ধর্মান্তরে জাত্যন্তর হয়, কিন্তু দেশান্তর বা ভাষান্তর হয় না। য়ুরোপ খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করেছে, কিন্তু হিব্রু ভাষা ঠাঁই পায়নি সেখানে। বৌদ্ধধর্ম দেশদেশান্তরে গেছে, কিন্তু কারো জাতীয় ভাষা হয়নি পালি। কাফিরের ভাষা বলে আরবি ত্যাগ করেনি মুসলমান আরব। কোরআন তো নাযেল হল সে ভাষাতেই! বাঙালি মুসলমানের চিরকালের মুখের বুলি, প্রাণের ভাষা, স্বপ্নের বোল কী করে হয় হিন্দুয়ানী ভাষা? বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্যের ছাপ কম হবে না হিন্দুয়ানীর চেয়ে। আমাদের মধ্যযুগীয় অবদানের সম্যক উদ্ধার ও আলোচনা হয়নি আজো। আমাদের রিথের দলিল নেই আমাদের হাতে, মুছে গেছে স্মৃতি থেকেও, তাই নিজের সম্পদের দাবী জানাতে সঙ্কোচ বোধ করি আমরা। হীনমন্যতায় আমাদের রুচি-বুদ্ধি বিকৃত। আমরা বিভ্রান্ত, বিমূঢ়! ইতিহাসও আজ আমাদের কাছে যোবা। অথবা আমরা কালা ইতিহাসের বাণী আমাদের মর্মে দূরে থাক–কানেও পৌঁছে না। আরবি একদিন জবর-দখল বসাতে চেয়েছিল ইরানি ভাষায়; আত্মসচেতন ফেরদৌসীর নেতৃত্বে তা হয়েছে অস্বীকৃত ও বিচ্যুত। তবু মুসলিম ধর্ম-দর্শনে ইরানের দানই সবচেয়ে বেশি। আমরাও থাকব মুসলমান; আমাদের ভাষাও থাকবে বাঙলা। এ ভাষাই আমাদের মন-মননের অভিপ্রায় অনুসারে ইসলামি ভাবের জারকরসে অভিষিক্ত হতে বাধা নেই। এটুকুই আমাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।
স্বাজাত্যবোধ হচ্ছে মানুষের ব্যক্তিজীবনে বল-ভরসার আকর। আত্মকল্যাণই এর লক্ষ্য। কিন্তু কল্যাণ আপেক্ষিক শব্দ। অপরের অকল্যাণ করে নিজের হিত সাধন হয় না। ব্যক্তিস্বার্থ নিৰ্ধন্দু ও নির্বিঘ্ন করতে হলে পরিবার-পরিজনেরও বৃহত্তর স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়, তেমনি পরিবারের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যেই সামাজিক স্বার্থ সম্বন্ধে সচেতন থাকা চাই। সামাজিক-কল্যাণ সাধনের খাতিরেই স্বাদেশিক ও স্বাজাতিক কল্যাণের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়ে ওঠে অপরিহার্য। আর স্বাজাতিক কল্যাণের গরজে জেগে উঠে আন্তর্জাতিক শুভেচ্ছার কামনা। লোভের থেকেই দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের উৎপত্তি। তাই সবার আগে উচ্চারিত হয়েছে এ সম্বন্ধে সাবধান বাণী–মা গৃধঃ। বেঁচে থাকো বাঁচতে দাওLive and let others live-এ যুগের চরম দাবী এ-ই। এ পথেই পরম স্বস্তি তথা শান্তি। এ যুগদাবী জেগে উঠুক আমাদের হৃদয়ে। এ-ই কামনা করি।
স্বাতন্ত্র
সাপে-মানুষে যে পার্থক্য, তাকেও পারস্পরিক স্বাতন্ত্র্য বলা চলে। কিন্তু তাতে কারো গৌরব নেই, কেননা তা প্রাকৃতিক কিংবা সৃষ্টির নিয়মেই পাওয়া। জন্মসূত্রে যা মেলে, তা-ই স্বভাব। স্বভাবের বিভিন্নতা সৃষ্টি-বৈচিত্র্যেরই নির্দেশক। আর রূপগত ও গুণজাত অনৈক্য স্বাতন্ত্র-জ্ঞাপক নয়, বিধাতার বিচিত্র বিলাস-বিধানের পরিচায়ক।
মানুষের সম্পর্কে স্বাতন্ত্র-এর রয়েছে বিশিষ্ট্য অভিধা। স্বাতন্ত্র্য উৎকর্ষসূচক, বিশেষ ব্যঞ্জনা ঋদ্ধ শব্দ। মানুষের স্বাতন্ত্র্য অর্জিত গুণ। তা একান্তভাবে ব্যক্তিক চর্যায় ও চর্চায় লভ্য। এটি ব্যক্তিবিশেষের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বোধি ও মনন-সঞ্জাত। অতএব স্বাতন্ত্র্য কখনো সমাজ কিংবা জাতিগত হতে পারে না। একের উপলব্ধ সত্য অপরের অনুকৃতিজাত আচরণের তথ্যে পরিণত হলে তা প্রাণহীন মারাত্মক আধির রূপ নেয়। কেননা তখন তা অশিক্ষিত, অপরিশ্রুত এবং অনুপলব্ধ যান্ত্রিক অনুশীলন ছাড়া কিছুই নয়। যন্ত্র হচ্ছে একটি অবয়ব যা সুপ্ত শক্তির আধার। যন্ত্রীর অভিপ্রায়ই যন্ত্রকে চালিত করে। ফল হয় অভিপ্রায়-অনুগ। অভিপ্রায় যেখানে অস্পষ্ট; অস্থির, ফল সেখানে লক্ষ্য-নির্দিষ্ট হতে পারে না; আগুনের যেমন নিরবলম্ব কোনো রূপ নেই, তেমনি অভিপ্রায়-নিরপেক্ষ কোনো যন্ত্র নেই।
সচেতন মনের স্বতস্ফূর্ত অভিপ্রায়ে আর বন্ধ্যামনে আরোপিত অভিপ্রায়ে তফাৎ দুস্তর। ঘরে সংসারে লোকে সুনিশ্চিত অভিপ্রায়ে ব্যবহার করে আগুন। সে আগুন অবোধ শিশুর কর্তৃত্বে গেলে ঘটায় অনর্থ।
সমাজ-ধর্ম-জাতি-রাষ্ট্র প্রভৃতি যা-কিছু মনুষ্যকল্যাণে রচিত, তা হচ্ছে পরিচর্যা-পুষ্ট, পরিত রুচি, প্রজ্ঞা-ঋদ্ধ শ্রেষ্ঠ মানুষের মনন-মনীষার প্রসূন। নির্ঘ নির্বিঘ্ন নিশ্চিন্ত জীবন-প্রতিবেশ রচনার জন্যে যা পরিকল্পিত, বন্ধ্যা মনের অনুকৃত অভিপ্রায় সংযোগে তা-ই হয়েছে সঙ্কট-শঙ্কার আধার। সমাজ-ধর্ম-জাতি-রাষ্ট্রের নামে যত পীড়ন, যত রক্তপাত ও জীবন নাশ হয়েছে, তেমনটি মহামারী ভূমিকম্প-অগ্ন্যুৎপাত কিংবা ঝড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও হয়তো হয়নি।
প্রকৃতি আজ আর মানুষের শত্রু নয়–অনুগত। জীবজগৎ মানুষের কৃপাজীবী। মানুষ আজ অকুতোভয়। জগৎ প্রতিবেশে সে আজ যথার্থই স্বস্থ ও সুস্থ। তাহলে তাকে অমৃতের পুত্ররূপে, আনন্দের সন্তান স্বরূপ পাইনে কেন! তার কারণ, বাইরে যে স্বপ্রতিষ্ঠ বটে, কিন্তু তার মর্মমূলে জন্মেছে কীট। সে-কীটের দংশনে সে পীড়িত। বহির্জীবনের ঐশ্বর্যের মধ্যেও সে দুঃস্থ আর্ত। অপরিশ্রুত মনের আত্মরতি, বিদ্বেষ, অবজ্ঞা সংকীর্ণতা বদ্ধচিত্ততা ও স্বার্থবুদ্ধি জন্ম দিয়েছে এ কীটের। এ চিত্তে পরশ্রীকাতরতা ও পরপীড়নের উল্লাস ছাড়া কিছুই ঠাই পায় না। তাই মুসার পাপবোধ, ঈসার প্রীতিবাঞ্ছ, গৌতমের সহ-অবস্থান তত্ত্ব, মুহম্মদের যুক্তিনিষ্ঠা প্রভৃতি জনচিত্তাধারে ব্যঞ্জনাহীন বুলিরূপে বিধৃত। তার প্রয়োগও স্কুল এবং মারাত্মক।