গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল কথা অধিকারের সমতাবিধান–সে সামঞ্জস্য অবশ্যই মানসিক হওয়া চাই। সমাজ ও শাসন সংক্রান্ত আদর্শের বিভিন্নতার কোনো বিশেষ মানস প্রতিক্রিয়া নেই–কারণ, তা একান্তভাবে দলভিত্তিক। একই পরিবারের বিভিন্ন পরিজন বিভিন্ন দলভুক্ত থাকতে পারে। কিন্তু ধর্ম, ঐতিহ্য প্রভৃতি বিষয়ে মানুষের Sentiment ভিন্ন প্রকৃতির এবং মানুষের মানস-সত্তায় এর প্রভাব অপরিমেয়। কাজেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দলীয় রাজনীতি ও আদর্শ চলতে পারে, কিন্তু কোনো একপক্ষের ধর্মীয় ও গোত্রীয় আদর্শ কিংবা ঐতিহ্যের আধিপত্য চলতে পারে না। এ-যুগে রাষ্ট্রের দুর্বলতা ও সর্বনাশ যদি কোথাও লুকিয়ে থাকে তবে তা এই ধর্ম, গোত্র ও ঐতিহ্যপ্রীতিপ্রসূত গোঁড়ামির মধ্যেই। এতে অগ্রগতি এবং উন্নতিও ব্যাহত হয়। এ-যুগে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যা-কিছু হবে, তা সর্বজনীন আগ্রহ ও আবেগের প্রতীকই হবে। নইলে মানস-দ্বন্দ্বের আর তার থেকে বিপদকালে বিপদ বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকবেই। কাজেই এ-যুগের সাধনা পুরাতনের নিছক জের টানাতে নয়, নতুনেরও প্রতিষ্ঠায়—-নিছক ঐতিহ্যানুসরণে নয়, ঐতিহ্য সৃজনে। এ-যুগের শান্তি ও নিরাপত্তা কোনো বিশেষ গোত্রের গৌরববোধে নেই, রয়েছে রাষ্ট্রভিত্তিক জাতি গড়ে তোলার মধ্যেই। আর এক হিসেবে সর্বজনীন মিলনক্ষেত্রে স্ব স্ব গোত্র ও ঐতিহ্যপ্রীতির উগ্র প্রকাশ সংকীর্ণতা, আত্মরতি ও আদিম গোত্রীয় মনোভাবেরই পরিচায়ক। এটি পশ্চাদুখিতারও প্রমাণ। পরমতসহিষ্ণুতা ও উদারতাই এ-যুগের সাধ্য। ক্ষতি স্বীকারের শক্তিতেই মনুষ্যত্বের প্রকাশ, আর বরণ করবার সামর্থ্যেই সংস্কৃতির পরিমাপ। আছে তো রইলই, যা নেই তা অর্জনের প্রয়াসই তো জীবন-সাধনা। প্রাণের স্ফূর্তি, মনের মুক্তি এবং মানের বৃদ্ধি এভাবেই সম্ভব, আর এ-যুগে তা প্রয়োজনও। এ-যুগ স্বাতন্ত্রবোধের নয়, সাকুল্য বোধের–বিযুক্তির নয়, সংযুক্তির। আভিজাত্য গর্বের নয়, গণসংযোগের। ব্যষ্টির নয়, সমষ্টির। পুরোনো দিয়ে ঘট ভরে রাখলে নতুনকে কিছুতেই ঘরে তোলা যাবে না। তাই জীর্ণ পুরোনোকে বর্জন করে সার্থক নতুনকে গ্রহণ করার প্রস্তুতি চাই। ঐকিক মৌলিকের মাহাত্ম্য যা-ই থাক না কেন, এ-যুগে মানব-মহিমা যৌগিক সামগ্রিকতায় অভিব্যক্ত। ব্যষ্টির বাসনা নয়, সমষ্টির প্রয়োজন মিটানোই যুব্রত। জনে জনে জনতা হয় বটে কিন্তু তা অকেজো; গণভোটে হয় গণনেতা, তার শক্তির সীমা নেই।
ব্যক্তিক স্বার্থ আলাদা হওয়া সত্ত্বেও যেমন প্রীতিপূর্ণ পারিবারিক ও সামাজিক যৌথজীবন অকৃত্রিম এবং বাস্তব; তেমনি ধর্ম, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি পৃথক হলেও ভেদবুদ্ধিহীন একক রাষ্ট্রিক জাতীয় জীবন গড়ে তোলা সম্ভব।
জীবনবোধ ও সংগ্রাম
মানুষের যাযাবর বৃত্তি আমাদের কৌতূহল জাগায়, আকৃষ্ট করে, এমনকি বিস্মিত করে অনেক সময়। অথচ জীবের চলমানতা একটি স্বাভাবিক বৃত্তি। তবু যে এটি আমাদের আকৃষ্ট করে, তার কারণ হয়তো এই বাহ্য-পরিচয়ের গভীরে একটি প্রবল উদ্ভিদ-স্বভাব রয়েছে আমাদের যাকে ঠিক জড়তা বলা চলে না। উদ্ভিদ যেমন সজীব হওয়া সত্ত্বেও মাটি বা জল আঁকড়ে হতে চায় দৃঢ়মূল ও নিশ্চল, প্রাণীজগতেও আমরা তেমনি দেখতে পাই স্থায়ী নিবাসের তীব্র আগ্রহ। মানুষের আদর্শ, উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যও এই নিশ্চিন্ত স্থায়িত্বকামী মনের আকাক্ষাপ্রসূত। আমরা কেবল ধরে রাখতে চাই, ভরে তুলতে চাই, হারাতে চাইনে কিছুই, ফেলতে চাইনে ভালোলাগা কিছুকেই। আমাদের অমরত্ব কামনার উৎসও এখানেই। আত্মার চিরন্তনত্বের ধারণাও গড়ে উঠেছে এই আত্যন্তিক স্থায়িত্ব কামনা থেকেই। জীবের সন্তান কামনা এই স্থায়িত্ব-লোভ তথা অমরত্ব বাঞ্ছার বিকল্প রূপ।
এ কারণেই কোনো বস্তুর দীর্ঘস্থায়িত্বের সম্ভাবনা না থাকলে আমরা উৎকণ্ঠা কিংবা অশ্রদ্ধা পোষণ করি মনে মনে। ভারতীয় বৌদ্ধমত ও মায়াবাদ এই উৎকণ্ঠা, অস্বস্তি ও অশ্রদ্ধারই অভিব্যক্তি। এজন্যেই জানা অতীত ও নিশ্চিত বর্তমানের প্রতি আমাদের এত আস্থা ও আকর্ষণ, আর অজানা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের প্রতি শঙ্কিত দৃষ্টি। পুরোনো-প্রীতি ও নতুন-ভীতির মূল এখানেই। তাই আমাদের জীবন-সাধনা তথা জীবনে সাধ্য হচ্ছে স্থায়িত্ব, নিশ্চয়তা ও নির্ঘাকি নির্বিঘ্নতা। এ-ই হচ্ছে মানুষের তথা জীবের সচেতন জীবন-প্রচেষ্টা। আর অবচেতন আকাঙ্ক্ষা যার নাম দেয়া যায় ঔৎসুক্য হচ্ছে নতুনকে চাওয়া ও পাওয়া। যাযাবর বৃত্তির মধ্যে এই নতুন প্রীতি তথা adventure-প্রবণতাই ক্রিয়াশীল। আমাদের অবচেতন-লোলুপতা যাযাবর তথা বেপরওয়া জীবনের পরিপোষক। তাই জীবনের স্বরূপ–সুনিশ্চিত ও স্থির-লক্ষ্য জীবন-প্রচেষ্টায় রূপায়িত কিংবা অনিশ্চিত দ্বান্দ্বিক জীবন-জিজ্ঞাসায় প্রকটিত, তা এককথায় বলা যায় না নিঃসংশয়ে।
তবে বাহ্যত নিশ্চিত আশ্রয় সন্ধান জৈবধর্ম হলেও মানুষের অন্তরতম প্রদেশে যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত-প্রীতি রয়েছে, তা অস্বীকার করবার উপায় নেই। আমরা দেখছি, মানুষের মধ্যে যে সহজ প্রাণশক্তির অধিকারী ও যে আত্মপ্রত্যয়শীল, সে আত্মপ্রসারে উনুখ ও উদ্যোগী। আত্মপ্রসার করতে চাইলেই নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত জীবনে স্বেচ্ছায় বরণ করতে হয় দ্বন্দ্ব ও সংঘাতকে, নিতে হয় বাঁচামরার ঝুঁকি। যেমন, রাজা সুখে রাজ্য করছেন হঠাৎ তার বুকে জাগল আত্মশক্তি সম্বন্ধে দৃঢ়প্রত্যয়, মাথায় চাপল সে-শক্তি প্রকাশের খেয়াল। তাকে ঘাড়ে ধরে চালিত করে পর নিপীড়নের ভূত। বাঁচা-মরার ঝুঁকি নিয়ে বিচিত্র উল্লাসে তিনি চালান অভিযান। আত্মশক্তিতে আস্থা এবং অপরের দুর্বলতার সন্ধানই তার কাছে আত্মবিস্তারের ও আত্মপ্রতিষ্ঠার সুযোগ। সে-সুযোগ তাকে নামায় দ্বন্দ্বে ও সংঘাতে! কাজেই সংগ্রামে সামর্থ্যই তাঁর মতে সুযোগ। সংগ্রামই তাঁর কাছে জীবন-প্রচেষ্টা, সংঘাত সৃষ্টিই জীবন-সাধনা; জয়েই জীবনের উল্লাস, বিকাশ ও বিস্তার; সাফল্যেই স্বপ্রতিষ্ঠা ও সার্থকতা। আর দ্বন্দ্ব-ভীরু সাধারণ মানুষের কাছে সুযোগ মানে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনুপস্থিতি। সাধারণ মানুষের এ পরিচয়-যে জীবনের ও প্রাণধর্মের বিকৃতরূপ, তার প্রমাণ মেলে আমাদের খেলায় ও সাহিত্যে।