তাই যার মনে চেতনার উদ্ভব, কৃতিত্ব ও মৌলিকতার গৌরব তারই–অনুকারকদের নয়। নতুনতর কিছু কোনো ব্যক্তিমনে উদ্ভূত না-হওয়া পর্যন্ত অনুকারকদের মধ্যে পুরোনোটাই অনুবর্তিত হতে থাকে এবং সে-কারণেই তা জাতীয় বা দেশীয় সংস্কৃতি- রূপে পরিচিত হয়, কাজেই যে কোনো সৃষ্টিমূলে রয়েছে ব্যক্তিগত চেতনা। নতুন ভাব, চিন্তা কিংবা বন্ধুমাত্রই ব্যক্তিমনের দান। এককথায়, যে-কোনো উদ্ভাবন ও আবিষ্কার ব্যক্তিগত চিন্তা, অনুভূতি ও প্রয়াসের প্রসূন।
জীবনযাপনটাকে যদি শিল্পকর্মের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে জীবন রচনা ও চালিত করার জন্যে শিল্পীর মতো চেতনা, সৃজনশীলতা ও নৈপুণ্য প্রয়োজন। তেমন লোকের সামাজিক ভূমিকা বিদ্রোহীর ও বিপ্লবীর। কেননা পুরাতনে আকর্ষণ না হারালে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রেরণা মেলে না। সমাজে, ধর্মে ও রাষ্ট্রে, আচারে, আচরণে ও কর্মে রীতি-নীতি ও আদর্শে যারা কিছু নতুন করেছেন, তারা সবাই পিতৃপুরুষের সমাজ ও ধর্মদ্রোহী।
সাংস্কৃতিক প্রেরণার মূলে রয়েছে সৌন্দর্য-অন্বেষা। কেউ কেউ বলেন পশু-প্রায় মানুষ যেদিন ফুলের সৌন্দর্যে ও সুরের মাধুর্যে আকৃষ্ট হল–মুগ্ধ হল, সেদিনই হল মনুষ্যত্বের উন্মেষ। সে থেকেই মানুষ্যত্বের ও সংস্কৃতি-সভ্যতার শুরু, কেননা সেদিনই মানুষ অনুভব করে তার মন বলে একটা আশ্চর্য বৃত্তি রয়েছে যার শক্তির ও সম্ভাবনার সীমা নেই।
অতএব মনুষ্যত্বের পরিচয় সৌন্দর্য-চেতনায় ও পিপাসায়। সংস্কৃতিরও অন্য নাম সৌন্দর্য চেতনা ও সৌন্দর্য-অন্বেষা। যা দেখতে শুনতে বলতে কুৎসিত, যা ঘৃণ্য, যা অকল্যাণকর তা-ই অসুন্দর–কাজেই পরিহার্য। যা-কিছু কাম্য, আকর্ষণীয়, চিত্তবিনোদক, তা-ই সুন্দর ও কল্যাণকর। সংস্কৃতিবান এই সুন্দর ও কল্যাণের সাধক। সংস্কৃতিবান জীবনের রূপদক্ষ শিল্পী। উপযোগের চেয়েও প্রয়োজনীয় এ সৌন্দর্য মানুষের জীবনে। তাই মানুষ কেবল উপযোগ সৃষ্টিতেই তুষ্ট থাকে না, সৌন্দর্য সৃষ্টিতেও তৎপর হয়। যেখানে প্রয়োজনের শেষ, সৌন্দর্যের শুরু সেখান থেকেই। তার কাজে ও কথায় এই সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্যেই ভাষায় সে উদ্ভাবন করেছে সুরের, ছন্দের, নানা ভঙ্গির ও অলঙ্কারের; আর কাজে এনেছে শৃঙ্খলা, সুষমা ও সামঞ্জস্য। .
স্থূল প্রয়োজন সহজেই মেটে। কিন্তু সৌন্দর্য-পিপাসার শেষ নেই। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে ও সমাজে ধর্মে-রাষ্ট্রে মানুষের এই বিচিত্র বিকাশের মূলে রয়েছে এ সৌন্দর্যবুদ্ধি। এই পিপাসাই মানুষকে এগিয়ে নিচ্ছে নব নব বিকাশের পথে–শ্রেয়সের সন্ধানে। পুরাতনে অস্বস্তি ও অবজ্ঞা না জাগলে নতুনের আকাক্ষা ও প্রয়াস জাগে না। মানুষের সংস্কৃতি ও সভ্যতা এই পিপাসা, অন্বেষা ও প্রয়াসের ফল।
সচেতনভাবে না হোক, অবচেতন প্রেরণায় কিংবা সহজাত বৃত্তিবশে সব মানুষই এই সৌন্দর্য সাধনায় নিরত। কেননা সমাজবদ্ধ প্রাণী হিসেবে এতে তার বিশেষ প্রয়োজন। কারণ সমাজে তার Personal life আছে, কিন্তু Private life নেই। তার গায়ে যদি সুগন্ধ থাকে তা অপরের চিত্ত প্রসন্নতার কারণ হয়, তার দেহে রূপ থাকলে তা অন্যের আকর্ষণ জাগায়। তেমনি তার শরীরে ঘা কিংবা দুর্গন্ধ থাকলে তা অপরের অস্বস্তি জন্মায়। এমনি করে তার হাসি-কাশি সবকিছুরই প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া রয়েছে অপরের জীবনে। অতএব চিন্তায়, কর্মে ও ব্যবহারে লাবণ্য সৃষ্টি করে অপরের কাছে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলা মানুষের জীবনের সামাজিক দায়িত্ব ও প্রয়োজন। অবচেতনভাবে তাই আমরা সবাই নিজেদের সুন্দর ও শোভন করে অপরের কাছে তুলে ধরবার প্রয়াসে নিরত। তা আমাদের দৈহিক লাবণ্য সাধন চেষ্টায়, পরিচ্ছদের পরিচ্ছন্নতায় ও সুবিন্যাসে এবং অপকর্ম ও মিথ্যা গোপনের প্রয়াসে প্রকট। তফাৎ এই–যাঁরা সূক্ষ্ম চেতনা ও মনীষাসম্পন্ন এবং সৃজনশীল, তারা নতুন নতুন উদ্ভাবনে নিজেদের ঋদ্ধ করেন। তারা যুগোত্তর মনীষী ও যুগস্রষ্টা। আর সাধারণেরা থাকে গতানুগতিক, অনুকারক ও অনুসারক।
অতএব মৌলিক সংস্কৃতি মাত্রই সৃজনধর্মী ও গতিশীল। এজন্যে সংস্কৃতি কখনো পুরোনো হতে পারে না। অনুকারক অনুসারকের গতানুগতিক ধারার সংস্কৃতি আসলে সংস্কৃতি নয়,– আচার। কেননা স্থিতিশীল সংস্কৃতি প্রাণের প্রেরণাহীন ও তাৎপর্য-বর্জিত আচারে কিংবা সংস্কারে অবসিত হয়। যেমন জাকাত দানের মূলে দুঃস্থ মানবপ্রীতি, প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যবুদ্ধি এবং সংবেদনশীল ব্যাকুল হৃদয়ের যে মানবিক প্রেরণা ছিল, তা আজ অবলুপ্ত। ফলে তা আজ একটি অনভিপ্রেত ধর্মীয় কর্তব্য–একটি যান্ত্রিক আচার মাত্র।
চিন্তায়, কর্মে ও আচরণে জীবনের সুন্দর ও শোভন অভিব্যক্তিই সংস্কৃতি। মৌলিক চেতনা ও চিন্তা যার আছে, সে প্রতিমুহূর্তে নিজেকে রচনা করে চলে। সে ক্ষণে ক্ষণে নিজেকে নতুনভাবে অনুভব করে– সে-অনুভবে সে তিলে তিলে নতুন হয়ে ওঠে এবং সৃষ্টি করে নিত্যনব পরিবেশ। তার কাছের মানুষকে চমক লাগানোর ও আকৃষ্ট করার মতো ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে তার। সংস্কৃতিবান কখনো অসুন্দরের সঙ্গে আপোস করতে জানে না। তার চিন্তা, কর্ম ও আচরণ অন্যায় ও অকল্যাণপ্রসূ নয়। আত্মসম্মানবোধ, সহিষ্ণুতা, যুক্তিনিষ্ঠা, উদারতা ও কল্যাণবুদ্ধি তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।