শিক্ষার প্রসারে অনুশীলনের প্রাচুর্যে মানুষের অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে নানাদিকে। বহির্জীবনে এবং মননে নব নব আবিক্রিয়া মানুষের মন ও মননকে একান্তভাবে বিজ্ঞানমুখী, যুক্তিনির্ভর ও বিবেকানুগত করে তুলেছে। বর্বর যুগে যে রঙিন চশমা মানুষ ও জগৎ জীবনের মধ্যে ব্যবধান বাঁচিয়ে রেখেছিল, তা হঠাৎ ঘুচে গেছে। জগৎ ও জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষ উপলব্ধি করছে আপন সত্তা, প্রত্যক্ষ করেছে ধূলামাটির দুনিয়াকে, চিনে নিয়েছে প্রবৃত্তি সমন্বিত জীবনের যথার্থরূপ। কল্পনা-ঘুড়ির সূতা ছিঁড়ে গেছে, ধসে গেছে সংস্কারের অন্ধকার গৃহের প্রাচীর। বহিরারোপিত বিশ্বাসকে বিতাড়িত করে তার জায়গা দখল করেছে যুক্তি ও যাচাই-নির্ভর প্রত্যয়। মানুষের মনুষ্যত্ব স্বীকৃতি পেল। আল্লাহ মানুষকে শক্তিও দিয়েছেন, সামর্থ্যও দিয়েছেন। ধর্ম-কলের প্রত্যঙ্গ নয়, মানুষ একটি সত্তা–আল্লাহ্র প্রতিনিধি-আল্লাহর প্রতিভূ স্রষ্টা! নিয়তি নেই, শুধু নিয়ম আছে। আর কারণ, নিরপেক্ষ কার্য অসম্ভব।
আল্লাহ শুধু দুনিয়ার অন্য যাবতীয় বস্তুর মালিক নয়, মানুষেরও মালিক। গোটা দুনিয়া সৃষ্টিরই (জড়-জীব) বিহার, বিলাস ও ভোগ ক্ষেত্র–শুধু মানুষের একার নয় এবং জড়-জীব পরস্পর নির্ভরশীল। অতএব, আদর্শ হোক–Live and let live (বেঁচে থাক এবং বাঁচতে দাও)। ধর্ম হোক–বিবেকের নির্দেশ ও যুক্তিবোধ।–আজকের মানুষের প্রাণের কথা এ-ই। অর্থাৎ এতদিন আমরা বহিরারোপিত ধর্মে চালিত হয়েছি। কিন্তু সমাজে সম্পদে আদর্শে বিশ্বাসে সংঘাত এড়াতে পারিনি। শান্তি দিইওনি, পাইওনি। এবার অন্তরাহৃত ধর্মের নির্দেশে চলা যাক! এবার সিদ্ধি সুনিশ্চিত, কেননা বিবেক প্রতারিত করে না। সুতরাং বহিরারোপিত ধর্মচালিত পূর্বযুগের মানুষের আচার-সংস্কার-আদর্শ-ঐতিহ্য প্রভৃতির প্রতি মোহ শুধু মানুষের মনের তমিস্রাকে গাঢ়তরই করবে। সেই অন্ধকারে মানুষের সহজ মনুষ্যত্ব শুধু পথ হাতড়িয়ে ব্যর্থ হবে, মুক্তি পাবে না। পূর্বযুগের গোত্রীয়, ধর্মীয় ও জাতীয় কারার বন্ধন থেকে মানুষকে আজাদ করে নীল আকাশের নিচে নরম মাটির উপর মহামিলনের মহায়োজন করাই হচ্ছে আজকের মানুষের একমাত্র উদ্যাপনযোগ্য ব্রত। মানুষের সংস্কৃতির, সাহিত্যের, সঙ্গীতের ও আদর্শের রূপ হবে একটি–তা মানবতা। সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। আজো যারা সাহিত্যে-সংস্কৃতিতে, ধর্মে-আদর্শে, সমাজে-সম্পদে স্বাতন্ত্রের কামনা-সাধনা করে তারা মানবতার শত্রু! কারণ– ধর্ম, সমাজ আর সংস্কৃতি মানুষের মনুষ্যত্ব সাধনার উপায় ও পন্থাস্বরূপ। এগুলো উপলক্ষ মাত্র–সিদ্ধি নয়, সুতরাং ব্যক্তির পরম ও চরম পরিচয় সে মানুষ। তার অবশ্য দেশ আছে, কাল আছে কিন্তু সে-সব তার পরিচয়বাহী নয়। যারা লক্ষ্য হারিয়ে উপলক্ষ নিয়ে লাঠালাঠি, মারামারি করে তারা শুধু হিন্দু, শুধু মুসলমান অথবা শুধু খ্রীস্টান- কিন্তু মানুষ নয়। মনুষ্যত্বের সাধনা তাদের নয় মানুষ হবার আকাঙ্ক্ষা তাদের নেই।
মানববিদ্যা
দূর অতীতে মানুষের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বিব্রত হয়ে পড়েছিলেন দুজন দার্শনিক। অবশেষে অনেক ভেবেচিন্তে একজন বলেন–মানুষ হাস্যময় জীব। অপরজন সংজ্ঞা দিলেন–মানুষ মননবৃত্তিসম্পন্ন জীব। এতকাল পরে আজ উপলব্ধি করছি, কেন এত শব্দ থাকতে তাঁরা হাস্যকর উক্ত শব্দদ্বয় বেছে নিয়েছিলেন মানুষকে চিহ্নিত করবার জন্যে! আমাদের মনে হয়, উক্ত দু-সংজ্ঞার সমন্বয় ঘটালে সম্ভব হয় মানুষ সম্বন্ধে পূর্ণাঙ্গ ও যথার্থ ধারণা করা। যেমন, মানুষ হাস্য ও মননবৃত্তিসম্পন্ন জীব। বোধ করি, এর থেকে মানুষের যথার্থ পরিচয় আর কিছু হতে পারে না। আরো একজন নৈয়ায়িক মানুষকে আখ্যাত করেছেন পালকবিহীন পাখি বলে। সে-কথা এখন থাক।
আমরা জানি–মানুষ কান্না এড়িয়ে বুকে-মুখে-নয়নে হাস্য ফুটিয়ে রাখবার জন্যেই চিন্তা করে আসছে চিরকাল। মানব-প্রচেষ্টার চিরন্তন ইতিহাসের সারমর্ম বা সংক্ষিপ্ত সার এই-ই। মানুষের মনে নির্ঘ নিঃশঙ্ক হাসি ফোঁটাবার জন্যে কালে কালে কত ধর্ম, কত ব্যবস্থা ও জ্ঞান-প্রজ্ঞা নীতিকথার প্রচার হয়েছে, ইয়ত্তা নেই তার। মানুষ যতই হাসবার চেষ্টা করেছে, ততই বেড়ে চলেছে মনন-চিন্তনের ক্ষেত্র, কিন্তু ফল স্থায়ী হয়নি কোথাও। মহামানবের মহৎ সাধনা যুগে যুগে বুদ্ধিমান ও স্বার্থলোভীদের ষড়যন্ত্রে হয়েছে পণ্ড।
হজরত মুসা এলেন আল্লাহর সুসমাচার নিয়ে; কিন্তু মানুষের মুখে হাসি ফুটতে-না- ফুটতে জগৎ-সংসার আচ্ছন্ন হয়ে গেল কান্নায়। হজরত ঈসা এলেন চোখের পানি মুছিয়ে মানুষকে আশ্বস্ত করবার জন্যে! কিন্তু মানুষ আশ্বস্ত হতে-না-হতেই চারদিকে আচ্ছন্ন করে দিল নৈরাশ্যের অন্ধকার। হজরত মুহম্মদ এলেন আল্লাহর শেষ বাণী নিয়ে। সে-বাণীর লাঞ্ছনা তো প্রত্যক্ষ করছি রোজ। তত্ত্ব ও তথ্যবিকৃত বলে নিন্দিত বাইবেলের অনুসারীদের মধ্যে যত মত-পথের সৃষ্টি হয়নি, অবিকৃত কোরআনের ধারকদের মধ্যে উদ্ভব হয়েছে তার শতগুণ বেশি ফেরকার।
শ্রীকৃষ্ণ চলার পথের নির্দেশ দিয়ে গেলেন গীতায়! চিন্তাশীলেরা পথ হারালেন বেঘোরে। বুদ্ধদেব এলেন, আশ্বস্ত হল মানুষ; কিন্তু কয়দিন? আচার্য শঙ্কর এসে আবার দিশা দিলেন শ্রেয়সের। কিন্তু কিছুতেই হবার নয় কিছু। এই হাসির জন্যে জগৎ জুড়ে কান্নার সে কি রোল! সুখের জন্যে দুঃখের দাহনে কী বীভৎস আত্মাহুতি। দুনিয়াব্যাপী সে কী নৃশংস হানাহানি, মারামারি আর গালাগালি। হাসি ফোঁটাবার অবকাশ এল না আর। সুদূর অতীতের ইতিহাস ঘেঁটে লাভ নেই। আরো আধুনিক নজিরও গ্লানিকর। সাম্য-ভ্রাতৃত্ব স্বাধীনতার-সন্তান নেপোলিয়ন সেদিন রক্তের বন্যা ডেকে এনেছিলেন য়ুরোপে। মানবতার পূজারী আব্রাহাম লিঙ্কন সেদিন নিহত হয়েছিলেন মনুষ্যত্বের ধ্বজাবাহীদের হাতেই। মানবাধিকারের এজেন্ট–সভ্যতাভিমানী আমেরিকায় নিগ্রো-নিগ্রহের অবসান হয়নি আজো। চোখের সামনে যা দেখছি আজ, তার খতিয়ানও যুগযুগান্তরের মনুষ্যসাধনার সকরুণ ব্যর্থতার মর্মান্তিক চিত্র বই তো নয়? Fraternity-র উদগাতা ফরাসিরা ইন্দোচীন ও আলজিরিয়ায় দেখিয়েছে অমানুষকিতার তাণ্ডবলীলা। তীব্র মানবতাবোধের অভিমানী ব্রিটিশের জ্ঞাতিগোত্র বর্বরতার প্রদর্শনী খুলেছে রোডেশিয়ায়, দক্ষিণ-আফ্রিকায়। ব্যক্তিসত্তায় বিশ্বাসী, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতার প্রচারক যে য়ুরোপ, সেখানে ফ্রয়েড, আইনস্টাইন আর রোমা রোলা হয়েছেন নির্যাতিত। বিশ্বশান্তির অছিলায় আমেরিকার কোরিয়া যুদ্ধ পরিচালনা, কোজে দ্বীপের কেলেঙ্কারি, ভিয়েতনামে বর্বর অভিযান প্রভৃতি হাজারো ব্যাপারে প্রমাণিত হচ্ছে মানুষ। চিন্তাবৃত্তিসম্পন্ন জীব, কিন্তু হৃদয়বান মানুষ নয়। এই মননশক্তি মানুষকে যুক্তির আশ্রয়ে শুধু হিংস্র লোভাতুর জীবে পরিণত করে রাখছে, দরদ ও বিবেক-নির্ভর মানুষে উন্নীত করছে না।