আরো দেখা যাক, মানবতার উপাসক ইংরেজের নৃশংসতা কী হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করিনি আমরা? সর্বপ্রকার শোষণ-অত্যাচার থেকে জনসাধারণকে মুক্ত করবার জন্যে এতকাল সাহিত্যে, সমাজে ও রাষ্ট্রে আন্দোলন করে আসছে যে প্রবুদ্ধ বাঙালি হিন্দু, আযাদী লাভের পর সে বাঙালি শাইকরাই গুলি চালায় ভুখ-মিছিলে। বহুনিন্দিত জমিদারি প্রথা কায়েম রাখার জন্যে তারাই। খুঁজছে আজ নানা ছলচাতুরীর আশ্রয়। পুঁজিবাদকে গালাগাল দেয় আর নিজেরাই পুঁজিপতি হবার সাধনায় করেছে আত্মনিয়োগ। উদার জাতীয়তাবাদের উদগাতা গান্ধী আর চিত্তরঞ্জনের স্বজাতি আজ ভিন্নধর্মাবলম্বীদের রক্তপাগল। মহাত্মা বলে পরিকীর্তিত ও পূজিত গান্ধী বেঁচে থাকবার অধিকার পেলেন না এই স্বজাতি ভক্তের দেশেই। মানবতা ও সাম্যবাদের ধ্বজাধারী রাশিয়া ও চীন অস্ত্রাঘাতে ধরাশায়ী করে মানুষের সাম্য প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী! কোরআনের অনুসারীরা আজ আচরণ, বিবর্জিত ইসলামি ধ্বজার বাহক হতেই উৎসুক। সুনীতির প্রবক্তারা চিরকালই কী এমন দুর্নীতির আশ্রয়েই পুষ্ট হতে থাকবে? তবু মানুষের প্রতি আস্থা হারাইনি আমরা। কেননা আমরা জানি, জনসাধারণের আসলের প্রতি আসক্তি আছে বলেই চিন্তাবিদ-বুদ্ধিমান প্রতারকেরা তাদের নাজেহাল করে নকল দিয়ে। ঠকে ঠকেও কী আসলে-নকলে পরখ করতে শিখবে না মানুষ? হাসির আশায়। আশায় শুধু কী কান্না নিয়েই থাকবে? চিন্তাশীল মানুষ কী সত্যিই পালকহীন পাখি? পাখির মতো বড় বড় বুলি মানুষ শুধু চিরকাল আওড়িয়েই চলবে হৃদয়ে তাদের মর্মার্থ ধারণ করবে না? তাদের স্বরূপ কী চেনা যাবে না? মানুষ কী চিরকাল হাস্য-সক্ষম ও মনন-সম্পন্ন জীবই থাকবে-হৃদয়বান। সহানুভূতিশীল মানুষ হয়ে উঠবে না? হাস্য-কাতর মানুষ কী হাসতে পারবে না? হাসির মরীচিকা দেখিয়ে দেখিয়ে সরল মানুষকে প্রতারিত করা হবে আর কতকাল? মানুষ হাসির অভিলাষী, তাই বলেই কী তাদের প্রতারণা ও মিথ্যা দিয়ে অশ্রুর লোনা দরিয়ায় ডুবিয়ে মারতে হবে? মানুষের সুখের সাধনা, শান্তির কামনা, সুন্দরের বাসনা কী সফল হবার নয়!
মানুষ! হায়রে হৃদয়হীন মননশীল মানুষ! মানুষের দুনিয়াকে বিষবাষ্পে আচ্ছন্ন করে রাখবে কতকাল, আর কতকাল! হায়–
এমন মানব-জমিন রইল পতিত,
আবাদ করলে ফলত সোনা!
সংস্কৃতি
এক কথায় Culture-এর কোনো সংজ্ঞা দেয়া চলে না। বলতে গেলে সবার গ্রহণযোগ্য কোনো সংজ্ঞাই দেওয়া সম্ভব হয়নি আজ অবধি। Culture-এর পরিভাষারূপে সংস্কৃতি কথাটা চালু হয়ে গেছে আমাদের ভাষায় এবং আমাদের আটপৌরে ব্যবহারে তা ঘরোয়া ও সহজবোধ্য হয়ে উঠেছে। আমরা মনে করি সংস্কৃতির স্বরূপ ও তাৎপর্য সম্বন্ধে আমাদের ধারণায় কোনো গলদ কিংবা অস্পষ্টতা নেই। তার কারণ সংস্কৃতি সম্বন্ধে আমাদের ধারণা স্বচ্ছ নয় বটে, কিন্তু লোকের সংস্কৃতিবানতা অনুভব করতে পারি। এ অনেকটা গঁড় দেখে হাতির ধারণা করার মতো। এজন্যে ব্যক্তিভেদে সংস্কৃতির সংজ্ঞা ও স্বরূপ বিভিন্ন।
আমাদের ভাষায় কৃষ্টি, সংস্কৃতি, তমদুন, তাহজীব, তমিজ, তরবিয়ৎ, সুরুচি, সৌজন্য, ভদ্রতা প্রভৃতি culture-এর পরিভাষা কিংবা স্বরূপ-লক্ষণ প্রকাশক প্রতিশব্দ প্রযুক্ত হতে দেখা যায়। কিন্তু এদের কোনোটিই পূর্ণাঙ্গ culture-এর প্রতিরূপ নয়, culture-এর খণ্ডাংশ মাত্র। অর্থাৎ এগুলোর প্রত্যেকটিই culture-এর অঙ্গীভূত, কিন্তু প্রতীক নয়, যেমন চোখ-কান-শুড়-লেজ-পা হাতির প্রত্যঙ্গ বটে, হাতি নয়। কেননা কোনো প্রত্যঙ্গেরই পূর্ণাবয়বের তথা হাতির স্বরূপের প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা নেই। কাজেই সংস্কৃতি সম্বন্ধে আমাদের ধারণা অন্ধ-হস্তী-ন্যায়-এর মতো সত্য বটে, কিন্তু সঠিক নয়। ফলে খণ্ডকে পূর্ণের মর্যাদা দানের বিড়ম্বনা ও বিভ্রান্তি ঘোচে না। এতেই আমরা সবাই নিজ নিজ ধারণায় অটল-অবিচল থাকবার যুক্তি ও সুযোগ পাই।
Culture বা সংস্কৃতি একটি পরিষ্ক্রত জীবন-চেতনা। ব্যক্তিচিত্তেই এর উদ্ভব ও বিকাশ। এ কখনো সামগ্রিক বা সমবায় সৃষ্টি হতে পারে না। এজন্যে দেশে কালে জাতে এর প্রসার আছে, কিন্তু বিকাশ নেই। অর্থাৎ এ জাতীয় কিংবা দেশীয় সম্পদ হতে পারে, কিন্তু ফসল হবে ব্যক্তিমনের। কেননা সংস্কৃতিও কাব্য, চিত্র ও বৈজ্ঞানিক আবিক্রিয়ার মতো স্রষ্টার সৃষ্টি। কৃতিত্ব স্রষ্টার বা উদ্ভাবকের। তা অনুকৃত বা অনুশীলিত হয়ে দেশে পরিব্যাপ্ত ও জাতে সংক্রমিত হতে পারে এবং হয়ও। তখন culture হয় সাধারণের সম্পদ ও ঐতিহ্য এবং পরিচিত হয় দেশীয় বা জাতীয় সংস্কৃতি নামে। যেমন হযরত মুহম্মদের জীবনে ও বাণীতে যে-সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটেছে, তা ই ইসলামী বা মুসলিম সংস্কৃতি নামে পরিচিত।
কাজেই একের পক্ষে যা real, অন্যদের কাছে তা ideal; একের পক্ষে যা স্বাভাবিক, অনুকারীদের কাছে তা-ই অনুশীলন-সাপেক্ষ ও কৃত্রিম। যেমন আনুগত্য, নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবোধ সৈন্যদের স্বােপলব্ধ নয়, তারা চাকরির শর্ত হিসেবে যান্ত্রিক পদ্ধতির অনুসারী মাত্র। কিন্তু যিনি বা যারা উপযোগ ও প্রয়োজন অনুভব করে নিয়ম-নিগড় উদ্ভাবন করেছেন, কৃতিত্ব তাঁদেরই। গাঁয়ের নিরন্ন, অজ্ঞ, অশিক্ষিত মজুরের তেমন লক্ষণীয় কোনো রুচিবোধ নেই। কিন্তু রুচিবান ধনীগৃহে বয়-বাবুর্চির কাজ নিয়ে মনিবের প্রয়োজনে তারা যে আদব-কায়দা, রান্না ও পরিবেশন পদ্ধতি শেখে তা তাদের মনিবের সংস্কৃতিরই অনুকৃতি। তেমনি দরজি, ওস্তাগার, সুতার, তাঁতি প্রভৃতি দেশের রুচিবান ধনী-বিলাসীদের পরিকল্পনা ও প্রয়োজনই রূপায়িত করে তাদের কাজে। তাজমহলের গৌরব তাই শাহজাহানের শ্রমিক ও শিল্পীদের নয়।