খড়গদের পরেই সমতটে চন্দ্রবংশীয়রা রাজত্ব করেন। এঁদের রাজধানী ছিল প্রথমে পাটিকের ও পরে বিক্রমপুর। দশ ও এগারো শতকের প্রথমার্ধ অবধি সমতটে চন্দ্ররাজারা রাজত্ব করেন। চন্দ্র রাজারা আরাকানী রাজাদের জ্ঞাতি হলে, এসময় চট্টগ্রাম চন্দ্ররাজাদের অধিকারে ছিল বলে অনুমান করা সম্ভব। বিশেষ করে লামা তারানাথ বলেছেন গোপচন্দ্র চট্টগ্রামেই (জ্বালনধারায়) রাজত্ব করতেন এবং সাতশতকেও হিউএনৎসাঙ চট্টগ্রামকে সমতট রাজ্যভুক্ত দেখেছেন। চন্দ্ররাজাদের প্রথম রাজা পূর্ণচন্দ্রের রাজধানী ছিল রোহিতগিরি (লালমাই, কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত)। তার পুত্র সুবর্ণচন্দ্রও লালমাইতে রাজত্ব করতেন। সুবর্ণচন্দ্রের পুত্র ত্রৈলোক্য চন্দ্র (আনু. ৯০০-৯২৯ খ্রী.) শক্তিমান হয়ে চন্দ্রদ্বীপ অধিকার করেন। এ সময় থেকে সমতটের চন্দ্ররাজারা বঙ্গেরও এক অংশের শাসক হলেন। ত্রৈলোক্যচন্দ্রের পুত্র শ্রীচন্দ্র দিগ্বিজয়ী ছিলেন, তিনি প্রাগজ্যোতিষপুররাজকে পরাজিত করেন আর গৌড়রাজ গোপালকে সিংহাসনে পুনর্বহাল করেছিলেন। রাজ্যসীমা বিস্তৃত হওয়ায় তিনি বিক্রমপুরকে রাজধানী করে রাজত্ব করতে থাকেন (আনু ৯২৯-৯৭৫ খ্রী.) তাঁর পুত্র কল্যাণচন্দ্র (৯৭৫-১০০০) তাঁর পুত্র লড়হচন্দ্র (১০০০-১০২০) এবং তার পুত্র গোবিন্দচন্দ্র (১০২০-১০৫০) রাজত্ব করেন। তিরুমালাই শিলালিপির প্রমাণে রাজা রাজেন্দ্রচোল ১০২১-২৩ খ্রীস্টাব্দে বাঙলার রাজা গোবিন্দচন্দ্রকে পরাজিত করেন। মদনপুর, ঢাকা, ভাড়েলা ও পাইকপাড়ায় প্রাপ্ত যথাক্রমে শ্রীচন্দ্র, কল্যাণচন্দ্র, লড়হচন্দ্র ও গোবিন্দচন্দ্রের তাম্র ও মূর্তিলিপির আলোকে তিরুমালাইর শিলালিপি ভিত্তি করে চন্দ্ররাজাদের প্রায় নিশ্চিত আনুমানিক রাজত্বকাল নির্ণিত হয়েছে। গোবিন্দচন্দ্রের পরে সমতট পালরাজ্যভুক্ত হয় এবং মহীপাল (১০৮০-৮৪) বাঘাউরা শিলালিপির প্রমাণে সমতটেরও অধিপতি ছিলেন। সম্ভবত সমতটে পাল অধিকার স্বল্পস্থায়ী ছিল।
চন্দ্রদের পরে বর্মণরাই সমতটের শাসনভার প্রাপ্ত হন।৩১ এরা রাঢ় অঞ্চলের সিংগুর বা সিংজোর (সিংহপুর) নগরে রাজত্ব করতেন বলেই কোনো কোনো পণ্ডিতের মত। ডি সি গাঙ্গুলীর মতে সিংহপুরা পূর্ববঙ্গের কোথাও অবস্থিত এবং এটি বর্মণ রাজাদের শাসনকেন্দ্র ছিল।
ভোজবর্মণের বেলাব ( Belava) তাম্র শাসনের আলোকে অনুমান করা চলে যে বজবৰ্মণের পুত্র জাতবর্মণ এই রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা।৩৩ তৃতীয় বিগ্রহপাল ও জাতবর্মণ কর্ণের কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন। কাজেই বিগ্রহপাল ও জাতবর্মণ সমসাময়িক। জাতবর্মণ এগারো শতকের তৃতীয় পাদে রাজত্ব করতেন। জাতবর্মণের পরে তার ছেলে হরিবর্মণ এবং পৌত্র ভোজবর্মণ এবং তার পরে জাতবর্মণের অপর পুত্র সামল বর্মণ রাজা হন। এরপর সমতট সম্ভবত সেন-অধিকারভুক্ত হয়। সেনেরা ও বর্মণেরা ব্রাহ্মণ্যবাদী ছিলেন। পালেরা ও চন্দ্ররা ছিলেন বৌদ্ধ। এক রণবঙ্কমলহরিখেলদেবও (১২০৪-২০) সমতটে স্বাধীন নরপতি ছিলেন। তার এক তাম্রশাসন মিলেছে। এবং পাটিকের বৌদ্ধবিহারে ভূমিদানই এর বিষয়।৩৪
বর্মণদের পরে সমতটে দেববংশীয়রাই সম্ভবত রাজত্ব করেন। পুরুষোত্তম দেবের পুত্র মধুমথনদেবই প্রথম রাজা। তাঁর পুত্র বাসুদেব ও তাঁর পুত্র দামোদরদেব ও তাঁর পুত্র (?) দশরথদেব।
এ বংশের দামোদর দেবের (সিংহাসন আরোহণ ১২৩৯ খ্র.) তাম্রশাসন মেহের (১২৪৩) ও চট্টগ্রামে (১২৪৩) মিলেছে। দশরথদেবের তাম্রশাসন মিলেছে আদাবাড়িতে। দশরথ বিক্রমপুর থেকে তার তাম্রশাসন প্রদান করেছেন, তাতে মনে হয় কেশব সেনাদি সেন-সামন্তদের রাজ্যও তিনি অধিকার করেছিলেন। দামোদর দেব অন্তত ১২৪৩ সন অবধি রাজত্ব করেন।৩৫ মিনহাজ বলেছেন লক্ষ্মণ সেনের বংশধররা ১২৪৫ কিংবা ১২৬০ সন অবধি রাজত্ব করেন। অতএব দশরথ দেব তার পরই বিক্রমপুর জয় করে থাকবেন।
মর্কো পোলো বলেছেন, ত্রয়োদশ শতকের শেষপাদে (১২৭১-৯৫) মিয়েন (Mien) ও বাঙলার সঙ্গে কুবলাই খার সৈন্যের যুদ্ধ হয়। ১০৪৪-৭৪ খ্রীস্টাব্দে পগারাজ অনরঠার রাজ্যের উত্তরপূর্ব সীমা ছিল পাষ্টিকের। কাজেই চট্টগ্রাম তখন অনরঠার রাজ্যভুক্ত ছিল। এর বংশধর নরসিংহপতি (Narathihapatei) কুবলাই খানের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। এই যুদ্ধে বাঙলার রাজাও তার সহায়ক ছিলেন। সম্ভবত বাঙলারাজ তথা সমতটরাজ তখন হয়তো নরসিংহপতির সামন্ত ছিলেন। কাজেই মার্কো পোলোর প্রত্যক্ষ জ্ঞানজ উক্তি উড়িয়ে দেবার মতো নয়।
কুমিল্লার কাছে প্রাপ্ত তাম্রশাসনের প্রমাণে বলা যায় ত্রয়োদশ শতকেও পাটিকের রাজ্য বর্তমান ছিল।৩৬ পাটিকের রাজকন্যাও বর্মীরাজ অলংসিথুর বিয়ে ও সে-কন্যার নরথু কর্তৃক হত্যাকাহিনী বর্মা ও আরাকানে সামান্য ভিন্নভাবে প্রচলিত এবং সে-কাহিনী Burma Chronicle-এ ও সাহিত্যে বিস্তৃত।
.
ইতিহাসের ছায়া
কেউ কেউ মনে করেন, গঙ্গা আগে চট্টগ্রামের পাশে সন্দ্বীপের কাছাকাছি জায়গায় বঙ্গোপসাগরে মিলিত হত। Rennel-এর মানচিত্রেও এর আভাস আছে। আইন-ই-আকবরীতে আবুল ফজল বলেন: (Ganges) Rising in the mountains towards the north, it passes through the province of Delhi and imperial Agra and Allahabad and Behar into the the province of Bengal, and near Qazirhattah in the Sarkar of Barbakabad it divides into two streams, one of these following east-wards falls into the sea of the port of Chittagong