বাসনা-আসক্ত মানুষের দুর্বলতায় এর জন্ম। প্রাপ্তি লোভী মানুষ এ দুর্বলতা থেকে কখনো মুক্তি পাবে না। কেননা সে বাঁচতে চায়, নিরাপত্তা চায়, চায় সুখ-স্বস্তি-আনন্দ– যা তার আয়ত্তের মধ্যে নয়, সামর্থ্যের ভেতরে নয়। তাই অলৌকিক উপায়ে সে তার বাঞ্ছসিদ্ধি কামনা করে। তার আত্মপ্রত্যয়হীন অসহায়তার মধ্যেই সৃষ্টি-পালন-সংহার কর্তার স্থিতি। অতএব পার্থিব জীবনের কল্যাণ কামনায় ধর্মবিশ্বাসের উদ্ভব, সামাজিক-রাজনৈতিক প্রয়োজনে তার বিকাশ আর দুর্বলের স্বস্তি-কামনায় তার চিরায়ু। বিপদে-আপদে রোগ-শোকে অপ্রাকৃত শক্তির অদৃশ্য হস্তের করুণা তার চাই-ই। তা যুক্তিগ্রাহ্য নাই বা হল, নাইবা হল বাস্তব। জ্ঞানের দ্বীপে দাঁড়িয়ে অসীম অজ্ঞতা সমুদ্রের কী ধারণা করা যায়!
বিকাশের পথে মানবতা
ধর্মের নামে, দেশের নামে, রাষ্ট্রের নামে বা ভাষার নিরিখে কী পরিচয় হতে পারে মানুষের? দেশ, ধর্ম, রাষ্ট্র কী মনুষ্য-যাত্রার লক্ষ্য? জীবতাত্ত্বিক দৃষ্টি দিয়ে দেখলে সাপ-ব্যাঙ, মশা-মাছি, গরু-গাধার মতো মানুষও একশ্রেণীর জীব। বহু জীব অধ্যুষিত পৃথিবীতে মানুষ হচ্ছে অন্যতম জাত। কাজেই গোটা দুনিয়ার সব মানুষ মিলে অপর জীবেতর একটি শক্তিমান জাতি মাত্র। যেহেতু স্বভাবের অর্জনশীল শক্তি রয়েছে মানুষের মধ্যে, সেহেতু মানুষ প্রাকৃত জীব না হয়ে হয়েছে সৃজনশীল জীব। তার রয়েছে স্বসৃষ্ট জীবন। যেখানে স্বসৃষ্টি সেখানেই স্বকীয়তা–সেখানেই স্বাধীনতা। তাই সেখানেই স্বাতন্ত্র্য। আর স্বাতন্ত্র কিছুকে বা কাউকে জাতিভ্রষ্ট করে না, বিচিত্র করে মাত্র।
দেশ ধর্ম রাষ্ট্র মানুষের কাম্যবস্তু নয়; কাম্যকে–প্রেয় ও শ্রেয়কে পাবার উপায় মাত্র। লক্ষ্য আমাদের মনুষ্যত্ব। একে অর্জন করবার জন্যেই আর সব উপলক্ষের প্রয়োজন। মনুষ্যত্ব কথাটি বড় গলাভরা, বড় বৃহৎ শোনায়, আপাতদৃষ্টিতে মহৎও। তাই আরো ছোট করে বলা যাক। আমাদের সাধনা হচ্ছে জীবন-সাধনা অর্থাৎ আমরা জীবনকে অনুভব করতে চাই, উপলব্ধি করতে চাই, চাই উপভোগ করতে। জীবনকে সুন্দর করতে হয় এই ভোগের গরজেই, কেননা ভোগ্য হয় সুন্দর না হলে কুৎসিতে ভোগ নেই, যন্ত্রণা আছে মাত্র। অতএব জীবনকে সুন্দর করে রচনা করতে হলে চাই উপাদান, চাই ক্ষেত্র। সর্বোপরি চাই পরিকল্পনা। জীবন রচনার জন্যে প্রথমেই দরকার পদ্ধতির–সে-পদ্ধতি হচ্ছে প্রথমত নৈতিক নিয়ম, তার প্রসার ধর্মবিধিতে, তার আনুষঙ্গিক সমাজ-শাসন বা সংস্কার, আর তার পরিণতি রাষ্ট্রের কানুনে। এ সবকিছুর মিলিত প্রচেষ্টা হচ্ছে মনুষ্যত্ব অর্জন তথা জীবনকে সুন্দর করা। সুন্দর জীবন আর মনুষ্যত্ব একই কথা। জীবন রচনায় দেশ হচ্ছে ক্ষেত্র। স্বস্তিবিহীনতায় সম্ভব নয় জীবন-স্বপ্ন। স্বাধীনদেশ, অনুকূল পরিবেশ, সুনিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রব্যবস্থা, উদার ও যুক্তিনির্ভর ধর্মবিধি এবং সংস্কারমুক্ত সৌন্দর্যবুদ্ধি মনুষ্যসাধনাকে সফল ও সার্থক করে। তাই এগুলোর প্রয়োজন। মনুষ্যত্ব বা সৌন্দর্যবোধ অর্জনে চেষ্টা এবং সৌন্দর্য সৃষ্টির প্রয়াস বা সাধনা বা সৌন্দর্যনুগত্যই হচ্ছে সংস্কৃতি বা কৃষ্টি-সাধনা। সুরুচি বল, সংস্কৃতি বল সবকিছুরই প্রেরণা আসে সৌন্দর্য-পিপাসা থেকে এবং এ সবকিছুই সৌন্দর্য-উপাসনা। এর লক্ষ্য হচ্ছে সুন্দরকে নিজের মধ্যে পাওয়া। দেহে-মনে, বুকে-মুখে সুন্দর হওয়াই হচ্ছে সংস্কৃতি সাধনার চরম ফল–পরম পরিণতি। এ ফল প্রাপ্তি ঘটলেই একজন মানুষ হয় যথার্থই ভদ্রলোক তথা সুনাগরিক, হয় ধার্মিক। কেননা মর্যাদাবোধই ভদ্রলোকের প্রধান বৃত্তি বা guiding force।
সৌন্দর্য-বুদ্ধির প্রথম ফল আত্মমর্যাদাবোধের উন্মেষ বা জাগরণ। যার মর্যাদাবোধ আছে, কোনো অন্যায়-অপকর্ম করতে পারে না সে। অন্যায়-অপকর্ম হচ্ছে সৌন্দর্যবোধের প্রতিদ্বন্দ্বী ও সংহারক। এটিই সমাজে নিন্দনীয়, ধর্মে পাপ আর রাষ্ট্রে অপরাধ। এ-ই হচ্ছে একশব্দে দোষ–যা জ্ঞানের বৈরী, যা মনুষ্যত্ব তথা সৌন্দর্য-সাধনার পথে প্রবলতর বাধা। অন্যায়-অপকর্ম কি? যা একের আপাত সুখে ও স্বার্থে অপর মানুষের ধনে, জনে বা প্রাণে ক্ষতি আনে, তা-ই অন্যায় অপকর্ম। অতএব সংস্কৃতি-সাধনা মানে সৌন্দর্য সাধনা তথা মনুষ্যত্ব অর্জন প্রয়াস। এ একাধারে ও যুগপৎ ভদ্রলোক, সুনাগরিক ও ধার্মিক হওয়ার সাধনা। কাজেই দেশ, ধর্ম ও রাষ্ট্র মানুষের জীবন সাধনায় উপায় বা উপলক্ষ মাত্র–আদর্শ উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য নয়।
কাজেই যখন আমি বলি আমি হিন্দু, আমি খ্রীস্টান, আমি মুসলমান; তখন লক্ষ্যভ্রষ্টতার পরিচয় দিই আমি। কেননা হিন্দু, মুসলমান বা খ্রীস্টান হওয়া তো লক্ষ্য নয় আমার জীবনের। হিন্দুয়ানী, মুসলমানী বা খ্রীস্টানী নীতির (এগুলো প্রাত্যহিক জীবনযাপন পদ্ধতির এক-একটি System বা code) মাধ্যমে মানুষ হওয়া সুন্দর হওয়াই আমার লক্ষ্য। শুধু এটুকু বলা যায় যে, জীবনযাত্রায় আমার পাথেয় ইসলামী বা হিন্দুয়ানী বা খ্রীস্টানী মতাদর্শ ও পদ্ধতি। কোনো পদ্ধতিই পরিণতির পরিচিতি হতে পারে না, বড়জোর পরিণামের ইঙ্গিত দিতে পারে মাত্র। তার মধ্যে গুণগত তারতম্য সম্ভব এবং স্বাভাবিক। সুতরাং উৎকর্ষ-অপকর্ষের বিচারও চলতে পারে হয়তো। অতএব মানুষে মানুষে, নীতি ও পদ্ধতিতে, পথ ও পাথেয়তে, মতে ও মননে পার্থক্য থাকলেও লক্ষ্য সেই এক–জীবনকে সুন্দর করে রচনা করা; জীবনে সৌন্দর্যকে উপলব্ধি ও উপভোগ করা। পথ ভিন্ন, পদ্ধতি নানা কিন্তু কাম্য এক, তীর্থ অভিন্ন। প্রাপ্তির স্বাদও অভিন্ন।