গ. দেশীয় শ্রুতি-স্মৃতি অনুসারে ধান্যবতীর রাজারা ৭৮৮ সনে বৈশালীতে রাজধানী করেন। এ থেকে অনুমান করা অসঙ্গত হবে না হয়তো যে ধান্যবতীর রাজা বৈশালী রাজ্য দখল করে এখানেই রাজধানী করলেন এবং পূর্ববর্তী স্থানীয় রাজাদের অনুকরণে চন্দ্র বাচীও নামের সঙ্গে যুক্ত করলেন। সম্ভবত ধান্যবতীর রাজা গোটা চন্দ্র রাজ্য জয় করতে পারেননি। তার উত্তরাংশে স্লোহ অঞ্চলে চন্দ্রদের পরপুরাস্থ সামন্ত রাজা মহাবীর স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে থাকেন। অথবা পরপুরা তাঁর নবাৰ্জিত রাজ্যেরও শাসনকেন্দ্র হয়।
ঘ. পালি-সাহিত্যের নিদ্দেস-উক্ত পুরেঙ্গুর> পরপুর> পুরপুর, Ptolemy র বরকুর ইবন বক্তৃতার বরকান, কুতুবদিয়া ও আকিয়াবের মধ্যস্থিত কোনো বন্দর। কাজেই পরপুর, বৈশালী, Hkrit, পিনসা, পেরিন ও ম্রোহঙ-এর নিকটবর্তী হওয়ারই কথা।
ঙ. মহাবীর বা তার পরবর্তী রাজা বজ্রশক্তি বংশীয়দের রাজধানী কোথায় ছিল, তা স্তম্ভলিপি থেকে কিংবা মুদ্রা থেকে জানা যায় নি। বৈশালী ছাড়া উক্ত চারস্থানের যে-কোনো একটা অথবা পরপুরা এদের রাজধানী ছিল বলে মনে হয়।
চ. বজ্রবিক্রমের পরবর্তী রাজারা চট্টগ্রামের তথা সমতটে কতেকাংশ স্বাধিকারে এনে ছিলেন মনে হয়। দশম শতকে আরাকানে যখন এদের শাসনাধিকার লুপ্ত হয়, তখনো চট্টগ্রাম অঞ্চল এ বংশীয়গণের করতলে ছিল সম্ভবত। বৈশালীর রাজা চূড়সিংহচন্দ্র (Chulataing Chandra) হয়তো এমনি কোনো শূরচন্দ্র রাজা থেকে চট্টগ্রামের অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। আরাকানী ইতিহাসে ইনিই হয়তো গুরতান (শূরচান> শূরচান্দ), যাকে আরাকান রাজসভায় বাঙলা সাহিত্য গ্রন্থে (আরব) সুলতান (পৃ. ২-৩) বলে অভিহিত করা হয়েছে। কেউ কেউ থুরতন নামটি রাজ্যজ্ঞাপক বলে মনে করেন, তারা থুরতন অর্থে ত্রিপুরা রাজ্য বুঝেছেন।
ছ, ধর্মে ও সংস্কৃতিতে, সংস্কৃতের ব্যবহারে, নাগরী হরফের প্রয়োগে, চুণ্ডাদেবীর প্রতিষ্ঠায় ও মহাযানমতের প্রাবল্যে সমতট ও আরাকানে কোনো পার্থক্য ছিল না। বৃষ শঙখ ও লাঞ্ছনাও তাদের অভিন্ন ছিল।
জ, তাই মনে হয়, সমতটের চন্দ্ররা সম্ভবত আরাকানের চন্দ্রদেরই জ্ঞাতি ছিল। ওখানে চন্দ্রদের অধিকার লুপ্ত হওয়ার পরেও এঁরা এখানে এগারো শতকের প্রথমপাদ অবধি টিকে ছিলেন। সময়ের দিক দিয়েও প্রায় মিলে যায়। এ বংশের প্রথম রাজা বলে অভিহিত পূর্ণচন্দ্র সম্ভবত প্রথম রাজা নন; পূর্ণচন্দ্র-সুবর্ণচন্দ্র ও ত্রৈলোক্যচন্দ্র গড়ে ৪৪/৪৫ বছর ধরে রাজত্ব করতে থাকলে ৭৮৮ খ্রস্টাব্দ থেকে এরা সমতটে কখনো সামন্ত, কখনো বা স্বাধীন রাজা হিসেবে রাজত্ব করেছেন বলে অনুমান করবার যুক্তি আছে।
ঝ. লামা তারানাথও (জন্ম ১৫৭৩, গ্রন্থ সমাপ্তি ১৬০৮ খ্রী:) এক চন্দ্রবংশের উল্লেখ করেছেন : বৃক্ষচন্দ্র, বিগমচন্দ্র, কামচন্দ্র (হর্ষবর্ধনের সময়ে বঙ্গরাজা ছিলেন) সিংহচন্দ্রের (হর্ষপুত্র শীলের কালে) প্রপৌত্র, বালচন্দ্রের পৌত্র বিমলচন্দ্রের পুত্র গোপীচন্দ্র চট্টগ্রামে রাজত্ব করতেন। তিনি ছগল বলে এক রাজার নামও বলেছেন। আবার ববলা সুন্দর ও তার পুত্র চন্দ্ৰবাহন আদির নাম করেছেন। এতগুলো নাম নিছক কল্পনাপ্রসূত না হওয়ারই কথা, মনে হয় এরা চট্টগ্রামে সাধারণ বা সামন্ত শাসক ছিলেন। উপরোক্ত চন্দ্ররা আরাকানের অথবা সমতটের চন্দ্রদের প্রতিনিধি হওয়াও বিচিত্র নয়। বিশেষ করে আনন্দ চন্দ্রের স্তম্ভলিপির প্রথম নাম হীরানন্দ শাস্ত্রীর মতে বালচন্দ্র। ৪৫ এর পাঠোদ্ধার Johnston করেননি।
.
০৮.
১। সমতট
এলাহাবাদে প্রাপ্ত সমুদ্রগুপ্তের স্তম্ভলিপিতেই প্রথম সমতটের উল্লেখ পাই। একে গুপ্ত সাম্রাজ্যের এক সীমান্তে করদরাজ্য বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বৃহৎসংহিতায় সমতট ও বঙ্গকে পৃথক অঞ্চল বলে নির্দেশ করা হয়েছে৪৬ Ctunningham–এর মতে সমতট গঙ্গার বদ্বীপ যশোর, Ferguson ও Watters–এর মতে ফরিদপুর ও ঢাকা।
সাত শতকে হিউএনৎসাঙ সমতট রাজ্যকে কামরূপের দক্ষিণস্থ নিম্ন ও আর্দ্রভূমি বলে বর্ণনা করেছেন। এবং তাঁর মতে রাজ্যের আয়তন ৩০.০০০ লি ( প্রায় ৭০০ মাইল) এবং রাজধানীর আয়তন ২০ লি (প্রায় ৪ ২/৩ মাইল)। ইৎসিঙ তার পর্যটনকালে রাজভট্টকে সমতটের রাজা দেখেছিলেন। নারায়ণগঞ্জে আঁশরফপুরে প্রাপ্ত তাম্রলিপিদ্বয় এঁরই পিতা দেব খড়েগর। কুমিল্লায় প্রাপ্ত সর্বাণীমূর্তি লিপিতে এঁর পূর্ব রাজাদের নাম আছে। সমতটের আদি রাজধানী ছিল কারমান্তা, এটি কুমিল্লা জেলার আধুনিক (বর) কামতা গ্রামে ছিল। এখানে রাজধানীসুলভ নিদর্শনাদি এখনো বর্তমান। এক পাণ্ডুলিপিতে প্রাপ্ত লোকনাথের আলেখ্য পরিচিতিতে চাম্পিতলাকে (কুমিল্লা জিলায়) সমতটের অন্তর্ভুক্ত বলা হয়েছে। পূর্ববঙ্গে সমতটে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর কয়েকজন স্বাধীন নরপতি রাজত্ব করেন। কোটালিপাড়ার পাঁচখানি ও বর্ধমানের একখানি তাম্রলিপি ও মুদ্রা থেকে তিনজন রাজার নাম পাওয়া যায়। এঁরা গোপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য ও সমাচার দেব। এঁরা ষষ্ঠ শতকের প্রথমার্ধে রাজত্ব করতেন। হিউএন সাঙ যখন সমতট পর্যটন করেন, তখন তিনি সেখানে ত্রিশটি সঙঘারাম ও দুহাজার ভিক্ষু দেখেছিলেন। এবং জৈনাদি সর্বধর্মের লোকের বাস ছিল ও শতেক মন্দির শোভা পেত। হিউএন সাঙের শিক্ষক নালন্দার অধ্যক্ষ শীলভদ্র সমতটের রাজকুমার ছিলেন। ইসিঙ (৬৭৩-৮৭) বলেছেন সমতটরাজ বৌদ্ধ ছিলেন, তার নাম রাজভট্ট। এই রাজভট্ট খড়গ-বংশীয় রাজা দেবখঙ্গের পুত্র। দেবখঙ্গ জাতখঙ্গের আর জাতখঙ্গ খদ্মেমের পুত্র। রাজভট্ট যদি সপ্তম শতকের শেষপাদে রাজত্ব করে থাকেন তাহলে খঙ্গোদ্যম ষষ্ঠ শতকের শেষপাদে সমতটের রাজা ছিলেন। হিউএন সাঙের মতে শীলভদ্র ও কামরূপ রাজ ভাস্করবর্মণ ব্রাহ্মণ ছিলেন। ডক্টর ভট্টশালী বলেছেন, বর্মণ যদি ব্রাহ্মণের কুলবাচী হয়, তাহলে খড়াও ব্রাহ্মণ হতে বাধা নেই এবং খঙ্গ সন্তানের রাজভট্ট নামও এ অনুমানের পরিপূরক। আশরফপুর তাম্রলিপির প্রমাণে খঙ্গদের আমলে সমতটরাজ্য নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সমতট শশাঙ্কের সময়ও স্বাধীন ছিল কেননা, হিউএন সাঙ (৬৩৮ খ্রী.) শীলভদ্রকে সমতটের রাজবংশীয় বলেছেন। আর হিউএনসাঙ ও ইৎসিঙ সমতট রাজ্য প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ইসিঙের। সহচারী শেঙচি রাজা রাজভট্টের নামও করেছেন। ইৎসিং দেববমের (দেব খঙ্গ?) রাজ্যে শ্রীগুপ্ত প্রতিষ্ঠিত চীনা-চৈত্য দেখেছিলেন।