এজন্যেই আমাদের দেশ ভিন্ন, দুনিয়া এক; আমাদের জাত নানা কিন্তু জাতি এক। আমাদের রাষ্ট্র বহু কিন্তু শাসন-লক্ষ্য একটিই। আমাদের ভাষা বিচিত্র, ভঙ্গি একই। ভাব বহুধা কিন্তু বক্তব্য মূল অভিন্ন। আমরা সব জাত মিলে একমর্ত্যভূমিতে একজাতি। আমরা অপর জীবেতর মনুষ্যজাতি। আমাদের টিকে থাকার সংগ্রাম হবে জড় ও জীব জগতের বিরুদ্ধে; প্রকৃতি ও গ্রহলোকের বিরুদ্ধে। এজন্যে আমাদের হতে হবে সংহত ও সংঘবদ্ধ। এরূপে আমরা হব বিশ্বমানব। আমাদের সাধ্য-বিশ্বমানবতাবোধ ও উদ্বর্তন; কাম্য বিশ্বমানবতার স্বস্তি, শান্তি ও সুখ–যা সুন্দর হওয়ার ও সৌন্দর্য-সাধনার বাচ্যার্থে ও ব্যঙ্গ্যার্থে ফল ও কারণ দুই-ই। গত হয়েছে মণ্ডুকতা ও স্বাতন্ত্রের যুগ। আমাদের বুকে বিশ্বমানবতার স্বপ্ন ও সাধনা না জাগলে, মুখে বিশ্বমানবতার বুলি না ফুটলে, মনুষ্যজাতির দুর্দিনে-দুর্যোগ শুধু বাড়বেই। জাতীয়তাবোধকে আন্তরিকভাবে প্রসারিত করতে হবে আন্তর্জাতীয়তায়। নইলে নিষ্কৃতি নেই দেহ-মনের,–উদ্ধার নেই সঙ্কট থেকে। ইদানীং দেখা যাচ্ছে এ বোধের উন্মেষ। এই বৃহত্তর মানবরচতনায় একদিন সারা দুনিয়া সাড়া দেবে। সেদিন দূরে নয়; টিকে থাকার গরজে, স্বচ্ছন্দে বেঁচে থাকার অভিলাষে যেদিন আঞ্চলিক শাসন সংস্থার ব্যবস্থাভিত্তিক গোটা দুনিয়া পরিণত হবে এক রাষ্ট্রে। সেদিন দেশ, ধর্ম, জাত, বর্ণ নির্বিশেষে সব শুধু মানুষ নামে হবে পরিচিত। প্রাত্যহিক জীবনে যেমন একই সমাজে সাধারণ পরিচয়ে বর্ণ-বয়সের প্রশ্ন ওঠে না, তেমনি পরিচয়ে মা-বাপের দেওয়া নামটিই শুধু থাকবে অবলম্বন। লোপ পাবে আর সব ভেদ। সেই আভাসই পাওয়া যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের অসবর্ণ বিবাহে ও নিগ্রোদের আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে–তবু এ অলীক স্বপ্ন নয় কি?
বিশ্বের নাগরিক
মানুষের রুচি-প্রবৃত্তির বৈচিত্র্যে এবং বিবর্তনবাদে বিশ্বাস না করলে আজকের দিনে মানবসমাজের কোনো সমস্যারই সমাধান সম্ভব নয়। এমন একদিন ছিল যখন মানুষ ছিল সর্বব্যাপারে অজ্ঞ। অভিজ্ঞতা ও বৈজ্ঞানিক বুদ্ধির অভাব ছিল একান্ত। ফলে মনুষ্য- সাধারণের সর্বাত্মক জাগতিক ব্যাপারের বিধাতা ও নিয়ন্তা ছিল গোত্ৰাধিপতি নামের বিজ্ঞতর ব্যক্তি। সেকালে সে-অবস্থায় সর্বপ্রকার বিশ্বাসের এবং বিধান ও সমাধানের মূলে ছিল অপটু বুদ্ধি, অস্পষ্ট চিন্তা ও অন্ধ কল্পনা। সুতরাং সেকালে জনসাধারণের আচার-আচরণ ও বিশ্বাস-সংস্কারের উৎস ছিল বহিরারোপিত বিধি নির্দেশ–অন্তরাহৃত আস্থা নয়, বুদ্ধিলভ্য বোধিজাত উপলব্ধিও নয়। অতএব সেকালে মানুষ চালিত হত বহির্নির্দেশ জাত সংস্কারগত বিশ্বাসে– বিবেক লব্ধ বা নিরীক্ষিত প্রত্যয়ে নয়।
কালের অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষের বিবেকের বিকাশ হয়েছে, অভিজ্ঞতার পরিসর হয়েছে বিস্তৃততর, প্রত্যয় ক্রমে ক্রমে মন্থরগতিতে আঘাত হেনেছে সংস্কারলব্ধ বিশ্বাসের মূলে। কল্পনার অপরিসীম রাজ্য বাস্তববোধের প্রসারের সাথে সাথে সংকীর্ণতর হয়ে এসেছে। কিন্তু যেমনি করে বলছি, ঠিক তেমনি কিছু ঘটেনি। নতুন-পুরাতনের সংঘাত লেগেছে বারবার, বিপর্যেয় ঘটেছে মানুষের মনে, জীবনে ও আদর্শে। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বিস্তর, তবু লাভ হয়েছে প্রচুর, অগ্রগতি রয়েছে অব্যাহত–যদিও তা কখনো মন্থর, কখনো দ্রুত, কোথাও চরমে, আবার কোথাও বা পরমে, অর্থাৎ বিভিন্ন স্থানে বিচিত্র ধারায় তা গতি নিয়েছে।
কিন্তু অশিক্ষার প্রতিকূলতায় অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রবিশেষ প্রশস্ত হতে পারেনি আধুনিক-পূর্ব যুগে। কল্পনা-ঘুড়ির রঙিন সূতো তখনো আমাদের মনের মুঠোয়। বহিরারোপিত বিশ্বাস-সংস্কারের চশমার মাধ্যমে জগৎ ও জীবন তখনো পোশাকিরূপে আমাদের কাছে প্রতিভাত হয়েছে। সত্য ও মায়া, বুদ্ধি ও কল্পনা, কায়া ও ছায়া, বাস্তবতা ও আদর্শবাদ, প্রবৃত্তি ও নীতিবোধ প্রভৃতির চিত্তবিভ্রান্তকারী সংমিশ্রণে মানুষের জীবন স্বপ্ন ও রহস্যময় হয়েছিল। জাগর ও স্বপ্নের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা–আচ্ছন্ন মনের পক্ষে ছিল একান্ত দুঃসাধ্য। বাস্তবেতর বাস্তব, জগতের জগৎ, জীবনের জীবন, সুখ-দুঃখের সুখ-দুখ ধুলিমাটির দুনিয়াকে আর ভোগ-তৃষ্ণার দেহকে যথাযথভাবে স্বীকৃতি দিতে দেয়নি মানুষকে। তাই এতকাল, মানুষ শুধু ধর্মনির্ভর ছিল অর্থাৎ বহিরারোপিত বিধিনিষেধের পরিসরে বিচরণশীল ছিল। বিবেকের আহ্বানে, জীবনের সহজ চাহিদায় দ্বিধাহীনচিত্তে অকুণ্ঠ ও নিঃসংকোচ সাড়া দিতে সাহস পায় নি। ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা রয়েছে সে-কাহিনী। বঞ্চনা, ছল-চাতুরী, নরহত্যা, যুদ্ধ, নিপীড়ন, শাসন-শোষণ, আচার-বিচার-বিতর্ক, দান-সাহায্য, সত্য-মিথ্যা, হিংসা-দ্বন্দ্ব, ন্যায়-নীতি, লাভ-ক্ষতি সবকিছুই ব্যাখ্যাত, প্রচারিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়েছে ধর্মের নামে! এখানে আল্লাহ দণ্ডধারী মহাশাসক—-মানুষ ধর্মকলের প্রত্যঙ্গ (parts) বিশেষ। যা ঘটে আল্লাহই ঘটান, যা হয় এমনিতেই হয়। যুক্তি নেই, কার্যকারণ সম্পর্ক নেই। তবে নিয়মও আছে, নিয়তিও আছে। কিন্তু নিয়মের চেয়ে নিয়তির শক্তিই প্রবল।–এই বিশ্বাস-সংস্কারের আওতায় গড়ে উঠেছে আমাদের ধর্ম, সমাজ ও রাজ্য! এই ভিত্তিতেই পেয়েছি শিক্ষা, আদর্শবোধ এবং ন}য়-নীতি, পাপ-পুণ্য ও লাভ-ক্ষতির সংজ্ঞা। এখানে আছেন প্রভু আল্লাহ আর মানুষ বান্দা-~~ চালক আর চালিত, যন্ত্র আর যন্ত্রী। এখানে মানুষের আর কোনো পরিচয় নেই। আর একটুর আভাস আছে, তা হচ্ছে কলুর বলদের অবাধ্যতা–মানে প্রভুর নির্দেশে বাধা-চক্রে ঘুরপাক খেতে খেতে থেমে যাওয়া।