জ্ঞান-বুদ্ধি ও নৈপুণ্যের বৃদ্ধিতে ক্রমে বুনো-মানুষ উৎপাদনে ও পশু-লালনে জীবিকার ব্যবস্থা করল। তখন মানুষ কৃষিনির্ভর আর পশুজীবী। তখন প্রকৃতি ও পরিবেশই কেবল তার প্রতিপক্ষ নয়, উৎপাদন ক্ষেত্রের ও চারণভূমির সীমাবদ্ধতা এবং সামর্থ্যের পরিমিতি মানুষকেও করে তুলল মানুষের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। তখন ঈর্ষা-দ্বেষ কাড়াকাড়ি-হানাহানি হয়ে উঠল পারস্পরিক। তখন মানুষের সংগ্রাম দ্বিমুখী হলেও মানুষই প্রথম নম্বরের শত্রু বলে বিবেচিত হল। ফলে জাদুবিশ্বাস তো রইলই, তার উপর জগতে ও জীবনে নতুনতর তত্ত্বও হল আরোপিত। দুর্বলের নিরাপত্তা ও সান্ত্বনার জন্যে এবং সবলকে সংযত ও শৃঙ্খলিত রাখবার প্রয়োজনে কল্পিত হল ইহ-পরলোকে। প্রসারিত জীবন ও আত্মার অমরত্ব। রচিত হল অপৌরুষের শাস্ত্র। এই অভিনব উপায় উদ্ভাবিত হল গোত্র ও সমাজ শাসনের প্রয়োজনে। উদ্ভাবন করলেন যাঁরা, তাঁরা একাধারে জ্ঞানী এবং অধ্যাত্মবুদ্ধিসম্পন্ন। এ এক অদ্ভুত ফাঁদ যা জানবার বুঝবার কিংবা এড়াবার সাধ্য নেই কারো। কেননা বিশ্বাসে এর দিশা মেলে না, আবার বুদ্ধি ও জ্ঞানে এর ওর পাওয়া ভার।
এ শাস্ত্র জাগাল ন্যায়-অন্যায় বোধ এবং তজ্জাত পাপ-পুণ্যের ধারণা। এ পাপ-পুণ্যের ফল পরলোকে তো বটেই, ইহজীবনেও সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্যের কারণ হতে পারে। আবার এ ন্যায়-অন্যায় স্থান-কাল-পাত্রভেদে বিচিত্র। সবল ও দুর্বলের ন্যায়-অন্যায় অভিন্ন নয়! তিন টাকা দিয়ে কেনা গোলাম তার ত্রিশপুরুষ অবধি দেহ-মন ও মনুষ্যত্ব দিয়ে মালিকবংশের সেবা করলেও তিন টাকার ঋণ শোধ হয় না কেন, কিংবা ত্রিশ টাকা দিয়ে কেনা জমিতে তিনশ বছর গতর খাঁটিয়েও কৃষকের দাবী প্রতিষ্ঠিত হবে না, অথচ ত্রিশ টাকায় পাওয়া স্বত্ব অক্ষয় হয়ে থাকবে কেন–এ প্রশ্ন সে বোধের অন্তর্গত নয়। আবার রাজায় কেড়ে নেওয়াতে দোষ নেই, সামান্য লোকের কেড়ে খাওয়াতে বা চুরিতে পাপ কেন–সে-জিজ্ঞাসা হয়েছে অবান্তর বিবেচিত। সবলের পরিপূর্ণ সুবিধা-সুযোগের জন্যেই এ শাস্ত্র সবলপক্ষের তৈরি।
এই শাস্ত্র গোত্র-শাসন উদ্দেশ্যেই মূলত রচিত। সে উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু তা সমস্যা হয়ে দেখা দিল পরে, যখন নিঃসম্পর্কীয় গোত্রগুলো জীবন-ধারণের প্রয়োজনে সহযোগিতার নামে পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এল এবং একক দেবতা বা স্রষ্টার নামে ঐক্য স্থাপনের উদ্দেশ্যে তথা গোত্রীয় স্বাতন্ত্র্য-চেতনা লোপ করার প্রয়াসে অভিন্ন আদর্শভিত্তিক সমাজ গড়ার চেষ্টা হল। কেননা ইতিমধ্যে স্ব স্ব আচার-সংস্কার, নিয়মনীতি ও শাস্ত্রজবোধ গোত্রীয় ঐতিহ্যে ও মানস-সম্পদে পরিণত হয়েছে। পার্থিব আর আর ধন-জন-সম্পদের মতো এও প্রিয় ও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। এভাবে এটি যখন গোত্রীয় মর্যাদার ও গৌরবের প্রতীক হয়ে দেখা দিল, তখন দলে টেনে দল ভারী করার লোভে এর উৎকর্ষ ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনের মানবপ্রবণতাও পষ্ট ও সক্রিয় হয়ে উঠল। একের উৎকর্ষ ও শ্রেষ্ঠত্ব দেখাতে হলে অপরের অপকর্ষ প্রমাণ করতে হয়। নিন্দা থেকে দ্বন্দ্বের শুরু; বিরোধের পরিণামে বাধল সংগ্রাম। ধর্মীয় সে-কোন্দলের আজো ইতি ঘটেনি। একে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে সমাজ, সম্প্রদায় ও জাতি। বিলুপ্ত হয়েছে গোত্রবোধ। আজো সমাজে-ধর্মে-জাতে রাষ্ট্রে ধর্মই নিয়ন্ত্ৰীশক্তি, বিদ্বেষ-বিরোধের উৎস, জীবন-প্রচেষ্টার নিয়ামক, প্রীতি-সম্ভাবনার অন্তরায়। এর সঙ্গে সামান্য-অর্থে তুলিত হতে পারে এ-যুগের অর্থনীতি। দ্রব্য বিনিময় রীতির অসুবিধে দূর করার জন্যে চালু হল মুদ্রা। সমস্যার সহজ-সরল-সুন্দর সমাধান! সে-ব্যবস্থার অলক্ষিত-অভাবিত জটিলতায় আজ মানুষের দেহ-মন-আত্মা জলাবদ্ধ। ধনী-নির্ধন সমভাবে পীড়িত তার অদৃশ্য পাশ-বেষ্টনে। এ এক মায়াফাঁদ–ছাড়া যেমন অসম্ভব, সহ্য করাও তেমনি আত্মপীড়নের নামান্তর।
কালে কালে মানুষের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বোধি-বুদ্ধির প্রয়োগে ও পরিচর্যায় তত্ত্বে ও তথ্যে, চিন্তায় ও চিন্ময়তায়, উপলব্ধি ও অনুভূতির ঐশ্বর্যে, যৌক্তিক বিশ্লেষণের ঔজ্জ্বল্যে, তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার সূক্ষ্মতায় মানুষের শাস্ত্র বিপুল ও বক্র, বিচিত্র ও বর্ণালি হয়েছে। কিন্তু মৌল আদর্শে ও লক্ষ্যে কোনো বিবর্তন আসেনি। কেবল যখন জনচিত্তে স্বধর্মের গর্ব ও অনুভূতির উষ্ণতা মন্দা হয়েছে, তখন পুরোনো বুলির চমক-লাগানো নব-উচ্চারণে কেউ কেউ সমাজে সংসারে সহজ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। অথবা কোনো বাকপটু ব্যাখ্যার মারপ্যাঁচে জনমন ধাধিয়ে পুরোনো ধর্মের প্রশাখা কিংবা উপশাখা সৃষ্টি করে দেশকালের নেতৃত্ব পেয়েছেন। ন্যায়-নীতি সত্য-সদাচারের নামে সবাই কেবল বিভেদ বিদ্বেষ-বিরোধের কারণ বাড়িয়েছেন, ব্যবধানের প্রাচীর তুলেছেন, ঐক্য ও অভিন্নতার বুলি আওড়িয়ে খণ্ডের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছেন। মিলন-ময়দান তৈরির নামে খাদই খনন করেছেন বেশি। অবস্থা এমন যে, সন্ধির শর্তালোচনার জন্যে দাঁড়াবার ঠাইটুকু যেন আর অবশিষ্ট নেই।
আগের দিনে জীবন-যাপনের উপকরণ ছিল স্বল্প ও বৈচিত্র-বিরল। ঋজু জীবনের একঘেঁয়েমির মধ্যে বিচিত্র অভিলাষ জাগিয়ে প্রাণের উত্তেজনা-উৎসাহ বাড়ানোর উপায় ছিল না। জীবনধারণের কোনো দৃষ্টিগ্রাহ্য মান ছিল না জনগণের। ডাল-ভাত নয়, শাক-ভাত নয়–নুন ভাতেও তৃপ্তি মিলত। তাদের মনের দিগন্ত ছিল সংকীর্ণ, তাতে মন-বলাকা অভিলাষের পাখা মেলার কল্পনাও করেনি। গৃহাশ্রিত হাঁস-মুরগির মতো কেবল কুটিরের চারধারেই দেহ-মনের খাদ্য খুঁজত। তৃপ্তি পেত খণ্ড ও ক্ষুদ্রের তুচ্ছ সাধনায়। বিপুল পৃথিবী, মনুষ্যত্বের বিরাট সম্ভাবনা তাদের থাকত অজ্ঞাত। বহু বিচিত্রভাবে প্রসারিত-পরিব্যাপ্ত জীবনের প্রসাদ লাভের স্বপ্নও জাগেনি মনে। তা তারা রেখে দিয়েছিল রাজপুত্রের অধিকারে। তাই বেকার মনের অবলম্বন হয়েছিল সমাজ, সংস্কার, শাস্ত্র ও স্বার্থ। তুচ্ছকেই উচ্চ করে ধরে তারা জীবনে স্বস্তি ও উত্তেজনা খুঁজেছে। পরশ্রীকাতরতা আর পর-পীড়নের মধ্যেই পেয়েছে প্রাণের সাড়া। ভূত-প্রেত, দেও-দানব, জীন পরী-হুঁর কিংবা বিদ্যাধরী-অন্সরা রচনা করেছিল তাদের মনের কোণে প্রীতি-ভীতির অপরূপ জগৎ। সে-জগতের প্রভাব ছিল তাদের প্রাত্যহিক জীবনে। তাদের বাহ্য আচরণে ও মানস অভিব্যক্তির মধ্যে দেখা যেত সে-জগতের ছায়া।