সংস্কৃতিবান জীবনযাত্রী তার চলার পথ দীপ্ত করে, পথের দু-ধারে দ্যুতি ছড়িয়ে, অপরকে দি গা দিয়ে, অন্তরের মাধুরী বিলিয়ে ও জীবনের প্রসাদ পেয়ে ধন্য হয়– ধন্য করে অন্যদের।
তাই সংস্কৃতিই জীবনযাত্রীর পাথেয়। তার কথায় কাজে চলায় স্কুল প্রয়োজনাতিরিক্ত যে লাবণ্য থাকবে, তা-ই হবে সমাজের অন্য মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্কের সূত্র। হৃদয়ের প্রীতিকামী আবেগই বিভিন্ন আত্মার মিলন-ডোের। তার বোধে ও দৃষ্টিতে বসুধৈব কুটুম্বকম। তাই সংস্কৃতিবান মানুষ সমাজে বিশিষ্ট কিন্তু স্বতন্ত্র নয়।
সাধারণ মানুষ সৃজনশীল নয়, তাদের উদ্ভাবনী শক্তি নেই। তারা গ্রহণশীল হয়েই হয় সংস্কৃতিবান। তাছাড়া কোনো দেশে বা জাতে মানুষের ব্যবহারিক ও মানসজীবনের সব চাহিদা মেটাতে পারে, সর্বপ্রকার অভাব ঘুচাতে সমর্থ তেমন প্রতিভাবান বা ততগুলো প্রতিভাধরের আবির্ভাব হয় না, অন্তত আজো হয়নি। কাজেই সৃজনশীলতার সাথে গ্রহণশীলতাও থাকা চাই, নইলে সংস্কৃতি চালু রাখা যায় না। এজন্যে কোনো দেশের বা জাতির সংস্কৃতি কখনো অমিশ্র বা মৌলিক থাকে না। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে স্বাঙ্গীকরণ বা আত্মস্থ করাই হচ্ছে সাধ্য। যারা সৃজনে সমর্থ নয়, অথচ গ্রহণবিমুখ–যেমন পার্বত্য ও আরণ্যক মানুষেরা তাদের মন-মনন ও সমাজ স্থাণু।
কেননা সংস্কৃতিপরায়ণতার অন্য নাম গতিশীলতা। ক্রমোকর্ষ ও উন্নয়নই এর ধর্ম। আমরা বাঙালিরা সংস্কৃতিবান হয়েছি, এগিয়ে চলেছিসৃজন করে নয়, গ্রহণ করেই। আমাদের ধর্ম এসেছে- উত্তরভারত ও আরব থেকে, ভাষাটাও উত্তরভারতের। প্রশাসনিক ঐতিহ্যও উত্তর ভারত, উত্তর এশিয়া ও য়ুরোপ থেকে পাওয়া। আজকের ব্যবহারিক জীবনের সব উপকরণ এবং মানসজীবনের সব প্রেরণা আসছে য়ুরোপ থেকেই। অতএব সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা গ্রহণশীল ও অনুকারক।
স্বদেশ, স্বভাষা ও স্বাজাত্য
আমরা প্রায় সবাই বাঙালি-মুসলমান অর্থাৎ দেশজ মুসলমান– এ-কথা অস্বীকার করবার জো নেই। আমাদের স্বভাবে, সামাজিক সংস্কারে, জীবনবোধে সর্বোপরি আমাদের নৃতাত্ত্বিক নিদর্শনে আমাদের এই বাঙালিয়ানার ছাপ রয়েছে পুরোপুরি। আবার আমরা ধর্মাদর্শে আরবের অনুসারী। কৃষ্টি-সংস্কৃতির চর্চায় এককালে আমরা ছিলাম ইরানের অনুকারী, এখন হয়েছি য়ুরোপীয় সভ্যতার সাধক!
বিগত হাজার বছর ধরে চলেছে আমাদের সমন্বয় সাধনা–তিনটে দেশ থেকে পাওয়া তিন ধারার স্বভাব, আদর্শ ও সংস্কৃতির সমন্বয়-সাধনা।
আদর্শ যত মহই হোক, জাতীয় জীবনে তা স্বভাবধর্মকে ছাপিয়ে উঠতে পারে না কখনো। স্বভাবের সঙ্গে রয়েছে আবহাওয়া-প্রতিবেশের সম্পর্ক, আর আদর্শবাদ হচ্ছে একান্তভাবে বুদ্ধিপ্রসূত। বৃত্তি-প্রবৃত্তির অভিব্যক্তিই স্বভাব; আর মন-মননজাত কল্যাণ বুদ্ধিই হচ্ছে আদর্শবাদ। স্বভাবের স্বপ্রকাশ প্রায় অপ্রতিরোধ্য আর জীবনে আদর্শের রূপায়ণ ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও সাধনাসাপেক্ষ। তাই হাজার বছরেও সার্থক বা সফল হয়ে ওঠেনি আমাদের সমন্বয়-সাধনা। গড়ার পরিমাণ হয়তো তবু বেশি, কিন্তু নগণ্য নয় ভাঙার পরিমাণও। কোরআন-হাদিস আমাদের নিত্যসঙ্গী, তবু লৌকিক সংস্কার থেকে আমরা মুক্ত ছিলাম না কখনো। আজ লৌকিক সংস্কার ছেড়েছি আমরা, আমাদের কৃতিত্ব নেই এতে–নেই কোনো সিদ্ধির আত্মপ্রসাদ। কেননা তার বদলে ধর্মাদর্শকে দৃঢ় করে ধরিনি আমরা। আসলে ভোগেচ্ছা ছাড়া এ-যুগে সবকিছুই ছাড়ছি আমরা, তাই ত্যাগ করেছি। কুসংস্কারও।
হয়তো আমাদের আরো বহু কল্যাণবুদ্ধি লোপ পাবে যুগ-প্রভাবে। কিন্তু স্বদেশ, স্বভাষা ও স্বজাতির প্রতি মমতা ছাড়তে পারব না কখনো। স্বদেশ তথা আবাস হচ্ছে নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত নিবাস। একে বলা চলে জীবনবৃন্ত। আর ভাষা হচ্ছে জীবন-রস। যে-ভাষার মাধ্যমে বোল ফোটে শিশুর, যে-ভাষায় অনুভূতি পায় অপরূপ অভিব্যক্তি, সে ভাষা বলতে গেলে–জুড়ে থাকে জীবনের সবখানিই। এ তথ্যটি ভালোভাবেই জানতেন আগের যুগের বাঙালি মুসলমান। তাই তারা স্বধর্ম ত্যাগ করলেও আঁকড়ে ধরে ছিলেন স্বভাষা। তাঁরা জানতেন ভাষা ও সাহিত্য শুধু মহৎ প্রেরণার সহায়কই নয়, জীবনানুভূতির ভিত্তি বা জীবনরসের উৎসও। তারা বুঝতেন শব্দের নিজস্ব কোনো স্বরূপ নেই। মানুষের রস-কল্পনাই শব্দকে দেয় মূর্তি ও দান করে প্রাণ। শব্দের ব্যঞ্জনা, ভাব বা চিত্র-প্রতীকতা আর সামগ্রিক অভিধা বক্তার রস-চেতনা, বুদ্ধি, বোধি ও অভিপ্রায় নির্ভর। বক্তার ভাবকল্পের দ্বারাই শব্দার্থ হয় নিয়ন্ত্রিত, শব্দার্থের দ্বারা পরিচালিত হয় না ভাব। তাই যেখানেই অনুভূতির কথা, যেখানেই বোধির প্রকাশ, সেখানেই বক্তার অভিপ্রায় শব্দকে–
অর্থের বন্ধন হতে নিয়ে তারে যায় কিছু দূর।
ভাবের স্বাধীন লোকে পক্ষবান অশ্বরাজ সম।
এজন্যেই ঈশ্বর, খোদা, নিরঞ্জন বা ভগবান মুসলমানের মুখে এক অপরূপ আল্লাই নির্দেশ করে। তাদের কাছে নামাজ নমস্কার নয়– সালাতই। রোজাও দৈনিক উপবাস মাত্র নয়–সিয়াম। অতএব প্রতিশব্দ ভাবের প্রতিরূপ যে বদলায় না, এ বোধ ছিল সেকালের স্থিতধী বাঙালি মুসলমানের। তাই ইসলাম বরণ করে তারা ছেড়েছিল হিন্দুয়ানী, অবজ্ঞা করেছিল–ভুলতে চেষ্টা করেছিল হিন্দু-ঐতিহ্যকে, কিন্তু ছাড়েনি স্বভাষা ও সাহিত্যের চর্চা। তাই আমরা আদিকাল থেকেই। পাচ্ছি হিন্দুর রচনার পাশে মুসলমানের রচনার সাক্ষাৎ। শাহ্ মুহম্মদ সগীর চণ্ডীদাসেরই। সমসাময়িক। মালাধর বসুর সাথে পাচ্ছি জায়নুদ্দিনকে। বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপলাই, কৃত্তিবাস, কবীন্দ্র পরমেশ্বর, শ্ৰীকরনন্দী, দ্বিজ শ্রীধর, মাধবাচার্য, মুকুন্দরাম প্রভৃতির পাশে পাচ্ছি সৈয়দ সুলতান, চাঁদকাজী, শেখ কবির, শা বারিদখা, শেখ ফয়জুল্লাহ, দৌলত উজির বাহরাম খা, মুহম্মদ কবীর, দোনাগাজী প্রভৃতিকে। শুধু কী তাই? মুসলমান কবিরাই বিষয় ও রস-বৈচিত্র্যে মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন বিচিত্র ধারায়। আর বিদেশাগত আমীর-ওমরাই শুধু বাঙলা ভাষা-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেননি, বহিরাগত অভিজাত মুসলমান-সন্ততিগণও করেছেন স্বকীয় অবদানে বাঙলা সাহিত্যের বিকাশে প্রচুর সহায়তা। বাহরাম খাঁ, শা বারিদ খা, সৈয়দ সুলতান, সৈয়দ মুর্তজা, সৈয়দ আইনুদ্দিন, কোরেশী মাগন ঠাকুর, মুহম্মদ খাঁ প্রভৃতির নাম ও আত্মপরিচয়ে রয়েছে আমাদের উক্তির সমর্থন। এঁদের কেউ কেউ আবার আমীর-ওমরাহর বংশধর বা স্বয়ং আমীর।