-সংঘাত সঙ্কুল। মত প্রীতি এ-যুগেও কম নয়, কিন্তু শিক্ষা-দীক্ষার ফলে পরমতসহিষ্ণুতা এসেছে অন্তত প্রচুর বেড়েছে। সে-যুগে এটিই ছিল প্রায় অজ্ঞাত। ফলে মতান্তর দ্বন্দ্বপ্রবণতায় ইন্ধন যোগাত। আর তাতেই স্বমতের হলে মেহেরবান আর ভিন্নমতের হলে দুশমন ঠাওরানো হত। এ যুগে এর কিছুটা উন্নতি হয়েছে, স্বমতের হলে মিত্র ভাবি বটে, কিন্তু ভিন্নমতের হলেই শত্রু মনে করিনে।
Animism-এর আমলের গোত্রীয় দ্বন্দ্ব ও বিচ্ছিন্নতা এড়ানোর জন্যেই ঐক্যবদ্ধ সমাজসৃষ্টির প্রয়াসে অভিন্ন স্রষ্টা ও উপাস্যের নামে মতাদর্শের অভিন্নতার ভিত্তিতে মানবিক ঐক্য, সহযোগিতা ও প্রীতি স্থাপনের পন্থা হিসেবে চিন্তাশীল মানুষ উদ্ভাবন করলেন ধর্মের। কাজেই–ধর্ম এল মানুষের স্বস্তি-শান্তির জন্যে, সমাজবদ্ধ মানুষের পারস্পরিক বোঝাঁপড়ার গরজে। সব মানুষ একমত হতে পারল না। তাই সৃষ্টি করে চলল তাদের পছন্দমতো নানা ধর্ম। বাধল সংঘাত। কারণ পরমতসহিষ্ণুতা ছিল না। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ধর্মের নামে কত রক্তনদী বয়ে গেছে তার হিসেব নেই। বর স্বরূপ যা কামনা করা হয়েছিল, এভাবে তা শাপে পরিণত হল। এ যুগের আগে ধর্মমতই ছিল মানুষের শঙ্কা ও ত্রাসের কারণ। চোর-ডাকাতের ভয়ে ধনী যেমন সদা-শঙ্কিত, সংখ্যালঘু দুর্বলও তেমনি থাকত সতত সন্ত্রস্ত। ধর্মমতই ছিল জাতি নির্ণয়ের নিরিখ। এ কারণে শুধু-যে জাতীয় জীবনই বিপন্ন হত, তা নয়; ব্যক্তিজীবনও নিরঙ্কুশ ছিল না। কেবল কী তা-ই, একই ধর্মাবলম্বীর বিভিন্ন শাখায়ও লেগে থাকত হানাহানি। মানুষের চরম কাম্য হচ্ছে নির্ঘ-নির্বিঘ্ন জীবন অর্থাৎ শান্তি। তারই উপায়স্বরূপ সৃষ্টি হয়েছে সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্র। আশ্চর্য, এ সবই হয়ে উঠল মানুষের কাল। এদের পেষণে মানুষ হারিয়েছে দিশা–জীবনের সহজ ও স্বাভাবিক স্ফূর্তির পথ।