সাংস্কৃতিক শুচিতার কথামাত্রই অবান্তর। কেননা সংস্কৃতি বদ্ধকূপের জিয়েল মাছ নয়। সংস্কৃতি বহতা নদীর স্রোত। প্রতিদিনের সূর্যের সঙ্গে তাল ঠুকে চলার নামই সংস্কৃতিপরায়ণতা। তাই সংস্কৃতি কখনো অবিমিশ্র হতে পারে না, গ্রহণে-সৃজনেই তার স্থিতি ও বহমানতা। বিকাশমানতাই সংস্কৃতি। সুন্দর ও কল্যাণকে প্রতিমুহূর্তে অনুভব করা, উদ্ভাবন করা, আবিষ্কার করা, জীবনে গ্রহণ করা ও ফুটিয়ে তোলাই সংস্কৃতি। যে সৃজন করতে পারে না, গ্রহণ করেই তাকে সংস্কৃতি চালু রাখতে হয়। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে শুচিবাই সংস্কৃতিবিমুখতার অন্য নাম। সৌন্দর্যচেতনা, কল্যাণবুদ্ধি, সৃজনশীলতা অন্তত গ্রহণশীলতা সংস্কৃতিপরায়ণতার লক্ষণ। To know all is to pardon all- তত্ত্বে উত্তরণই সংস্কৃতিপরায়ণ লোকের চরম লক্ষ্য।
সুস্থ ও স্বস্থ জীবন ও মননের বৈশিষ্ট্যই এই। ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিবিম্ব ধারণেই ঘট-জীবনের তুচ্ছতা এড়ানোর একমাত্র উপায়। নিজের সত্তার স্বাতন্ত্র রক্ষা করেও বসুধৈব কুটুম্বকম তত্ত্বের উপলব্ধি করাই মনুষ্যজীবনের লক্ষ্যহীনমন্যের আত্মসংকোচনে নয়। এ বিশ্বেরে দেখি তার সমগ্র স্বরূপে। ছন্দ নাহি ভাঙে তার সুর নাহি বাধে। স্বাতন্ত্রের মধ্যে, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যবোধ এভাবেই আসে। আত্মবিলোপে বিশ্ববোধ জন্মায় না, আত্মোপলব্ধিতেই চিত্তশুদ্ধি সম্ভব। কেননা আমি আছি বলে বিশ্ব আছে, অতএব নিজের সত্তার সঙ্গে বিশ্বের সম্পর্ক স্থাপনই জীবনের লক্ষ্য। নইলে জীববোধে আসে বিকৃতি। জীবনের প্রসাদ থাকে অজ্ঞাত। তখন এক পাশব প্রাণের ভার বয়ে জীবন হয় অনর্থক অবসিত। যদি আমরা বুঝতাম যে–এ দেহ-প্রাণ এক মহৎ শিল্পের ইজেল, তা হলে।
ধর্মবুদ্ধির গোড়ার কথা
মানুষের জ্ঞান সীমিত কিন্তু অজ্ঞতা অসীম। অজ্ঞতা থেকেই ভয়, বিস্ময় ও কল্পনার উদ্ভব। যা জানিনে, যা বুঝিনে তা জানবার-বুঝবার আগ্রহ থেকেই কল্পনার প্রসার। আদিম অজ্ঞ মানুষের জীবন ছিল ভয়, বিস্ময় ও কল্পনাশ্রিত। ফল ও মৃগয়াজীবী মানুষের সংখ্যাধিক্যে খাদ্যবস্তু যখন দুর্লভ হতে থাকে, তখন বাঞ্ছসিদ্ধির আত্যন্তিক কামনা মানব-মনে এক অদৃশ্য তৃতীয় শক্তির জন্ম দেয়। এর নাম জাদুবিশ্বাস। অভাব ও অতৃপ্তি বোধ থেকে উদ্ভূত হয় পাওয়ার বোধ। এর নাম কামনা বা আকাঙ্ক্ষা। অভাব-অতৃপ্তি মিটানোর জন্যে জাগে প্রাপ্তির ইচ্ছা। এই ইচ্ছার অভিব্যক্তি প্রচেষ্টারূপে শারীরক্রিয়ায় পরিণত হয়। এর নাম কর্ম। কিন্তু কর্ম মাত্রই সফল হয় না। তাই মানুষের অভাব মিটে না–সব প্রয়োজন সিদ্ধ হয় না। ব্যর্থতায় বিক্ষুব্ধ অসহায় মানুষ তাই কল্পনা করেছে অরিশক্তি ও মিত্রশক্তি-ইষ্টদেবতা ও অপদেবতা। জাদুবিশ্বাসে তাই দেখতে পাই ইষ্ট ও অরি দেবতার উপস্থিতি, তাদের দ্বন্দ্ব, তাদের হার-জিৎ। জীবনধারণের পক্ষে যা-কিছু প্রতিকূল তা-ই মন্দ আর যা কিছু অনুকূল তা-ই-ভালো। ভালো-মন্দ ধারণার ভিত্তি এ-ই। তাই ভালো-মন্দের সর্বজনীন চিরন্তন কোনো রূপ নেই। সত্যবোধও হচ্ছে ভালোমন্দ প্রসূত। তাই সত্যেরও কোনো একক রূপ স্বীকৃত নয়। কেননা ভালো, মন্দ ও সত্য আপেক্ষিক ধারণা– অনপেক্ষ নয় (relative, absolute নয়)। উপযোগই ভালো, মন্দ ও সত্যের মাপকাঠি। তাই কলা পাকলে হয় খাদ্য, বেগুন পাকলে হয় অখাদ্য। রাজায় বা রাজাদেশে কাড়লে-কাটলে দোষ নেই, পাপ নেই। কিন্তু ব্যক্তিক জীবনে তাই যুগপৎ vice, crime ও sin–সমাজে অন্যায়, রাষ্ট্রে অপরাধ, ধর্মে পাপ।
জাদুবিশ্বাস-অনুগ আচার-আচরণই মানুষের আদিম ধর্ম। যেহেতু বুনো ফল-মূল ও মৃগজীবী মানুষের বাঞ্ছাসিদ্ধিই এর লক্ষ্য, সেজন্যে এ-ধর্ম মানুষে মানুষে কোনো বিভেদ, বিদ্বেষ ও দ্বন্দের কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি। কেননা তখন প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে করে টিকে থাকাই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। যেখানে আত্মশক্তির তথা বাহুবলের শেষ, সেখানেই জাদুবিশ্বাসের উদ্ভব, সেখান থেকেই জাদুনির্ভরতার শুরু। মিত্রশক্তির আবাহনে অরিশক্তির বিতাড়নই ব্রত। আদিম মানবের অবোধ বাসনা চরিতার্থ করবার অক্ষম প্রয়াসে সৃষ্ট হয় প্রাকৃত শক্তির কাল্পনিক অনুকৃতিজাত তুকতাক-দারু-টোনা-মন্ত্র-তন্ত্র। ভাগ্য বা অদৃষ্টতত্ত্ব এ স্তরের বোধের দান।
কল্পিত তত্ত্বজিজ্ঞাসা প্রবর্তনা দেয় নিষ্ক্রিয় নিরীক্ষায় ও সক্রিয় পরীক্ষায়। এর থেকে অর্জিত হয় অভিজ্ঞতা। একের দেখে-জানা অভিজ্ঞতাই হয় অপরের শুনে-পাওয়া জ্ঞান। ক্রমে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান বাড়তে থাকে। কালে জ্ঞানে-বিশ্বাসে সংস্কার হতে থাকে জটিল ও বহুধা। কালের চাকা ঘুরছে অনবরত আর মানুষের জ্ঞান-বিশ্বাস-সংস্কারও হচ্ছে জটিলতর। বিশ্বাসের পরে এল জ্ঞান। তবু বিশ্বাসও রইল, জ্ঞানেরও ঠাই হল। জ্ঞান যুক্তির জনক। যুক্তি সংস্কার ভাঙে। বিশ্বাস সংস্কারকে প্রবল করে। যুক্তির আশ্রয় জ্ঞান বুদ্ধি, বিশ্বাসের প্রশ্রয় ভীরু মানুষের দুর্বলতায়, লোভী মানুষের অক্ষমতায়। যদিও বোধের থেকে বোধি, তা থেকে বুদ্ধির উন্মেষ, আর জ্ঞান বোধির যোগে আসে প্রজ্ঞা, তবু এর মধ্যে একটি প্রত্যয়স্বল্প অস্থির মানস-স্তর রয়েছে, যার ফলে জ্ঞান ও বিশ্বাসের মিশ্রণে গড়ে উঠে অধ্যাত্মবুদ্ধি, যা সুবিধেমতো কখনো জ্ঞানবাদী, কখনো বিশ্বাসপন্থী। এ বুদ্ধি এক অপার্থিব রহস্যলোক সৃষ্টি করে। ইহলোকে এ আলো-আঁধারির অস্পষ্টতা কখনো ঘুচবার নয়। কারণ অজ্ঞতা অসীম এবং জ্ঞানে অজেয়। তাই ইবনে রুশদ যখন বলেন– শাস্ত্র হচ্ছে সাধারণের জন্যে, আর জ্ঞানীর জন্যে প্রয়োজন দর্শনের, তাতে কোনো ইতর-বিশেষ হয় না। কারণ ফল ও প্রভাব অভিন্ন থেকে যায়। কেননা দুটোই কল্পনাপ্রসূত এবং পরিণামে সংস্কার-রূপেই স্থায়িত্ব পায়।