পূর্বদেশীয় পর্তুগীজ গভর্নর Albuquerque ১৫১৩ সালে পর্তুগালের রাজা ম্যানুয়েলকে জানান Bengal requires all our marchandise and is in need of it. কিন্তু আসলে বাঙলার সঙ্গে তাদের বাণিজ্য-সম্পর্ক গড়ে উঠে আরো আঠারো-উনিশ বছর পরে।
১৫১৪ সনের উড়িষ্যার পিপলি বন্দরে পর্তুগীজেরা বাণিজ্যকুঠি নির্মাণ করে। সেখান থেকেই তারা মেদিনীপুরের হিজলী বন্দরে যাতায়াত করত। ১৫১৭ সনে জোয়াও দ্য সিলভীরার নেতৃত্বে প্রথম বাণিজ্যবহর চট্টগ্রাম বন্দরে উপস্থিত হয়। জোয়াও দ্য সিলভীরা বাণিজ্যের অনুমতি লাভের দৌত্য নিয়ে এসেছিলেন। এসেই কিন্তু দুটো স্থানীয় বাণিজ্যতরী লুট করেন। এ নিয়ে চট্টগ্রামের শাসনকর্তার সঙ্গে তার বিরোধ বাধে। কাজেই কুঠি নির্মাণের জন্যে রাজ-অনুমতি লাভে ব্যর্থ হয়ে তিনি ফিরে যান। ১৫২৮ সন অবধি দ্য সিলভীরা সমুদ্রে অন্যদের বাণিজ্যতরী লুট করতে থাকেন। এর ফলে এদেশের বাণিজ্যে বিপর্যয় ঘটে। এত অপকর্ম করেও পর্তুগীজেরা বাঙলার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনের আশা ছাড়েনি। প্রতি বছর তাদের অন্তত একখানা বাণিজ্য জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে আসত। আর গোয়র পর্তুগীজ গভর্নর নুনো দ্য কুনহা অনবরত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন চট্টগ্রামে পর্তুগীজের বাণিজ্যাধিকার লাভের জন্যে। ভাসকো ডা গামা যেমন প্রথমবারেই কালিকটে জেলেদের বেঁধে রেখে রাজার থেকে সুবিধে আদায় করে নিয়েছিলেন, এখানেও সে উপায় অবলম্বিত হল।
১৫২৮ সনে পর্তুগীজ কেপ্টেন আফোনসো দ্য মেলোর জাহাজ চট্টগ্রাম ও আরাকানের মাঝামাঝি স্থানে ঝড়ের মুখে পড়ে ভেঙে গেল। জেলেরা তাদের উদ্ধার করে দক্ষিণ চট্টগ্রামের শাসক খুদাবখশ খানের নিকট নিয়ে এল। খুদা বখশ মেলোর সাহায্যে তাঁর এক প্রতিপক্ষকে দমন করেন, এবং ভবিষ্যতে এ প্রকার কাজে সহায়তা লাভের উদ্দেশ্যে মেলোকে বন্দী করে রাখেন। গোঁয়ার পর্তুগীজ শাসনকর্তা নুনো দ্য কুনহার কাছে এ সংবাদ পৌঁছলে তিনি অরমুজের বণিক খাজা শাহাবুদ্দীনকে পর্তুগীজ কর্তৃক লুণ্ঠিত তার জাহাজ ও পণ্য ফিরিয়ে দেওয়ার শর্তে বশ করেন। এবং ৩০০০ কুজুওডুস বা টাকা মুক্তিপণ নিয়ে দ্য মেলোকে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে খাজা শাহাবুদ্দীনকে দূত করে পাঠালেন গৌড় দরবারে। এ দৌত্য সাময়িকভাবে সফল হল।
১৫৩৩ সনে মেলো আবার পাঁচখানা জাহাজ ও দুইশ অনুচর নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে এলেন। এলেন পথে পথে দেশী ও আরব বাণিজ্যতরী লুট করে করেই। বন্দরে এসে তিনি গৌড়-সুলতান। গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহর কাছে Duarte-de-Azevdo-র নেতৃত্বে বারোজন লোক মারফত বহুমূল্য উপহার পাঠালেন। উপহার সামগ্রীর মধ্যে বাঙালির জাহাজ থেকে লুটকরা গোলাপজলের পিপাও ছিল। সুলতান লুণ্ঠিত দ্রব্য শনাক্ত করতে পেরে দরবারে প্রেরিত পর্তুগীজদের বন্দী করলেন। সানুচর মেলোকে বন্দী করার জন্যেও নির্দেশ পাঠালেন। ইতিমধ্যেই শুল্ক-ব্যাপারে মেলোর বিবাদও বাধল চট্টগ্রামের শুল্ক-কর্মচারীদের সঙ্গে। সুলতানের নির্দেশ আর এই বিবাদের সুযোগে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা Mello-র সঙ্গে সংঘর্ষ বাধালেন। তাতে পর্তুগীজদের বিপুল ক্ষতি হল ধনে-প্রাণে। এ সংবাদ পেয়ে পর্তুগীজ শাসনকর্তা প্রতিশোধ নেবার জন্যে ৩৫০ জন লোক নিয়ে আনতেনিও দ্য সিলভা মেনজিস-এর নেতৃত্বে এক নৌবহর পাঠালেন। মেনজিস চট্টগ্রামে পৌঁছে বন্দীদের মুক্তি দাবী করলেন। মাহমুদ শাহ পর্তুগীজ কারিগর প্রাপ্তির শর্তে–অপর মতে ১৫০০০ পাউন্ড মুক্তিপণের বিনিময়ে বন্দীদের মুক্তি দিতে রাজি ছিলেন। কিন্তু শর্তারোপে রুষ্ট হয়ে মেনজিস চট্টগ্রাম বন্দরে আগুন লাগিয়ে দেন এবং বহু লোক হত্যা করেন ও বন্দী করে নিয়ে যান। করমণ্ডলের পর্তুগীজ অধ্যক্ষ Diego Rebello ১৫৩৫ সনে সশস্ত্র অনুচর নিয়ে সপ্তগ্রামে আসবার। পথে দুটো আরব বাণিজ্য-জাহাজকে বঙ্গোপসাগর থেকে বিতাড়িত করেন।
তবু শেরশাহর আক্রমণে বিপর্যস্ত মাহমুদ শাহ পর্তুগীজদের হাত করতে প্রয়াসী হলেন। ফলে মেলো ও রেরেলোকে শেরশাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধের কাজে লাগালেন। এই সুযোগে রেবেলো চট্টগ্রাম বন্দরের পূর্ণ অধিকার লাভ করলেন এবং এরূপে আরব ইরানী ও অন্যান্য জাতির চট্টগ্রামের সঙ্গে বাণিজ্য-সম্পর্ক ছিন্ন হল। Villalobos ও জোয়াও কোরিয়ার নেতৃত্বে শেরশাহর বিরুদ্ধে মেলো দুটো নৌবাহিনী দিয়েছিলেন। এই কৃতজ্ঞতায় মাহমুদ শাহ মেলোকে ৪৫০০০ রী (Reis) এবং পর্তুগীজ সৈন্যদের মাথাপিছু দৈনিক ১০ টাকা করে ভাতা দেন এবং চট্টগ্রামে ও সপ্তগ্রামে তারা কুঠি নির্মাণ ও শুল্কালয় প্রতিষ্ঠার অধিকার পায়। এমনকি নুনো ফারনানডেজ Freire এবং জোয়াও কোরিয়া যথাক্রমে চট্টগ্রামে ও সপ্তগ্রামে শুল্ক বিভাগের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। এর পরে বাঙলায় এলেন কেপ্টেন আফনসো দ্য ব্রাইটো। মাহমুদ শাহর সাহায্যার্থ গোয়া থেকে ভাসকো-ডা সেম্পাও-র নেতৃত্বে নয়টি রণতরী প্রেরিত হয়। এ সময় মাহমুদ শাহর চট্টগ্রামস্থ শাসনকর্তা খুদাবশ খান ও হামজা খানের মধ্যে বিরোধ চলছিল। পর্তুগীজ শুল্কাধ্যক্ষ Fernandez হামজা খানের পক্ষাবলম্বন করেন। এ বিরোধের সুযোগে শেরশাহর সেনাপতি খিজির খান চট্টগ্রাম বন্দরের অধিকার পান। কিন্তু শীঘ্রই সেম্পাও-এর বাহিনী খিজির খার প্রতিনিধিকে বিতাড়িত করেন। তখন শেরশাহর পক্ষ থেকে পর্তুগীজদের আশ্বাস দেয়া হল, তারা আগের মতো সর্বপ্রকার সুযোগ সুবিধা পাবে। এতে পর্তুগীজ-অধ্যক্ষ ফারনানডেজ হামজা খানের পক্ষ ত্যাগ করে খিজির খানের তথা শেরশাহর পক্ষ নিলেন। কিন্তু তখনো সেম্পাওর প্রেরিত পর্তুগীজ সৈন্যেরা হামজা খানের পক্ষে ছিল। তারা খিজির খানের অফিসারদের ধরে নিয়ে সেম্পাওর জাহাজে বন্দী করে রাখল। এ বিরোধের ফলে ১৫৪০ সালের দিকে খিজির খানের হাতে পর্তুগীজদের ধন-প্রাণের ক্ষতি হল বিস্তর। এরূপে সেম্পাওর অবহেলা এবং ফারনানডেজের অপরিণামদর্শিতার ফলে চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিকার প্রাপ্তির সুযোগটি পর্তুগীজদের হারাতে হল। অবশ্য পর্তুগীজরা বাণিজ্য ও দস্যুবৃত্তি দুটোই সমান চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তবু ষোলো শতকের শেষাবধি পর্তুগীজেরা বাঙলা দেশে দুর্গাদি নির্মাণ করে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। যদিও চট্টগ্রামে (Porto Grando) ও হুগলীতে (galin or porto pequino) তারাই প্রায় একচেটিয়া বাণিজ্যের উপায় করে নিয়েছিল। চট্টগ্রামে পর্তুগীজ ভূমিকার প্রধান ঘটনাগুলো এই: