চ. ধর্মপালের আমলে চট্টগ্রাম হয়তো স্বল্পকালের জন্য পালশাসনভুক্ত হয়।
ছ, উত্তরকালীন চাটিগাও নামের উৎপত্তির অনেকগুলো অনুমিত উৎসের মধ্যে চিত্ত গঙ্গ ও শাৎ-ই গাঙ–এ দুটো বেশি নির্ভরযোগ্য ও যুক্তিসহ।
জ, সুপ্রাচীনকাল থেকেই সিন্ধু এবং গঙ্গা–এ দুটোই সুপরিচিত প্রধান নদী। অন্যগুলো এ দুটোর শাখা-প্রশাখা রূপেই পরিগণিত। ফলে উত্তর-পশ্চিম ভারতে সিন্ধু এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে গঙ্গার উল্লেখই বেশি পাই বিদেশীর রচনায়। এজন্যে আমরা দেশী লোকেরা নদী নির্ণয়ে বিভ্রান্ত হই। চট্টগ্রামের পাশেই গঙ্গা বঙ্গোপসাগরে পড়ত। এ উক্তি থেকে তিনটে ধারণা করা সম্ভব। এক. সেকালের গঙ্গা বর্তমানে গতি পরিবর্তন করেছে। দুই. মেঘনা বা পদ্মকে গঙ্গা নামে অভিহিত করা হয়েছে। তিন. মেঘনা বা পদ্মও গতিপরিবর্তন করে চট্টগ্রাম থেকে দূরে সরে এসেছে।
ঝ. খ্রীস্টোত্তর দশম-দ্বাদশ শতকে চট্টগ্রাম সমতটের সঙ্গে প্রশাসনিক সূত্রে ঐক্যবদ্ধ হয়। অবশ্য সাময়িক বিযুক্তি যে ঘটেনি তা নয়। আর এর আগে তিনদিকে পর্বত ও একদিকে সাগর-বেষ্টিত আরাকান ও চট্টগ্রাম একটি একক অঞ্চল ছিল বলে অনুমান করা চলে।
.
০৭.
আমরা দেখেছি, পর্বত ও সাগরবেষ্টিত চট্টগ্রাম একটি প্রাচীন ভূখণ্ড। এর সঙ্গে আরাকানের সম্পর্কও সুপ্রাচীন। প্রকৃতপক্ষে আরাকান ও চট্টগ্রাম একই ভূখণ্ড। মধ্যে কেবল পর্বতমালার ব্যবধান। এই দুরতিক্রম্য বাধাই উভয় অঞ্চলে অভিন্ন গোত্রীয় জনবসতির অন্তরায় ছিল। তাই চট্টগ্রামে অস্ট্রিকাদি জনগোষ্ঠীর বসতি অধিক। আর আরাকানে দেখছি, ভেট চীনা গোত্রীয় কিরাত-জাতীয় লোকের আধিক্য। দুর্লঙ্ পর্বতবেষ্টিত বলেই আরাকান ব্ৰহ্মদেশ থেকেও বিচ্ছিন্ন ছিল। ফলে আরাকানের রাষ্ট্রীয় স্বাতন্ত্র ও নিরাপত্তা অক্ষুণ্ণ রাখা সম্ভব হয়েছিল অনেক কাল।
তবু আরাকান অঞ্চলের শাসক গোষ্ঠীর এবং আভিজাত্যকামী জনগণের মাগধী-ঐতিহ্যপ্রীতি ধর্মসূত্রে উত্তরভারতীয় সাংস্কৃতিক প্রভাব স্বীকারের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। এর থেকে আমরা বুঝতে পারি প্রায় দু হাজার বছর আগে হিন্দু-বৌদ্ধ জনসমষ্টি তাদের ভাষা, লিপি, ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে এ পার্বত্য অঞ্চলে প্রবেশ করে এবং অপেক্ষাকৃত অনুন্নত স্থানীয় জনগণকে ভারতীয় ধর্ম সংস্কৃতিতে দীক্ষা দান করে।
যদিও সমগোত্রীয় বলে চট্টগ্রামবাসীরা ধর্মে, ভাষায় ও সংস্কৃতিতে উত্তরভারতীয় জাতীয়তা স্বীকার করে নিল, তবু রাষ্ট্রীয় অভিন্নতা সাধন সম্ভব হয়নি অনেককাল। এর মুখ্য কারণ সম্ভবত ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা।
এখনকার বাঙলাদেশের মধ্যে উত্তরবঙ্গের রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্যই প্রাচীনতম, রাঢ় অঞ্চলও প্রাচীন। কিন্তু সেখানকার জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক কিংবা রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য সুপ্রাচীন নয়। মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে দেখি– ব্যাধ গোহিংসক জাতিতে চোয়াড়। কেহ না পরশ করে লোকে বলে রাঢ়। এবং জৈন বৌদ্ধ গ্রন্থেও রাঢ়বাসীর নিন্দা রয়েছে।
এই উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে চট্টগ্রামের যোগ বিশেষ ছিল বলে মনে হয় না। কেননা সমতট ( Plain coastal land) অঞ্চল সম্ভবত সাগরগর্ভ থেকে গড়ে ওঠে অনেক পরে। হুএনৎসাঙ কিংবা ইৎসিঙের বর্ণনাসূত্রে জানতে পাই যে সমতট অঞ্চলে দিগন্তবিসারী হাওড় বা জলাভূমি ছিল। খ্রীস্টীয় প্রথম শতকের গোড়ার দিকে (১৮-২৪ খ্রী.) পর্যটক স্ট্রাবোও লোনা জলের। উপদ্রব দেখেছিলেন। কাজেই এ অঞ্চল জনবিরল থাকাই সম্ভব।
উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে এই ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার ফলেই হয়তো চট্টগ্রাম মৌর্য, গুপ্ত কিংবা পাল শাসনভুক্ত হয়নি। এ সুযোগে সভ্যতা-সংস্কৃতির ক্রমবিকাশে চট্টগ্রাম-সংলগ্ন . আরাকানের সুপ্রতিষ্ঠিত রাজশক্তি চট্টগ্রামে স্বাধিকার বিস্তার করে। এ অধিকার পরে সমতট অবধি পরিব্যাপ্ত হয়। আনন্দচন্দ্রের স্তম্ভলিপিতে, ময়নামতীর চন্দ্ররাজাদের ঐতিহ্যে, পগারাজ অনারঠার আরাকান-পাটিকের-এ আধিপত্য লাভের ইতিকথায় কুবলাই খার বাহিনীর সঙ্গে Mien ও বাঙালি সৈন্যের যুদ্ধের উল্লেখে, পাট্টিকের রাজকন্যার সাথে পগারাজ অলংসিথুর বিয়ের বর্ণনায় এবং পাটিকের রাজপুত্রের পগারাজকন্যার পাণি প্রার্থনার কাহিনীতে আমাদের অনুমানের সমর্থন মেলে।
আরাকানী রাজ-ইতিবৃত্ত রাজোয়াঙে (রাজবংশ) চট্টগ্রামের ইতিহাসের কিছু উপাদান রয়েছে। এজন্যে আরাকানী ইতিবৃত্তের আলোচনা প্রয়োজন। রাজোয়াঙ সূত্রে জানা যায় এক চন্দ্রসূর্য আরাকানের চন্দ্র রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি খ্রীস্টীয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যভাগে ধন্যবতীতে রাজত্ব করতেন। তার বংশধরেরা সূর্যাধিপতি–সূর্যপ্রতিপদ-সূর্যরূপ-সূর্যমণ্ডল-সূর্যবর্ণ সূর্যউষ্ণ-সূর্যনাথ-সুর্যবন্ত–সূর্যবন্ধু-সূর্য কল্যাণ–সূর্যমুখ্য-সূর্যতেজ-সূর্যপুণ্য-সুর্যকলা-সূর্যপ্রভা সূর্যসিক্ত-সূর্যতীর্থ–সূর্যবিমল-সূর্যসেন-সূর্যগ্রন্থ–সূর্যস্বর্গ–সূয়শী সূর্যক্ষিতি-সূর্যকূট-সূর্যকেতু নাম নিয়ে ৭৮৮ খ্রীস্টাব্দ অবধি রাজত্ব করেন। তারপর বৈশালীতে (Wesali) ৭৮৮ থেকে মহাসিংহ চন্দ্র-সূর্য সিংহচন্দ্র-মৌলসিংহচন্দ্র, পুরসিংহচন্দু কালসিংহচন্দ্র, বসিংহচন্দ্র, শ্রীসিংহচন্দ্র, তীক্ষ্ণসিংহচন্দ্র, চূড়সিংহচন্দ্র প্রভৃতি ৯৫৭ খ্রীস্টাব্দ অবধি রাজত্ব করার পর মিউগোত্র প্রধান অম্যহতু সিংহাসন দখল করেন। তার পুত্র মেপিউ (Yepyu) থেকে চূড়সিংহের সন্তান সিংহাসন ছিনিয়ে নেন। চুড়সিংহের ভ্রাতুস্পুত্রের সন্তান Hkittathin, Pyinsa- কেই রাজধানী করেন। এখানে ১০১ থেকে ১১০৩ খ্রীস্টাব্দ অবধি এ বংশের রাজধানী থাকে। তারপর এ বংশেরই রাজা Letyminnau ১১০৩ কিংবা ১১১৮ সনে Parin কে রাজধানী করেন। এখান থেকে। ১১৬৭ সনে এই বংশের Minousa, Hkrit শহরে রাজধানী স্থাপন করেন। এ বংশের Misuthin Pyinsa–কে আবার রাজধানী করেন ১১০৮ খ্রীষ্টাব্দে। ১২৩৭ সনে Laungyet-এ রাজধানী হয় এবং ১৪৩৩ সন থেকে ১৭৮৫ সনে বর্মী বিজয় অবধি Mrohaung বা Mrauku ই শাসনকেন্দ্র ছিল। তালিকা অনুসারে দেখা যায় চন্দ্ৰসূর্যের বংশধরেরাই প্রায় ১৬৫০ বছর ধরে রাজত্ব করেন। অবশ্য মাঝেমধ্যে তারা সাময়িকভাবে ক্ষমতাচ্যুতও হয়েছেন। এই তালিকার সঙ্গে আনন্দচন্দ্র প্রদত্ত তালিকার মিল নেই। আনন্দচন্দ্রের উৎকীর্ণ লিপিতে প্রাপ্ত পূর্ব রাজাদের অস্তিত্বেও সন্দেহ করা যায় না। কেননা, এর মধ্যকার কোনো কোনো নামের মুদ্রা মিলেছে। তাহলে আমাদের অনুমান করতে হবে, কোনো এক বংশ গোটা আরাকান অঞ্চলে উপর (Yoma পর্বতসীমা অবধি) সব সময় রাজত্ব করেনি। কেন্দ্রীয় শাসন-শৈথিল্যের সময় বিভিন্ন সামন্ত স্বাধীনভাবে বংশপরম্পরায় রাজত্ব করেছেন। রাজধানী পরিবর্তনের কারণ হয়তো এ-ই। সম্ভবত ধান্যবতী ও বৈশালী বা অন্যত্র একই সময়ে অর্থাৎ ৩৭০ খ্রীস্টাব্দ থেকে চন্দ্রবংশীয় দুটো শাখা স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে থাকেন। এবং ৭৮৮ সনে হয় ধান্যবতী শাসকেরা (Phayre ও Harvey-র তালিকা অনুসারে) বৈশালী রাজ্যের শাসনভার প্রাপ্ত হয়ে স্থানীয় পূর্ববর্তী রাজাদের মতো চন্দ্র বাচী গ্রহণ করেন, অথবা এ সময়ে বৈশালীর চন্দ্ররা ধান্যবতী রাজ্য জয় করে গোটা অঞ্চলের অধিপতি হন।