চট্টগ্রামের পণ্ডিত বৰ্ণর একটি ভিক্ষুদল নিয়ে তিব্বত পরিভ্রমণে গমন করেন। চট্টগ্রামের আর একজন রাজা ববলাসুন্দর খগেন্দ্রে অবস্থানরত সিদ্ধ শান্তিগুপ্তের কাছে চট্টগ্রামবাসী একদল পণ্ডিত পাঠিয়েছিলেন, এঁরা সেখান থেকে মন্ত্র-তন্ত্রের অনেক গ্রন্থ চট্টগ্রামে নিয়ে আসেন। ববলাসুন্দরের চার সন্তান ছিল: চন্দ্ৰবাহন, অতীতবাহন, বালবাহন ও সুন্দর হচি। এরা সবাই বৌদ্ধধর্মের প্রতিপোষক ছিলেন। চন্দ্ৰবাহন আরাকানে, অতীতবাহন চাকমাদেশে (পার্বত্য চট্টগ্রামে), বালবাহন বর্মায় এবং সুন্দর হচি আসাম-কাছাড়-ত্রিপুরায় রাজত্ব করেন।
এ থেকে চটল-সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির আভাস মেলে। পণ্ডিতবিহার এবং তীর্থিকদের সঙ্গে বৌদ্ধভিক্ষুদের শাস্ত্রীয় বিতর্কের উল্লেখ থেকে বোঝা যাচ্ছে খ্রীষ্টীয় তৃতীয় শতকের চট্টগ্রাম বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র ছিল।
.
০৫. ইতিহাসের ইঙ্গিত
প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে কিংবা শাসনাদি লিপিতে চট্টগ্রামের নাম মেলে না। কিন্তু Strabo-র বর্ণনা ও Periplus of the Erythrean Sea থেকেও বোঝা যায়, খ্রীস্টীয় প্রথম শতকেও চট্টগ্রাম সামুদ্রিক বন্দর ছিল।
পাহাড়পুরে খলিফা হারুন-অর-রশীদের নামাঙ্কিত একটি মুদ্রা মিলেছে। এ মুদ্রাটি ৭৮৮ খ্রীস্টাব্দে মুহম্মদীয়া টাকশালে তৈরি।২০ আব্বাসীয় খলিফার আর একটি মুদ্রা পাওয়া গেছে ময়নামতীতে। ওটির কোনো বর্ণনা আজো প্রকাশিত হয়নি। আরব বণিকেরা চট্টগ্রাম হয়েই বঙ্গের অভ্যন্তরে বাণিজ্য করত, এ অনুমান অসঙ্গত নয়। কাজেই অষ্টম শতকেও চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক বন্দর ছিল।
৭৮৮-১০১৮ খ্রীস্টাব্দ অবধি আরাকানের বেসালি নগরে এক চন্দ্রবংশ রাজত্ব করেছেন। এ বংশের আদিপুরুষ মহাসিংহচন্দ্র (৭৮৮৮-৮১০) আর এর বংশধর চূড়সিংহ চন্দ্র (Chula Taing Chandra ৯৫১-৫৭) চট্টগ্রাম জয় করেন বলে কথিত। পাটিকেরও বেসালির চন্দ্ররা জ্ঞাতি হওয়া অসম্ভব নয়। বিশেষ করে ধান্যবতীতে এদের পূর্বে রাজত্ব করতেন চন্দ্রসূর্য বংশীয়রা (১৪৬ ৭৮৮)। এঁরা যে ভারতিক ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রভাবিত অথবা ভারত থেকে আগত তাতে সন্দেহ নেই। সংস্কৃত ভাষায় প্রাপ্ত লিপি, শিব লাঞ্ছন ও ভারতীয় হরফ তার প্রমাণ। বিশেষত আরাকানের চন্দ্র রাজাদের মুদ্রা মিলেছে ময়নামতীতে। আটশতকের বাঙলায় প্রচলিত ব্রাহ্মীলিপিতে ও সংস্কৃত ভাষায় ম্রোহঙ-এর সিথাও প্যাগোডার স্তম্ভে উত্তীর্ণ রাজা আনন্দচন্দ্রের লিপি থেকে চন্দ্রবংশীয় রাজাদের পরিচয় পাওয়া যায়। এটি পূর্বতন রাজাদের প্রশস্তিমূলক রচনা। এতে ৬৫টি শ্লোক আছে। ত্রিপুররাজ ছেঙথুমও একবার চট্টগ্রাম জয় করেন।
নয়শতকের হরিখেল মণ্ডলের বৌদ্ধরাজা কান্তিদেবের একটি তাম্রশাসনের অসম্পূর্ণ খসড়া চট্টগ্রামের এক মন্দিরে পাওয়া গেছে।২৩ কান্তিদেবের রাজধানী ছিল বর্ধমানপুর। হরিখেল হুগলী থেকে যশোর, খুলনা, বরিশাল প্রভৃতি অঞ্চল ব্যাপী ছিল বলে অনুমিত হয়।
সপ্তমশতকে হিউএনৎসাঙের পর্যটনকালে সমতট রাজ্য উত্তরে পুরোনো নিম্নব্ৰহ্মপুত্ৰনদ, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং পশ্চিমে পদ্মানদী অবধি বিস্তৃত ছিল। কুমিল্লা জেলার লোকশ্রুতি অনুসারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে লালমাই পাহাড়ের ধার ঘেঁষে সমুদ্র ছিল। যুগীদিয়া ও ভুলুয়া ছিল দ্বীপ। ফেনী অঞ্চল ছাড়া নোয়াখালির অন্যান্য অংশ ছিল সমুদ্রগর্ভে। সমুদ্রে চর জাগার পর তিতাস নদীরূপে দেখা দেয়, ব্রহ্মপুত্রের মূলধারা কুমিল্লার দিকে প্রবাহিত ছিল। এ নদী ধ্রুম (ভলুয়া) নামে পরিচিত ছিল। গতিহারা ধ্রুম বা ভলুয়া নদীর চিহ্ন এখনো বর্তমান। চীনা বৌদ্ধ ভিক্ষু শেঙ চির পরিভ্রমণকালে সমতটের রাজা ছিলেন রাজভট্ট।
কানিংহামের মতে সমতট গঙ্গার বদ্বীপ যশোর অঞ্চল, Fergusson ও Watters-এর মতে যথাক্রমে ঢাকা ও ফরিদপুর। কিন্তু হিউএনৎসাঙ-এর বর্ণনা অনুসারে চটগ্রামও সমতট রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থাকার কথা: এবং সাত শতকে সম্ভবত উত্তরে ব্রহ্মপুত্র, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং পশ্চিমে পুরাতন গঙ্গা বা পদ্মা (তথা আধুনিক মধুমতী নদী) বেষ্টিত ছিল এই সমতটরাজ্য
কোনো কোনো বিদ্বানের মতে নয়শতকে এবং কারো কারো মতে সাত শতকের শেষে ও আটশতকের শুরুতে খড়গরা সমতটে রাজত্ব করতেন। শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে সম্ভবত খড়গরাই সমতটে শাসক ছিলেন। I-Tsing–এর বর্ণনা মতে সাত শতকের শেষার্ধে ছাপ্পান্ন জন ভিক্ষুর ভারত ভ্রমণকালে শেঙচি সমতটে রাজভট্টকে রাজা দেখেছিলেন। অতএব, সাতশতকেই খড়গরা রাজত্ব করতেন।
খড়গ সাধারণ কুলবাগী নয়। প্রথম বৌদ্ধ রাজা নৃপাধিরাজ খড়গোদ্যমের সন্ততি হিসেবেই পিতৃনামাংশ গ্রহণ করেছেন পরবর্তী দুজন রাজা–জাতখড়গ ও দেখড়গ। দেখড়গর পুত্রের নাম রাজভট্ট। এঁদের পরিচয় পাওয়া গেছে ঢাকার ত্রিশ মাইল উত্তরপূর্বস্থিত আশরফপুরে প্রাপ্ত তাম্রশাসনে ও কুমিল্লা থেকে এগারো মাইল দূরে দেউলবাড়িতে প্রাপ্ত সর্বাণীমূর্তিলিপি থেকে।২৮ খড়গরাজাদের রাজধানী ছিল কর্মন্ত বাসক। এইটি বিদ্বানদের মতে কুমিল্লা জিলার বড়কমতা। ডক্টর নলিনীকান্ত ভট্টশালী নিজে এ অঞ্চল পরিদর্শন করে এই মতই পোষণ করতেন।২৯