কৌতূহলী মানুষের অনবরত অনুশীলনের ফলে জ্ঞানের পরিধি গেছে বেড়ে। বৈজ্ঞানিক অবিস্ক্রিয়ায় বিজ্ঞান বুদ্ধি হয়েছে প্রবল। অজ্ঞতার অরণ্যের ফাঁকে ফাঁকে পড়েছে জ্ঞান ও যুক্তি-সূর্যের ঝলমলে আলো। অলৌকিকতার বিস্ময়জাত আকর্ষণ গেছে কমে। ভোগ্যসামগ্রী হয়েছে বহুবিচিত্র। পৃথিবী হয়েছে অনেক বড়। মনের দিগন্তের প্রসার হয়েছে অসীম। অভিলাষ হয়েছে গণনচুম্বী। বুভুক্ষু গরু যেমন চারণভূমির উন্নতশীর্ষ কচি-নধর ঘন ঘাস অনন্যচিত্তে অনবরত গিলতে থাকে, ভোগ্যবস্তুর আধিক্যে লুব্ধ এবং বৈচিত্র্যে মুগ্ধ আজকের মানুষও একান্তই ভোগকামী হয়ে উঠেছে। সেজন্যে একদিকে দেও-দানো-হুঁরপরী যেমন সে ছেড়েছে, অন্যদিকে তেমনি পরিহার করেছে সংস্কার। অস্বীকার করেছে সমাজ ও শাস্ত্রবিধি। বৈরাগ্য ও ত্যাগের মহিমা হয়েছে ম্লান। আজকের পৃথিবীতে প্রাণ মেতে উঠবার, আবেগ উথলে উঠবার কারণ রয়েছে অনেক। এভাবে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলে গেছে বলে এ-যুগে ধর্ম আর প্রবর্তিত হয় না। ধর্মান্দোলন কিংবা ধর্মবিপ্লবের মাধ্যমে নেতৃত্বও মেলে না। তাই সে পথ হয়েছে পরিত্যক্ত। ভোগকামী মানুষের চিত্তহরণের নবতর পন্থাও হয়েছে আবিষ্কৃত। সে-পথেই জনচিত্ত জয় করে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা অর্জন সম্ভব। ধন-বণ্টন নীতি ও শাসন রীতি সম্পর্কিত নব নব পরিকল্পনা তৈরি করে, সম্পদ উপভোগ তত্ত্বের চমকপ্রদ ব্যাখ্যা দিয়ে, কিংবা দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকার তত্ত্বের মানস অনুশীলন-লব্ধ যুক্তিবুদ্ধি-অনুগ বিশ্লেষণ-চাতুর্যে জনমন মুগ্ধ করে, দেশে কালে ও সমাজে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব লাভ অসাধ্য নয় আজও। আগে যা ধর্মের নামে পাওয়া যেত, আজ তা Ism-এর দোহাই দিলে মেলে। লক্ষ্য ও ফল অভিন্ন। কেবল পরিবর্তিত পরিবেশে নতুন পদ্ধতি ঠাই নিয়েছে, কলাকৌশলের রূপান্তর ঘটেছে।
আসলে গোড়া থেকেই মানুষ এ জীবনকেই চরম বলে জেনেছে, এ পৃথিবীকেই ভালোবেসেছে। পার্থিক জীবনকে নির্ধ-নির্বিঘ্ন করবার জন্যেই জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা-বাঞ্ছায় মানুষ জাদুতে বিশ্বাস রেখেছে, দেও-দানো-ভূত-প্রেত মেনেছে, দেবতা এবং অপদেবতার পূজা করেছে, গড়েছে সমাজ ও শাস্ত্র। কল্পনা করেছে ইহ ও পরলোকে প্রসারিত জীবন। স্বীকার করেছে আত্মার অস্তিত্ব ও ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব। সৃষ্টি করেছে ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পুণ্য, নিয়ম-নীতি-সত্যের ধারণা। এই জীবনের প্রয়োজনই কর্মপ্রচেষ্টা ও ধর্ম-প্রেরণার ভিত্তি। এ কারণেই ভূতে ও ভগবানে মানুষের বিশ্বাস ও বিশ্বাসের উৎস অভিন্ন। ক্ষতি স্বীকারে অনিচ্ছুক বাঞ্ছসিদ্ধিকামী অসমর্থ মানুষ কাকেও অবহেলা করতে পারে না। জানে না কিছুই তাচ্ছিল্য করতে। চিরন্তন সুখ-লোভী, দুঃখ ভীরু মানুষ তাই স্বর্গের স্থায়ী সুখের লোভে স্বল্পকালীন পার্থিব জীবনের বঞ্চনা-দুঃখকে সহজে বরণ করার নির্বোধ প্রয়াসেও তৃপ্ত। আবার অসংযত অপরিণামদর্শী মানুষ সমাজের নিন্দা, রাষ্ট্রের শাসন ও পাপের শাস্তি অবহেলা করে বিধি-বহির্ভূত কাজ করে এই সুখের লোভেই।
এজন্যেই আদিম জাদুবিশ্বাস থেকে আধুনিক বিজ্ঞানবুদ্ধি অবধি মানুষের সব বিস্ময়, কল্পনা, চিন্তা ও জ্ঞানের সম্পদ মানুষ সযত্নে লালন করেছে, কিছুই পরিহার করেনি। সীমিত শক্তির মানুষ কোনোটাই তুচ্ছ বলে হেলা করে না। তুকতাক-দারু-টোনা, মন্ত্র-তন্ত্ৰ-পূজা-অর্চনা প্রভৃতি থেকে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া অবধি তার কাছে সবকিছুর সমান মূল্য-মর্যাদা। সে গরজ বুঝে সবকিছু সমভাবে কাজে লাগায়, সমান আগ্রহে মেনে চলে। এজন্যেই জগৎ ও জীবন ব্যাপারে তার মননে ও সিদ্ধান্তে, ধ্যানে ও ধারণায় কোনো যৌক্তিক পারম্পর্য নেই কার্যকারণ বোধের অবিচ্ছিন্ন সূত্র নেই। এ কারণেই তার মুখের বুলি আর বুকের বিশ্বাসে ঐক্য নেই। উক্তিতে ও আচরণে কোনো সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায় না। জীবনের প্রয়োজনেই সে সৃষ্টির মূলে– জগৎ ব্যাপারে দ্বৈততত্ত্ব মানে। ভালো-মন্দ (dualism-good & evil) শক্তির টানাপাড়নে যে জগদযন্ত্র বোনা, এর দ্বারা যে মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রিত, তা সে জরথুস্ত্রীয়দের মতোই বিশ্বাস করে। যদিও তার উচ্চমার্গের মননশক্তির মহিমা ক্ষুণ্ণ হবে বলে, সূক্ষ্মচিন্তার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে আশঙ্কায়, তা সে উচ্চারণ করে না। তাই মানুষ মুখে বলে আল্লাহর হুকুম ছাড়া বালিও নড়ে না, আবার অপকর্মের জন্যে ব্যক্তিবিশেষকে দায়ী করে। সে বলে–বিপদ থেকে আল্লাহ রক্ষা করেছেন। কিন্তু বিপদে ফেলেছিল কে?–সে-প্রশ্ন উচ্চারণ করতে সাহস পায় না। কেউ বলে–দুঃখ দিয়ে, যন্ত্রণা দিয়ে, রোগ-শোক দিয়ে আল্লাহ পরীক্ষা করছেন! কিন্তু সে-পরীক্ষা কেন, কিসের জন্যে, তাতে আল্লাহর লাভ ও উদ্দেশ্য কি, এ পরীক্ষার নিয়ম কি, মান কি? কশাইখানায় রোজ এত পশু অকালে প্রাণ হারায় কোনো অপরাধে? রোজ কোটি কোটি ডিম জ্বণ নিহত হয় কোনো পাপে? এ কার পরীক্ষা? এসবের উত্তর নেই। সবটা মিলে একটা মস্তবড় গোঁজামিল, এক বিরাট ফকির ফাঁদ, একটা সাজানো অপরূপ মিথ্যা, এক গোলকধাঁধা–দিশাহারা মানুষ কেবলই দিশা পাওয়ার জন্যে আলোর। কামনায় অন্ধকারে ছুটাছুটি করছে! এরই নাম অন্তর্জীবন লীলা। এ এক মায়ার খেলা। এর রূপ রস-জৌলুস মোহ জাগায়। এক আনন্দিত উন্মুখতায় জীবন কেটে যায়। এজন্যেই ধর্মবোধের মৃত্যু নেই।